Sunday 24 December 2017

ভ্রমণ কাহিনী- নর্মদার তীর থেকে (অমরকণ্টক, পাচমারী, জব্বলপুর)- সনৎকুমার পুরকাইত

ঘুরে ট্যুরে-
তপোভূমি নর্মদা
-অধ্যাপক সনৎ কুমার পুরকাইত
ভূগোল বিভাগ, রায়দীঘি কলেজ
অমরকন্টকঃ
                ভারতীয় উপমহাদেশে যে সকল নদনদী বর্তমান তার মধ্যে এই নর্মদা হল পঞ্চম দীর্ঘতম নদী এবং কেবলমাত্র ভারতের মধ্যে যে নদীগুলি প্রবাহিত তার মধ্যে তৃতীয় দীর্ঘতম হল এই নর্মদা। অর্থাৎ গোদাবরী কৃষ্ণার পরেই নর্মদার স্থান। এই নর্মদাকে তার অসামান্য অবদানের কারনে মধ্যপ্রদেশের জীবন রেখা বলা হয়ে থাকে। মধ্যপ্রেদেশের অনুপপুর জেলার সাতপুরা পর্বতমালার অমরকণ্টক মালভূমি তথা পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপত্তি লাভ করে প্রায় ১৩১২ কিমি পথ অতিক্রম করে সাতপুরা বিন্ধ্য পর্বতমালার মাঝখান দিয়ে পশ্চিমবাহিনী হয়ে আরব সাগরের খাম্বাত উপসাগরে মিলেছে। এই নদী দক্ষিণ উত্তর ভারতকে মাঝ বরাবর পৃথক করে রেখেছে। অমরকণ্টক কে ভারতের পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছে এই নর্মদা নদী নদী কেন্দ্রিক সভ্যতা সংস্কৃতি। তাই তপোভূমি নর্মদা সম্পর্কে জানতে হলে অমরকণ্টক সম্পর্কে জানা জরুরী। তাই এবারের কাহিনী অমরকণ্টক থেকে শুরু করা হল। হাওড়া থেকে আজাদ হিন্দ এক্সপ্রেসে চড়ে সোজা বিলাসপুর স্টেশন। সেখান থেকে প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত রাস্তা ধরে আমাদের স্করপিও এগিয়ে গেল অমরকণ্টকের পথে। পথের আকর্ষণ একেবারে আলাদা। পাহাড়ি পথের দুধারে অজস্র গাছ। গিরিখাত আর গাছগাছালির বিচিত্র বিন্যাস। বাতাসের গুনগুনানি আর মহুয়ার নেশায় মাতাল হওয়ার মতো বুঁদ হয়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে, ঠিক যেখানে সাতপুরা, বিন্ধ্য মৈকাল পর্বতের সন্ধিস্থল- সতীপীঠ অমরকণ্টক, তপোভূমি  নর্মদার উৎসস্থল। রামায়ন, মহাভারত থেকে শুরু করে মার্কণ্ডেয় পুরান এমনকি মহাকবি কালিদাসের মেঘদুত কাব্য রচনায় জায়গা হয়েছে এই অমরকণ্টকের নারদ মুনি, বশিষ্ঠ, দুর্বাসা, ভৃগু মুনির ন্যায় ঋষিরা এই অমরকণ্টকে তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন। হেন স্থানে পৌঁছে নর্মদা মাহাত্ম্য অনুভব করে আপনিও মহাভাবে নিমজ্জিত হবেন। আমরা এখন নর্মদার উৎসস্থলে দাঁড়িয়ে। তাই আমরা এই সুযোগে নর্মদাকে চিনে নেব।
   নর্মদাঃ
গঙ্গে যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু।।
আমরা জানি পূজা অর্চনা তর্পণাদিতে আচমন আসন শুদ্ধির পর জলশুদ্ধির উপরোক্ত মন্ত্র পাঠ করতে হয়। কারণ গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু কাবেরী- এই সাত নদীকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে পবিত্রতম নদী বলে মানা হয়। আর নর্মদা এই সমস্ত নদীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। গঙ্গা উপাসনার নদী, সরস্বতী জ্ঞানের নদী আর নর্মদা হল তপস্যার নদী। স্কন্দপুরান অনুযায়ী সরস্বতীর জলে তিন দিন, যমুনার জলে সাত দিন আর গঙ্গার জলে একদিন স্নান করলে পবিত্র হয়। কিন্তু নর্মদার জল কেবলমাত্র দর্শন করলেই পবিত্রতা আসে। শুধু তাই নয়, নর্মদার তট হল তপস্যার উত্তম ভূমি। নর্মদা তটে তপস্যা করলে অন্য যে কোন তপস্যার থেকে অধিক এবং দ্রুততর ফল লাভ হয়। তাই প্রাচীন কাল থেকে সমস্ত মুনি ঋষিরা তাঁদের সাধনক্ষেত্র হিসাবে নর্মদা তটকেই বেছে নিয়েছেন। এই ধরিত্রির উপর দিব্য ব্রহ্মনদী বিষ্ণুনদী বিদ্যমান। কিন্তু একমাত্র রুদ্র নদীনর্মদা নর্মদা নদীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা। রুদ্রের তেজ থেকে উৎপন্ন এই নদী স্থাবর জঙ্গম সবকিছু তিনি ত্রান করে সর্ব সিদ্ধি প্রদান করেন। আর এই নর্মদার উৎসস্থল হিসাবে ভারতের তীর্থভূমির মধ্যে অমরকণ্টক একটি অন্যতম পবিত্র তীর্থ। যা সনাতন ঋষি, মুনি, সাধু, সন্তু, মহাত্মা তীর্থ অভিযাত্রীদের যুগ যুগ ধরে আহ্বান করে চলেছে।

মহাভারত, স্কন্দপুরান সহ বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে এই নর্মদার মাহাত্ম্য উল্লেখ থাকলেও এখানে আমরা বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধুমাত্র এটুকুই জেনে রাখা দরকার যে নর্মদা ভারতের অধ্যাত্মজগতের এক বিরাট অধ্যায়। এমনকি সপ্ত কল্পের অবসানকালেও নর্মদা অক্ষত ছিল। তিনি লাস্যময়ী রুদ্রজা, চন্দ্রনিভাননা, পদ্মপলাশলোচনা, শীলাবতী, সুশোভনা লাবণ্যময়ী এক অপরূপা কুমারী যার প্রেমে পাগলপারা। তিনি পিতা শিব শঙ্করের কাছে প্রার্থনা করেন, ‘আমি যেন ঠিক এইভাবে চিরকাল আপনার সাথে নিত্যযুক্ত থাকতে পারি। হে প্রভো! প্রলয়কাল উপস্থিত হলে যখন স্থাবর জঙ্গম বিনষ্ট হবে আমি তখন যেন অক্ষয়া হই। সমস্ত পর্বত, নদনদী, সাগর যখন লয়প্রাপ্ত হবে তখনও আমি যেন বিলুপ্ত না হই। হে প্রভো! যে সকল পাতক, উপপাতক মহাপাতক ভক্তিযুক্ত হয়ে আমার জলে অবগাহন করবে তারা যেন কলুষ মুক্ত হয়। দেবগণ সর্বদা যেন আমার পূজা করেন। হে পিতা, যারা ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ করবে তারাও যেন আমার জলে অবগাহনমাত্রই  পাপমুক্ত হতে পারে। সকল যজ্ঞানুষ্ঠানের যে ফল, আমার জলে অবগাহনে যেন মানুষ সেই ফল লাভ করে। দান, উপবাস, তীর্থ ভ্রমণে যে ফল লাভ হয়, আমার জলে স্নান করলে যেন সেই ফল লাভ হয়। আমার তীরে যারা আপনার অর্চনা করবে তারা যেন মৃত্যুর পর আপনার লোকে অর্থাৎ শিবলোকে গমন করে। হে নিখিলদেব আপনি মাতা উমার সাথে আমার তীরে সর্বদা বাস করুন। আপনি যদি আমায় বর দানের যোগ্য বলে মনে করেন, তবে আমি যেন মহাপাতকনাশিনী বলে ত্রিভুবনে খ্যাত হই
       নর্মদা বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সময়ে অভিহিত হয়েছেন। স্কন্দপুরান মতে নর্মদার অপর নাম রেবা। রেবা নামের পিছনে অবশ্য দুটি পৃথক কাহিনী বর্তমান। তা অন্য সময় ব্যাখ্যা করা যাবে। তিনি সকল পাপনাশিনী বলে তাঁর নাম বিপাপা।  আবার মানুষের দুঃখ মোচন করেন বলে তিনি বিপাশা। নর্মদার জল নির্মল, বিমল। প্রলয়ের সময় জগত তমোময় হলেও নর্মদা মহাপ্রভাময়ী ছিলেন তাই পণ্ডিতগণবিমলানামেও ডাকেন। নর্মদা ক্ষরিত হয়ে প্রবাহিত হলে বিশ্ব মুদিত হয় তাই লোকেকরভাবলে। নর্মদা দর্শন মাত্রই ত্রিলোক রঞ্জিত হয়, এই লোকরঞ্জনের জন্য নর্মদার অপর নামরঞ্জনা


নর্মদারাং তপঃ কুর্যাৎ শরণং জাহ্নবী তটেঅর্থাৎ গঙ্গাতীরে মৃত্যু হলে জীবের উচ্চগতি হয় কিন্তু তপস্যায় সিদ্ধি লাভ করতে হলে একমাত্র নর্মদার তটই শ্রেষ্ঠ। তাই নর্মদার তটকে তপভূমি বলে। এই তটে তপস্যা করলে অন্য স্থানের থেকে দ্রুত এবং শতগুণ বেশী ফল পাওয়া যায়।

গঙ্গা কনখলে পুণ্যা কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী।
গ্রামে বা যদিবারণ্যে পুণ্যা সর্বত্র নর্মদা।।
গঙ্গার পুণ্য মহিমা হরিদ্বারের কনখলে বেশি কারণ সেখানে প্রজাপতি দক্ষ যজ্ঞ করেছিলেন। সরস্বতী নদীর নানাস্থানে বৈদিক ঋষিরা বেদপাঠ যজ্ঞাদি করলেও কুরুক্ষেত্রেই সরস্বতীর মহিমা সর্বাধিক। কারণ কুরুক্ষেত্রেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করান। কিন্তু নর্মদার জল উদ্গম থেকে মোহনা পর্যন্ত সব জায়গাতেই সমান মহিমাপূর্ণ। নর্মদার সংগমে কোনও স্থানে যেখানে অন্য কোনও নদী এসে মিলিত হয়েছে সেই স্থানে যদি জপ, তপ, স্নান, দান, হোম, বেদপাঠ, পিতৃ পূজন, দেবতার আরাধনা, মন্ত্রোপদেশ, সন্ন্যাস এবং দেহত্যাগ হয় তাহলে সেই কর্মের ফল তৎক্ষণাৎ প্রাপ্ত হয়। নর্মদার তীরে প্রায় ৬৪,০০০ তীর্থ রয়েছে। তীর্থযাত্রীদের নিকট নর্মদা পরিক্রমা একটি মহাপুন্যের কাজ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে নর্মদার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত পদব্রজে পরিক্রমা করে ফেরত আসতে মোট সময় লাগে বছর মাস ১৩ দিন। এই নর্মদার উপর বাঁধ নির্মাণ নিয়ে পরিবেশবিদদের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন সাম্প্রতিক অতীতে ভারতীয় রাজনীতির শিরোনামে চলে আসে। এবারে একটু মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করা যাক। 

শ্রী নর্মদা মন্দিরঃ
শ্রী নর্মদা মন্দিরের নির্মাণ নিয়ে সঠিক কোন প্রামান্য নথি পাওয়া না গেলেও সম্ভবত দশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে কালচুরী রাজাদের আমলে বাঁশ বনের মধ্যে নর্মদার উদ্গম কুণ্ড আবিস্কার করার পর রেবা নায়েক এখানে মন্দির নির্মাণ করান স্বপ্নাদেশ পেয়ে। কিন্তু কালের গর্ভে সেই মন্দির বিলুপ্ত হয়ে যায়। সাম্প্রতিক অতীতে নাগপুরের ভোঁসলে রাজারা মন্দিরের জীর্ণ কাঠামো উদ্ধার করেন এবং রেবার মহারাজ গুলাব সিংহ এই মন্দিরকে সংস্কার করান। দূর থেকে এটির নির্মাণ শৈলী অনেকটাই মুসলিম ঘরানার মতো দেখায়। কারণ হিসাবে প্রবীন অমরকণ্টক নিবাসীর কাছে জানা যায় যে গুলাব সিংহের মুখ্য কারিগর ছিলেন মুসলিম। রাজা গুলাব সিংহ নির্মাণ কাজ দেখতে এসে দেখেন মন্দিরের প্রবেশদ্বারের তোরণটি অনেকটা মসজিদের প্রবেশদ্বারের মতো লাগছে। তাই রাজার নির্দেশে কারিগর প্রবেশ দ্বারের শীর্ষে গণেশ মূর্তি স্থাপন করে দেন। মন্দিরের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলে আপনি বিশালাকার প্রস্তরময় চত্বর দেখতে পাবেন। এই চত্বরে নর্মদা মন্দির ছাড়াও একে একে পার্বতী অমরকন্ঠেশ্বর মহাদেব মন্দির, শ্রী কার্ত্তিক মন্দির, শ্রী অন্নপূর্ণা মন্দির, শ্রী রামদরবার, শ্রীবিষ্ণু মন্দির, শ্রী দশাবতার মন্দির, শ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, শ্রী সূর্য মন্দির, শ্রী রোহিনীমাতা মন্দির, শ্রী নর্মদা উদ্গম মন্দির, শ্রী বংশেশ্বর মন্দির, শ্রী সত্যনারায়ণ মন্দির, শ্রী গোরক্ষনাথ মন্দির, শ্রী ঘণ্টেশ্বর মন্দির, প্রাচীন অষ্টবসু বাঁ নবগ্রহ মন্দির, শ্রী ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দির, শ্রী দুর্গা মন্দির, শ্রী সিদ্ধেশ্বর মন্দির, শ্রী গৌরীশঙ্কর মন্দির, শ্রী রামজানকী মন্দির, শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির বা মুরলীমনোহর মন্দির, শ্রী একাদশ রুদ্র মন্দির, শ্রী ওঙ্কারেশ্বর মহাদেব মন্দির, শ্রী রেবা নায়েক মন্দির, শ্রী হনুমান মন্দির, ভৈরবী চক্র যজ্ঞশালা দেখতে পাবেন। মন্দির পরিসরে মোট ২৭ টি মন্দির আছে। মূলমন্দিরে বিরাজমান রয়েছে মা নর্মদা।এখানে পূজা দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম অন্য মন্দিরে। প্রণিপাত মা নর্মদা ও দেবাদিদেব মহাদেব কে। সামনেই একটি প্রস্তরের হাতি বর্তমান যার নিচ দিয়ে গলে যেতে পারলেই পুণ্য অর্জন হয় বলে ভক্তদের ধারনা। আপনিও চেষ্টা করতে ভুলবেন না। 

পূর্বমুখী মন্দিরে মায়ের কালো নিরাভরণ আকর্ণ বিস্তৃত চোখ, উন্নত নাক, ক্ষীণকটি তপস্বিনী কষ্টি পাথরের মূর্তি। তিনি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে পশ্চিমমুখী মন্দিরের অভ্যন্তরের পিতা অমরনাথ বা অমরকন্ঠেশ্বর মহাদেবের দিকে। এই সকল মন্দির নর্মদার ন্যায় জাগ্রত বলে মনে করা হয়। মন্দিরের পূজা যজ্ঞাদির কাজকর্ম নিয়ম করেই হয়। এই স্থানের সাথে শংকরাচার্যের নাম জড়িত কারণ তিনি এই মন্দিরের ভৈরবী চক্র, হনূমান মূর্তি কার্তিকের মূর্তি স্থাপন করেন। এছাড়াও আপনারা কোটি তীর্থ, রোহিণীকুণ্ড, প্রাচীন রঙমহল কর্ণমন্দির দেখতে পাবেন।  এই কর্ণ মন্দির মহারাজ কর্ণের সময় অমরকণ্টক ক্ষেত্র খুবই সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। রাজা কর্ণ অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্রকৃতির শক্তিশালী ছিলেন। কালচুরী রাজাদের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এই মন্দির নির্মাণ করানো হয় পরবর্তীকালে। নর্মদা মন্দিরের বাঁদিকে ১০০ মিটার দূরে অবস্থিত এই প্রাচীন মন্দিরগুলি বর্তমানে ভারতের পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত। প্রাচীনতার মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া আপনাকে বাংলার মুর্শিদাবাদ থেকে দক্ষিণ ভারতের গোলাপবাগকে স্মরণ করাবে। এর পূর্বদিকে প্রায় কিমি দূরে নানান ওষধি গাছের সমাহারে মা নর্মদার খেলার জায়গা মাই কি বাগিয়া বা মায়ের খেলার বাগান বর্তমান চলুন এবার মায়ের বাগানে যাওয়া যাক।

মাই কি বাগিয়া (মায়ের বাগান):
নর্মদা মন্দিরের পূর্ব দিকে প্রায় কিমি হাঁটাপথে মাই কি বাগিয়া বা মায়ের বাগান এর অন্য নাম চরনোদক কুণ্ড এটি মা নর্মদার খেলার জায়গা আমরা অবশ্য গাড়িতে করে গেলাম। মৈকল রাজার কন্যা রূপে নর্মদা তার বাল্যসখা গোলাবকাউলির সঙ্গে এই বনে খেলা করতেনএখানে একটি জলকুণ্ড আছে এই জল নর্মদার জলময়ী রূপ সেটি চরনোদক কুণ্ড নামে পরিচিত মায়ের বাগানে বিভিন্ন প্রকার ওষধি বৃক্ষ রয়েছে গোলাবকাউলি বৃক্ষ চোখের রোগে খুব উপকারী পূর্বে গোলাবকাউলি কেবল অমরকন্টকে দেখতে পাওয়া গেলেও এখন অন্যত্র এর চাষ বর্তমান এখানে বানরকুল তাদের সাম্রাজ্য বিনা বাধায় বিস্তার ঘটিয়েছে। আপনারা একটু বেখেয়াল হলে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারাতে পারেন।
শোনমুড়াঃ
মাই কি বাগিয়া থেকে বেরিয়ে কিমি দুরে শোনমুড়ার অবস্থান হাঁটাপথে মিনিট দশেক চলার পর বাঁদিকে বাঁধানো সিড়ি নেমে গেছে পাহাড়ি খাদের দিকে শোনমুড়া শোন নদের উৎসস্থল স্থানীয় নাম 'শনেমারা' সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নেমে একটা বাঁধানো কুণ্ড লেখা রয়েছে ব্রহ্মপুত্র শোন আট দশ হাত দুরে আরেকটি কুণ্ড ভদ্র নদের উৎপত্তিস্থল ভদ্রনদ কয়েক হাত দুরে গিয়ে তির তির জলধারায় মিশে গেছে উভয়ের মিলিত নাম শোনভদ্র শোনভদ্রের মিলিত জলধারা সেখান থেকে নেমে ক্রমে চলে যাচ্ছে ১৫০ মিটার দুরে পাহাড়ি গিরিখাদের দিকে সেখান থেকে জলপ্রপাত রূপে শোন নদ পাহাড় থেকে নিচের গভীর খাদে পড়ে প্রায় পাঁচশো মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিহারের রাজধানী পাটনার কাছে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়েছে শোনের অপর নাম হিরন্যবাহ যেখান থেকে জলধারা পাহাড়ের নিচে পড়ছে, সেখানে ভিউপয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে সাধারন ভ্রমনার্থীরা এটিকে সুইসাইড পয়েন্ট নামে চেনে যাইহোক, ভিউপয়েন্ট থেকে দূরের ঘন অরণ্যে সজ্জিত পর্বতরাজির দৃশ্য খুবই নয়নাভিরাম
পুরানমতে ব্রহ্মার অশ্রু থেকে শোন নদের উৎপত্তি তবে স্থানীয় কাহিনীও বর্তমান পুরাকালে মেকল পর্বতে রাজা মৈকালের একমাত্র কন্যার নাম ছিল নর্মদা পিতার আদরের কন্যার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে পিতা সুরম্য ফুলের বাগান সুসজ্জিত শিব মন্দির নির্মান করান নর্মদার সৌন্দর্য ইতিপূর্বে আপনারা জেনেছেন একদা শোনভদ্র নামে এক রাজপুত্র সন্ন্যাসী বেশে নর্মদা উদ্যানে এসে তাঁর রূপে মোহিত হয়ে প্রেম নিবেদন করেন নর্মদাও তার প্রতি অনুরক্ত হয় তখন রাজপুত্র তাঁর নিজের পরিচয়দান করেন শিবসাক্ষী করে দুজনের বাগদানপর্ব সম্পন্ন হয় এরপর শোনভদ্র পিতাকে সঙ্গে নিয়ে এসে রাজা মৈকাল এর কাছে পাণিপ্রার্থনা করার প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু তিনি নিজ রাজ্যে গিয়ে যুদ্ধকার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এদিকে সময়ের সাথে সাথে রাজা মৈকাল মেয়েকে পাত্র দেখে বিয়ে দিতে চাইলে নর্মদা রাজী হয়ে যান এদিকে বিয়ের পরে পরেই রাজা শোনভদ্র পিতাকে নিয়ে হাজির হন সবকিছু জানার পরে নর্মদাকে অভিশাপ দেন ' নর্মদা তুমি আমার প্রেমের অবমাননা করেছ, বিশ্বাসঘাতকতা করেছ আজ থেকে তুমি নদীতে পরিনত হও তখন নর্মদা বললেন, বিনা দোষে তুমি আমায় অভিশাপ দিলে  আমি যদি নদী হই তবে তুমিও নদে পরিনত হও' তবে এসব গল্পগাথা কালের ক্রমবিবর্তনে আজও বিদ্যমান নর্মদার পুরাতাত্ত্বিক প্রাকৃতিক সত্ত্বা সর্বজনস্বীকৃত
শোনাক্ষী দেবীর মন্দিরঃ
প্রিয় পাঠক, শোনমুড়াতেই শোন নদের উদ্গম কুণ্ডের পাশেই দেখতে পাবেন শোনাক্ষী দেবীর মন্দির এই মন্দির সতীর ৫১ পীঠের অন্যতম সতীপীঠ দক্ষযজ্ঞে দেবী অপমানিত হয়ে যখন দেহত্যাগ করার পর দেবাদিদেব মহাদেব সতীর দেহ কাঁধে চড়িয়ে সারা জগৎ পরিভ্রমন করছিলেন এবং ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র দিয়ে দেবীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করছিলেন তখন এইস্থানে দেবীর বামনিতম্ব পতিত হয় কালক্রমে তা তীর্থক্ষেত্রে রূপ নেয় তবে অন্যান্য সতীপীঠের ন্যায় এর জৌলুসতা নেই এখানেও আপনাকে আপনার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র সাবধানে রাখতে হবে, কারন মাই কি বাগিয়ার মতো এখানেও বানরকুলের আধিপত্য বর্তমান এখানে নবরাত্রিতে ধুমধাম করে পূজা উৎসব হয়
সুইসাইড পয়েন্টঃ
দেবীর মন্দির থেকে বেরিয়ে ডানদিকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে যেখানে সবুজ আস্তরণে মোড়া নর্মদা শোন উপত্যকা দেখতে পাওয়া যায়। এখানেই রয়েছে সুইসাইড পয়েন্ট। অনেকের ধারনা আছে, সুইসাইড পয়েন্ট মনে হয় কোন একটি জায়গা, কিন্তু তা নয়। পাহাড়ে বা সাগরের উপকুলে এমন অনেক জায়গা বর্তমান যা সুইসাইড পয়েন্ট নামে পরিচিত। কারন সকল স্থান থেকে কেউ পড়লে আর বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না। তবে ঝুঁকি না নিলে পরমানন্দ মিলে না। তাই সুইসাইড পয়েন্ট না দাঁড়ালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করা যায় না। 
আদিনাথ জৈন মন্দির বা জৈন তীর্থঃ

নর্মদা মন্দিরের কিমি উত্তরে পাহাড়ের চড়াইয়ে আদিনাথ জৈন মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছে। জৈন সম্প্রদায়ের আচার্য পূজ্য ১০৮ শ্রী শ্রী বিদ্যাসাগর মহারাজের প্রেরণায় সুবিশাল মন্দিরটির নির্মাণ কাজ চলছে। রাজস্থানী বেলেপাথরের নির্মিত মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৪৫০ ফুট, প্রস্থ ১২৫ ফুট এবং উচ্চতা ১৫১ ফুট। গর্ভগৃহে প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার ২৪ টন ওজনের ভগবান আদিনাথ বা ঋসভদেবের অষ্টধাতুর বিগ্রহ বিদ্যমান। আমরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন জনজাতির সংস্কৃতির সাথে সাথে তাদের শিল্পকলা, স্থাপত্য ভাস্কর্যের নিদর্শন পেয়েছি দক্ষিন ভারতের রামেশ্বরম মন্দির বা পদ্মনাভ স্বামীনারায়ন মন্দির, পূর্ব ভারতের পুরীর জগন্নাথ মন্দির, কোনারকের সূর্য মন্দির বা মধ্য ভারতের খাজুরাহো বা পশ্চিম ভারতের দ্বারকার সোমনাথ মন্দির বা কৈলাশ, কেদার, লিঙ্গরাজ, মহাবলিপুরম, বিরূপাক্ষ, দ্বারকাধীশ, রঙ্গনাথস্বামী, মাদুরাই এর মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বরম মন্দির,  এর শিল্পকলা আধুনিক মানুষকে ভাবায় তার কারুকলা নৈপুন্যতায় কিন্তু সে সব সুপ্রাচীন অতীতকালের শিল্পমাধুর্য্যধারা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আদিনাথ জৈন মন্দিরের ভাস্কর্য্য নতুন করে ভাবায় নীরবে বলতে চায়, "শিল্পীর কোনদিন মৃত্যু হয় না" একবিংশ শতকের যান্ত্রিক যুগে দাঁড়িয়ে রাজস্থানী বেলেপাথরের উপর মানুষের হাতের সুনিপুন খোদিত তুলির টান আপনার দৃষ্টি আকর্ষন করবেই বিগ্রহ দর্শনের পাশাপাশি মন্দিরের ভাস্কর্য আপনাকে বিন্দুতে বিন্দুতে আটকে রাখবে তবে শিল্পীরর রসমাধুর্য বুঝতে গেলে অবশ্যই আপনাকে রসিক মানুষ  হতে হবে
শ্রীযন্ত্র মহামেরু মন্দিরঃ
নর্মদা মন্দিরের দক্ষিনে সোনমুড়া যাওয়ার রাস্তায় কিছুটা দুরেই নির্মীয়মাণ এই মন্দিরটি মন্দিরের নামেই বোঝা যাচ্ছে মন্দিরটি শ্রী যন্ত্রের ন্যায় নির্মিত। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ উচ্চতা প্রতিটিই ৫২ ফুট। মন্দিরের গায়ে সুন্দর দেবদেবীর ভাস্কর্য বিদ্যমান। স্বামী সুকদেবানন্দজী শ্রীযন্ত্র মহামেরু মন্দিরের প্রাণপুরুষ। এই মন্দিরে একটি বিশালাকার হাতি ছিল যেটি সম্প্রতি মারা যায় এই মন্দিরের সংস্কারের কাজ চলায় আমরা প্রবেশাধিকার পায় নি। তবে বাইরে থেকে যেটুকু বোঝা যায় এই মন্দির
কপিলধারাঃ
নর্মদা নদীর পশ্চিমে প্রায় কিমি দূরে গেলে দেখতে পাবেন নর্মদার প্রথম প্রাকৃতিক জলপ্রপাত কপিলধারা শোনা যায় মহামুনি কপিল এখানে দাঁড়িয়ে শিবের তপস্যা করেছিলেন তাই তাঁর নামানুসারে এই জলধারা কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে ২২ জন কপিলের সন্ধান পাওয়া গেছে তার মধ্যে কোন কপিল এখানে তপস্যা করেন তা বিশদভাবে জানা যায় না নর্মদা এখানে প্রায় ১০০ ফুট নিচে ভূপতিত হচ্ছে পর্যটকদের দেখার জন্য এখানে ভিউপয়েন্ট করে দেওয়া  হয়েছে জলপ্রপাতের কিছু আগে কপিল মুনির প্রস্তরীভূত  পায়ের ছাপ বর্তমান নর্মদা নদীর উপরে আছে ছোট্ট লোহার সেতু যেটি পেরোলেই দেখতে পাবেন উত্তর তটে স্থিত শিবলিঙ্গ যা কিনা কপিলেশ্বর নামে সমধিক পরিচিত
দুধধারাঃ
কপিলধারা বাঁদিকে রেখে নিচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আরও প্রায় এক কিলোমিটার পথ নিচের দিকে হাঁটলে দেখবেন নর্মদার দ্বিতীয় জলপ্রপাত দুধধারাজলপ্রপাতের উচ্চতা মাত্র ১০ ফুট হলেও এর পবিত্রতা আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য বিন্যাস করে তুলেছে অতীব মনোরম মাধুর্য্যমন্ডিতকথিত আছে এখানে দুর্বাসা ঋষি তপস্যা করেছিলেন 
দুধধারার পাশেই দুর্বাশার গুহা আজও বিদ্যমানসেইকারনে এই স্থান প্রথমে দুর্বাসা ধারা নামে পরিচিত হলেও উচ্চারনের অপভ্রংশের জন্য পরবর্তী কালে দুধ ধারা নামে পরিচিতি পায় আবার মতান্তরে, রেবা রাজ্যের রাজকুমার এই স্থানে নর্মদাকে একটি দুধের ধারা রুপে প্রবাহিত হতে দেখেন তাই এরুপ নামকরন এই জলপ্রপাতের জলে পুন্যার্থীরা স্নান করে পুন্য অর্জন করেন জুতা পরে নর্মদার জলে নামতে দেওয়া হয় না
জলেশ্বর মহাদেবঃ
অমরকন্টক থেকে রাজেন্দ্রগাঁও গামী রাস্তায় ১০ কিমি যাওয়ার পর ডানদিকে অর্থাৎ ঠিক মধ্যপ্রদেশ ছত্তিসগড় এর সীমান্ত বরাবর পেন্ড্রারোড স্টেশনে যাওয়ার পথেই বাঁদিকেই পড়বে জলেশ্বর মহাদেব মন্দির জলেশ্বর পাহাড়ে অবস্থিত এই  মন্দির বিগ্রহ আড়ম্বরহীন অবস্থায় বিদ্যমান এর মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত মানস সরোবরের পাশেই কৈলাস শিবের আদি বাসস্থান হলেও অমরকন্টকের জলেশ্বর শিবের দ্বিতীয় কৈলাশ বলে মনে করা হয় তিনি এখানে ত্রিপুরাসুর বধ করবার জন্য এক হাজার বছর নির্মিলিত নয়নে চেয়ে থেকে অঘোর দিব্যাস্ত্র প্রাপ্ত হন  একভাবে দীর্ঘকাল তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ থেকে যে অশ্রু নির্গত হয় তাই রুদ্রের অক্ষ- রুদ্রাক্ষ
মন্দিরের গর্ভগৃহে দুই ফুট নিচে চ্যাপ্টা শিবলিঙ্গ জলেশ্বর মহাদেব আপনি মন্দিরের ভিতরে পূজারী বা পূজার উপকরন না দেখতে পেলেও, শিবকে তার দ্বিতীয় কৈলাসে বসে থাকতে দেখবেন ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু রূপে
অম্বিকেশ্বরঃ
জলেশ্বর মহাদেব মন্দির অর্থাৎ শিবের দ্বিতীয় কৈলাস থেকে বেরিয়ে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে অবস্থিত অম্বিকেশ্বর মহাদেবের মন্দির যেখানে শিবের দ্বাদশ লিঙ্গ বর্তমান। এই মন্দিরের গর্ভগৃহে ১২ ফুট উচ্চতার বিরাট আকারের শিবলিঙ্গ ভক্তদের কাছে এক মাহাত্ম্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। নবনির্মিত এই মন্দির খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই মন্দির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আপনারাও অবশ্যই করে এই মন্দিরে পদার্পণ করে দেবদর্শন করে আসবেন।

পাচমারীঃ

অমরকণ্টকের অম্বিকেশ্বর মহাদেবের মন্দির থেকে বেরিয়ে সোজা পেন্ড্রা রোড স্টেশনে এলাম। এখান থেকে অমরকণ্টক এক্সপ্রেস ধরে সোজা পিপারিয়া স্টেশন। সেখান থেকে স্করপিও করে রাস্তায় যেতে যেতে বাইসন, ময়ূর, বানর ইত্যাদি দেখতে দেখতে পাচমারী শহরের হোটেলে। মধ্যপ্রদেশের পর্যটন মানচিত্রে পাচমারী এক উজ্জ্বল জায়গা। সবুজের চাদরে মোড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে ভরপুর মানীনি পাচমারী সাতপুরা পর্বতের রানী বলে মনে করা হয়। অনেকেই একে মধ্যভারতের কাশ্মীর বলে অভিহিত করেছেন। এই পাচমারীতে দুচোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো অনেক স্পট পাবেন তবে আপনাকে নিম্নে বর্ণিত স্পটগুলিতে যেতে গেলে এন্ট্রি ফিজ জমা দিয়ে সাতপুরা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে পারমিশন করাতে হবে।
 হান্ডি পয়েন্ট বা হাণ্ডি খোঃ
পাচমারীর সবথেকে কাছে এই ৩০০ ফুটের বেশী গভীরতা বিশিষ্ট এই সংকীর্ণ গলির ন্যায় গহন জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া স্থান গিরিখাতের মতো বিরাজমান।এটি প্রাথমিক পর্যায়ে হ্রদ ছিল বলে শোনা যায়। এই স্থানের পুরান কথিত বর্ণনা পাওয়া যায়। পুরাকালে এখানে এক দৈত্য ক্ষতিকর বিষধর সাপ হয়ে এই হ্রদকে পাহারা দিত। ভগবান শিব সেই সাপকে হত্যা করেন এবং তাঁদের যুদ্ধের প্রাবল্যে হ্রদের জল শুকিয়ে গিয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছায়এর নিচে সাধারণত স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা জীবনকে বাজি রেখে জীবিকার তাগিদে মধু সংগ্রহ করতে যায়।
প্রিয়দর্শিনীঃ
পাচমারীর প্রধান শহর থেকে প্রায় কিমি থেকে এই স্থান অপূর্ব মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঢাকা ক্যাপ্টেন জে. ফরসিথ এর নামানুসারে ফরসিথ পয়েন্ট নামে জানা থাকলেও স্থানীয় লোকজন একে প্রিয়দর্শিনী নামেই বলে থাকে। এখান থেকেই চৌরাঘর মহাদেব পর্বতের উপরে স্থিত মহাদেব মন্দির সবুজ উপত্যকা দেখার পাশাপাশি সূর্যাস্তের সময় এখান থেকে ভালো দেখতে পাওয়া যায়। জঙ্গলের মধ্যে এখানে আপনি গলাটা ভিজিয়ে নিতে পারেন স্থানীয় নিম্বু পানি সেন্টারে।
গুপ্ত মহাদেবঃ
পুরাকালে ভস্মাসুর নামে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী অসুর তার তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করায় দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে অমরত্ব বর মাগে। কিন্তু মহাদেব সেই বর দিতে নারাজ হলে, অসুর বলেন তাহলে আমাকে এই বর দিন যাতে আমি যার মাথায় হাত দেবো, তৎক্ষণাৎ সে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আপনভোলা মহাদেব তথাস্তু বলে চলে যাচ্ছেন। এমত সময় অসুর ডাক দিল প্রভু দাঁড়াও, তুমি আমায় যে বর দিলে তা ঠিকঠাক কাজ করে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখব তোমার মাথায় হাত রেখে। সেই কথা শোনামাত্র, ভগবান শিব দৌড়াতে দৌড়াতে এসে একটি সংকীর্ণ গুহার মধ্যে লুকান। তাই এই মহাদেবের নাম গুপ্ত মহাদেব। গুহার বেশ কিছুটা অংশ হেঁট হয়ে হেলে এঁকে বেঁকে এগোলে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলে তবে গুপ্ত মহাদেবের দর্শন মেলে। একসাথে জনের বেশী প্রবেশ করা যায় না। যাইহোক গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা পথ হেঁটে গুপ্ত মহাদেবে যেতে হয়। এখানে আপনি রামকন্দমুল পেতে পারেন যেটা খেয়ে নাকি ত্রেতাযুগে ভগবান রামচন্দ্র ১৪ বৎসর বনবাসকালে দিন অতিবাহিত করতেন। এর দাম টা একটু বেশি, কারন আদিবাসী লোকজন বনের গভীর থেকে ঝুঁকি নিয়ে তুলে আনেন। স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন।   
বড় মহাদেবঃ
গুপ্ত মহাদেব থেকে বেরিয়ে বাম দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন বড় মহাদেবের মন্দির। যখন মহাদেব গুপ্ত হয়ে আছেন তাঁকে প্রকট করার জন্য দেবকুল চিন্তা করেন এবং স্বয়ং নারায়ন এই সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসেন। তিনি অপূর্ব সুন্দরী রমণীর বেশ ধারন করে ভস্মাসুরের সামনে আসলে তার রূপে মোহিত হয়ে অসুর রমণীরূপী নারায়ন কে বিয়ে করতে চান। তখন নৃত্যরতা নারায়ন এই স্থানে এসে তাঁকে বললেন যে আমি যেমনভাবে নৃত্য করবো সেইভাবে তোমাকে নাচতে হবে। অসুর রাজি হয়ে গেল। নারায়ন নাচতে নাচতে নিজের হাত নিজের মাথায় রেখে নাচতে থাকে। তা দেখে অসুর সবকিছু ভুলে রমণীর ন্যায় নিজের হাত নিজের মাথায় রাখার সাথে সাথে ভস্ম হয়ে গেলে গুপ্ত মহাদেব প্রকট হয়ে এইস্থানে অবস্থান করেন। সেই থেকে এখানে মহাদেবের অবস্থান, কিছুটা দূরে পার্বতী দেবীর মন্দিরের অবস্থান। প্রতি বৎসর শিবরাত্রিতে প্রচুর ভক্তসমাগমে ধুমধাম করে শিবপূজা করা হয়। পাচমারীতে গেলে অবশ্যই এখানে ঘুরে আসবেন। সাম্প্রতিককালে একটা ঘটনা সবার নজর কেড়েছে যে, ভারতবর্ষের যে যে রাজনীতিবিদ এখানে পূজা দিতে এসেছে তারা আর নির্বাচনী লড়াইয়ে জয়লাভ করতে পারেন নি।    

জটাশঙ্করঃ
পাচমারী ক্যান্টনমেন্ট এর একেবারে পিছনে ভগবান শিবের এই আধ্ম্যাত্মিক ক্ষেত্র বর্তমান। কথিত আছে যে, ভস্মাসুরের ভয়ে শিব এখানেও বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন। পাললিক শিলাস্তরের মাঝে অর্থাৎ বেলেপাথর কংগ্লোমারেট এর মাঝে চুনাপাথরের স্ট্যালাগমাইট এর প্রাকৃতিক শিবলিঙ্গ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানকার পাহাড়ের গঠন অনেকটা শতমাথা বিশিষ্ট শেষনাগের ফণার ন্যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিলারাজি দেখতে অনেকটা শিবের জটার ন্যায় দেখতে। শিবের পাশাপাশি দেবী পার্বতীও ভক্ত কর্তৃক পূজিত হয় এখানে। তাই এই স্থানের নাম জটাশঙ্কর। পাচমারীর এই স্থান পর্যটক টানতে ভালো ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
পান্ডব গুহাঃ
পাচমারী শহর থেকে কয়েক কিমি গেলেই সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং। সেখান থেকে কিছুটা দূরে গেলেই স্থানের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র পাণ্ডব গুহা। কথিত আছে যে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ মহাভারতের সময়কালে পাশা খেলায় হারার পরে পাণ্ডবরা পাঁচ ভাই ১২ বছর বনবাসকালে এই স্থানে বেলেপাথরের পাঁচটি গুহা নির্মাণ করে বেশ কিছু বছর বসবাস করেন। স্থানীয় ভাষায় পাচমারী কথার অর্থ পাঁচটি গুহা। পৌরাণিক ব্যাখ্যা যাই হোক, এই স্থান কিন্তু দারুন মনোরম পরিবেশ গুহার সামনের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ফুলের বাগান আলাদা সৌন্দর্য বর্ধন করছে। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক বিভাগ ভূতাত্ত্বিক বিভাগ গবেষণা করে দেখেন যে, গুহা সন্নিহিত শিলা পরীক্ষা করে দেখেন যে এই শিলার বয়স মহাভারতের সমসাময়িক নহে। বরং গুহার আকার বা গুহা মধ্যস্থ চিত্রকলা বৌদ্ধসংস্কৃতিকে তুলে ধরছে। হিন্দু বা বৌদ্ধ সংস্কৃতি যাই হোক না কেন এই গুহা বা গুহার মাথায় উঠলে পাচমারী শহরের একটা অভূতপূর্ব  প্যানোরামিক ভিউ পাবেন। গুহা গুলির দরজা করে বন্ধ রাখা থাকে, কারন পর্যটকরা অনেকেই গুহার দেওয়ালে নিজের নাম খোদাই করে দিয়ে গুহার পুরাতাত্ত্বিক মাধুর্য নষ্ট করছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ এখানে এলে কিছুক্ষনের জন্য ভাব জাগে, আবেগপ্রবন হয়ে পড়েন। পাচমারী শহরের নামকরণ যার কারনে সেই স্থানে না ঘুরে এলে পাচমারী ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাই একবার সময় করে ঘুরে আসতে হবে। 
বাইসন লজ মিউজিয়ামঃ
পাণ্ডব গুহা থেকে বেরিয়ে সোজা বাইসন লজ মিউজিয়ামে চলে যান। সেখানে এই সাতপুরা পর্বতের মহারানী পাচমারীর জীববিচিত্র নিয়ে এক অসাধারন সংগ্রহশালা পেয়ে যাবেন। বোটানি জুলজি নিয়ে যারা পড়াশোনা করে তাঁরা এখানে এলে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ১৮৬২ সালে যখন ক্যাপ্টেন জে. ফরসিথ পাচমারী আবিস্কার করেন তার ঠিক পরে পরেই এই বাইসন লজ তৈরি করেন। এখানকার আদিবাসীরা বাইসনকে দেবতার মতো পূজা করে থাকে। এই পাচমারীর জঙ্গলে প্রচুর বাইসন রয়েছে। এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের কারনে মধ্যপ্রদেশের সরকারী বাসভবনসহ রাজধানী ছিল। বর্তমানে আপনি এই চত্বরে রাজভবনও লক্ষ্য করা যায়। শহরের প্রাচীন গির্জার অবস্থানও এখানে।   
প্যারাস্লাইডিং
বাইসন লজ মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং থেকে সোজা পশ্চিম দিকে গেলে ঘন বনভুমির মাঝে অনেকটা জায়গা বন কেটে বিভিন্ন রাইডিং এর ব্যবস্থা আছে। একটু পকেটে টান পরলেও আপনি প্যারাস্যুট, রোপওয়ে, বাইকিং করার এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি।
যমুনাপ্রপাত বা  বি-ফলঃ
পাচমারীর সবুজে মোড়া গ্রীন ভ্যালি পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে অনাবিল আনন্দে অবিরাম কলকল ধ্বনিতে গুনগুনিয়ে গান শুনিয়ে চলেছে নর্মদার কিছু জলধারা বা জলপ্রপাত। তেমনি আপনি যদি আর একটু জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যান তাহলে দেখতে পাবেন এই জলধারা এবং আরও একটু এগিয়ে গেলে উপর থেকে দেখতে পাওয়া যাবে এই মনোরম জলপ্রপাতের আপাদমস্তক ছবি। যদিও এই ভিউপয়েন্ট সুইসাইড পয়েন্ট এর মতো বিপজ্জনক বটে। ডানদিকে এগিয়ে গেলে প্রায় ৪৩২ টি সিঁড়ি পেরিয়ে নেমে গেলে জনপ্রিয় ৩৮ মিটার উচ্চতার বি-ফলস এর একেবারে পাদদেশে যাওয়া যায়। একটু কষ্টসাপেক্ষ হলেও উপভোগ্য। এখানে পর্যটকরা স্নান করে পুন্য অর্জন করেন। শোনা যায়, এখানে মৌমাছির প্রাধান্য থাকায় এই জলপ্রপাতের এরুপ নামকরণ। পূর্বে এই জলপ্রপাতের নাম ছিল যমুনা প্রপাত। এখান থেকে পাচমারীর বিস্তীর্ণ এলাকার পানীয় জল সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যাইহোক, বাঙ্গালীদের কাছে এখানকার মধুর স্বাদ সুন্দরবনের মধু থেকে পৃথক স্বাদ প্রদান করে থাকে। আপনারাও মধু সংগ্রহ করতে ভুলবেন না।
ধুপগড়ঃ
চলুন এবার যাওয়া যাক সাতপুরা রেঞ্জের পাচমারী পর্বতের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গে। ধুপগড় সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ১৩৫২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে পুরো পাচমারী শহরসহ জঙ্গল পাহাড়সমূহ খুব সুন্দরভাবে দেখতে পাওয়া যায়। কথিত আছে মধ্যভারতের এই স্থানে সবথেকে বেশী সময় ধরে সূর্যালোক (ধূপ) পতিত হয়। এই স্থান (গড়) থেকে খুব সুন্দর পর্যবেক্ষণ করা যায় বলে এর এরূপ নামকরণ। আপনি সাত সকালে বা বিকালের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে চলে যান যথাক্রমে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখার জন্য।
একটি পয়েন্ট একেবারে পূর্বদিকে তো সানসেট পয়েন্ট একেবারে পশ্চিমদিকে। স্থানে একটি ছোট মিউজিয়াম আছে। পথে যাওয়ার সময় আপনি সাতপুরা রেঞ্জের একটা চোখ জুড়ানো ব্রড ভিউ পাবেন। আপনাকে মনে রাখতে হবে সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথেই গাড়িতে উঠে সোজা স্থান ত্যাগ করতে হবে নিরাপত্তার কারনে। কারন অন্ধকার নামলে বাইসন সহ বিভিন্ন বন্য জানোয়াররা বেরিয়ে পড়ে।
    

জব্বলপুরঃ
পরেরদিন সকালে উঠেই আবার পিপারিয়া স্টেশনে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেসের চেয়ারকারে জব্বলপুরে পৌঁছে গেলাম পড়ন্ত বিকালে। এই জব্বলপুরে বেশ কিছু স্পট আছে যা আপনাকে মুগ্ধ করবেই করবে। বিশেষ করে ভেরাঘাটের জলপ্রপাত মার্বেল রকস। আজ তো এলাম সবে। আজ একটু রেস্ট নিয়ে পরের দিন সকাল সকাল গাড়ি ছুটিয়ে চলে গেলাম।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment

জগতের ধর্মগুরু লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র

  লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র   গল্পের নায়ক যেখানে কৃষ্ণ সেখানে বলে রাখা ভালো আধ্যাত্মিক নয়ন না থাকলেও যদি কেউ তাঁর বিবেক ...