প্রসঙ্গঃ দেবী সরস্বতীর বিবাহ ও বর্তমান মানবজাতির ভাবধারা
-অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
আজকাল আসল আলোচনা ছেড়ে মানুষ উদ্ভট সব মন্তব্য করছে। আজকাল
দুদিন বেশ মজাদার পোষ্ট পেলাম পিতার সাথে কন্যার বিবাহ। এর আগের আলোচনাই বলে
দিয়েছি এই সরস্বতী আসলে কে? তাঁর তাৎপর্য কি? সেটা পড়তে হবে নইলে আজকের আলোচনা নাও
বুঝতে পারেন। তবে পাঠকের কাছে একটা অনুরোধ, শেষ পর্যন্ত পড়ুন। যাইহোক, এখন প্রশ্ন
হল, দেবী সরস্বতী বিবাহিত কি না? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাদের
জানা প্রয়োজন যে সরস্বতী কত রূপে বিরাজমান? তার আগে বলা
ভালো, আমাদের জ্ঞান আর ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা এতটাই
ক্ষীন যে তাঁদের এই অনন্ত কালের অনন্ত কার্যকলাপ বোঝা বা বোঝানোর শক্তিতে কুলায়
না। ব্যাখ্যা আর অপব্যাখ্যা হাজার হাজার বছরের চলে আসা তথ্য ও তত্ত্বকে আলাদা
মাত্রা প্রদান করেছে। নিগুঢ় সত্যকে কালের অন্ধকারে তাকে মিথ্যা আর অলীক কল্পনার
বেড়াজালে আটকে দিয়েছে। সমালোচনা আর প্রত্যাখান করতে গেলে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে হয়।
তা না করে আমরা আজ বিজ্ঞানের দিশারীরা সব জান্তা হয়ে এমন ভান করি যেন লক্ষ কোটি
বছরের বয়ে আনা সবকিছু ভ্রান্ত। তাই আমাদের আলোচনায় যে সরস্বতী দেবীকে নিয়ে তিনি
সবসময় নারী বা রক্তমাংসের দেহ ভাবলে চলবে না। তিনি কখনো জ্ঞান, কখনো বিদ্যা, বুদ্ধি, আবার তিনি সঙ্গীতের
আধার, সংস্কৃতির ধারক বাহক, ধ্যান ও
আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশক। কলা ও বিজ্ঞান জ্ঞানের প্রতীক। তাই অন্যভাবে নেবেন না।
যাইহোক, আমরা আগেই বলেছি যে দেবী সরস্বতীকে
হিমালয়কন্যা পার্বতীর কন্যা ও লক্ষ্মী-কার্তিক-গণেশের সহোদরা ভগ্নীরূপে দেখি, সেটা নিতান্তই বাঙালিদের ঘরোয়া মনগড়া
গল্প, এর পিছনে কোন শাস্ত্রীয় অনুমোদন নেই। সরস্বতী সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার সহধর্মিণী
এবং বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে
পরিচিতা। সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদসমূহের প্রসূতি। আর আমরা সাধারণত
যে দেবী সরস্বতীকে জানি তিনি চতুর্ভুজা, শ্বেত
বস্ত্রাবৃত,শ্বেত পদ্মাসনা, যা পরম সত্যের প্রকাশক। ইনি ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্মান। কিন্তু অনন্যসাধারণ
সৌন্দর্যের অধিকারিণী এই দেবীকে দর্শনমাত্রই ব্রহ্মা তাঁর রূপে মোহিত হন ও তাঁকে
বিবাহ করেন। স্বল্পালংকারা এই দেবী ত্রিভুবনের জ্ঞানদাত্রী। তাঁর চার হাত মন, বুদ্ধি, সচেতনতা ও অহমের দ্যোতক। অন্যভাবে বলা
যায় তাঁর চার হাত চার বেদের প্রকাশক। এখানে বেদ বলতে তিন প্রকার সাহিত্য- গদ্য ও সঙ্গীতকে বোঝানো হয়েছে। তাই তাঁর হাতের পুস্তক) বোঝানো হয়েছে। তাই তাঁর হাতের পুস্তক (পবিত্র বেদ)- বিশ্বজনীন, স্বর্গীয় ও পরমসত্যের আধার। অক্ষসূত্রের
মালা- ধ্যান ও আধ্যাত্মিক শক্তির প্রকাশক। কাঁখে পবিত্র জলের ঘট- সৃষ্টি ও পবিত্র শক্তির প্রতীক। আর বীণা- কলা ও বিজ্ঞান জ্ঞানের প্রতীক।
এসকল আলোচনা সব পূর্বেই করা হয়েছে, কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে
দারুন আলোচ্য হয়ে উঠল দেবী সরস্বতীর বিবাহ। কথা হল, ব্রহ্মা সরস্বতীর পিতা, তিনিই
আবার কিরুপে দেবীকে বিবাহ করে নিজের কামনা নিবৃত্ত করেন? আচ্ছা, এমন কাণ্ড ঘটানো
উচিত হয়েছে? এবার ব্যাখ্যা হল, আপনি এই বিষয় নিয়ে এত কৌতূহলী কেন? আপনি শাস্ত্রের
অনেক কথা শুনলেও তা বিশ্বাস করেন নি নিজের বিজ্ঞান চেতনায়। আপনার আধুনিক শিক্ষায়
আপনি হাজার হাজার বছরের সব তথ্য ও ত্তত্বকে মাটিতে মিশিয়ে দেন মুহূর্তের
বিড়ম্বনায়। আমি যদি ধরে নিই, পিতা ব্রহ্মা কন্যা সরস্বতীকে বিবাহ করেছিলেন,
সেখানেও একটা প্রশ্ন, এই সক্রান্ত যত তথ্য পাওয়া যায় স্কন্দ পুরান, শিব পুরান,
মার্কণ্ডেয় পুরান, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, কালিকা পুরান, ঋগ্বেদ সহ বিভিন্ন শাস্ত্র
কি আপনি কোনদিন ঘেঁটে দেখেছেন? হয়তো অনেকেই জানেন না আমাদের এই এত পুরান আছে।
আপনাদের কাছে একটা প্রশ্ন, মহাভারতের কেন ১৮ টা পর্ব? কেন মহাভারতের যুদ্ধ ১৮ দিবস
হয়েছিল? কেন আমাদের এই দেহ ১৮ মোকামে বিভক্ত? কেন মহাভারতের যুদ্ধে ১৮ অক্ষৌহিণী
সেনার মৃত্যু ঘটে? শ্রীমদভাগবদগীতার কেন ১৮ তা অধ্যায়? কেন আমাদের মোট পুরান
সংখ্যা ১৮ টি? কেন জপের মালায় মোট ১০৮ টি পুঁথি থাকে? আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন এর
থেকে বেশী বা কম কোথাও আলোচনায় নাই। এহেন অন্ধ জীবের সাধ্য নাই এই প্রশ্নের উত্তর
দেওয়ার। কিন্তু সাহস ধরবে, শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা করে তার অবমুল্যায়ন আর ভুল বার্তা
প্রদান করা। এতে নাকি তারা আধুনিক ও বিজ্ঞান চেতনার মানুষ হিসাবে তকমা পেয়ে থাকে!!
হায় রে মূর্খ মানুষ!! সরস্বতীর এত গুন নিয়ে আলোচনার সময়
পেলেন না, শুধু যে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আপনাদের নেই তাই নিয়ে পড়ে আছেন। আপনার
জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, ব্রহ্মাকে সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণুকে পালনকর্তা আর মহেশ্বরকে
সংহারকর্তা বলে মনে করা হয়। তা ব্রহ্মা যদি সৃষ্টিকর্তা হয়, তাহলে তিনি সবাইকে
সৃষ্টি করেছেন এটাই ধরতে হয়। তাঁর সৃষ্টিকেই তাঁর কাছে সমর্পণ করা ছাড়া উপায়
কোথায়? এই সংক্রান্ত যত তথ্য উপরক্ত পুরান গুলিতে পাওয়া যায়, তা একে অপরের সাথে
মেলে না। সকল ক্ষেত্রে সঠিক ব্যাখ্যা পূর্ণমাত্রা প্রদান করে থাকে। হাজার হাজার
বছর ধরে যে অজাচার চলে এল তা হটাত আজকের পণ্ডিতদের কাছে ম্লান হয়ে গেল!! সবার
জীবনে সাদা কালো দিক থাকে। আমাদের স্বভাবে আমরা সাদা দিক ভুলে কালোটাই নিয়ে পড়ে
থাকি। এতে আমাদের কৌতূহল বেশী। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে সরস্বতী কোন মাতৃযোনিতে
জন্মায় নি। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার ইচ্ছেতেই জন্ম। আবার ক্ষেত্র বিশেষে তিনি আবার
মানবী না হয়ে নদী রূপে আলোচনায় এসেছে।
দেবী সরস্বতী কে পূজা করলেই যেমন কেউ বিদ্বান হয়ে যায় না,
তেমনি তাঁকে অস্বীকার করে নিজের জ্ঞানের সীমা নিয়ে ঢাক পেটানো হয় না। আপনি আজকের
দিনে বসে দেবীর মুল্যায়ন করছেন। বৈদিক যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সামজিক নিয়ম ছিল,
তা বর্তমানে আর নাই। আপনি জানেন কুন্তী কুমারী সন্তানের জন্ম দিয়েও পাঁচজন সতীর
তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। মহাভারতের সত্যবতী পরাশরের কবলে পড়ে কুমারী বয়সে ধরা
দিয়ে যে সন্তান জন্ম দেন তিনি আর কেউ না, সকল শাস্ত্রের জনক শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন
বেদব্যাস। আপনাদের কাছে যে বেশ্যাপুত্র সম! বংশরক্ষার কারনে রানী সত্যবতী বেদব্যাস
কে নির্দেশ দিয়েছিলেন নিজের ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদনের। কারন তখন সেই সংযম
লক্ষ্য করা গেছে, মানুষ ছিল অধিকতর ধর্মপ্রাণ। আপনি কি জানেন, কোনারকের সূর্য
মন্দির বা খাজুরাহোর মন্দির গাত্রে বাৎস্যায়নের কামসুত্র কেন খোদিত? অধিকাংশ যুবা
যখন ব্রহ্মচর্য পালনের পরে গার্হস্থ্য জীবনে না এসে সন্ন্যাস বা ধর্মক্ষেত্রে
আশ্রয় নিচ্ছিল। তখন তারা যদি এই কামসুত্রের প্রতিটা চিত্র ঘুরতে ফিরতে দেখতে পায়,
যদি তা দেখে তাঁদের মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, যদি তারা বাসনায় সংসার জীবন পাতে
এই প্রত্যাশায়। আপনাদের কাজ হল, এগুলি নিয়ে অন্য ব্যাখ্যা করা।
আপনার ক্ষমতা আছে সূর্যদেবকে গ্রহণ
করার যেটা কুন্তী দীর্ঘ সাধনায় পেরেছিলেন। আপনি পারবেন শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস
এর তেজ সহ্য করতে? আপনি তো দূর ছাই, রানী অম্বিকা বা অম্বালিকা কেউ পারে নি তাই
তাঁদের দুটি সন্তান যথাক্রমে অন্ধ ও পাণ্ডুর হয়ে জন্মেছিল। এত সহজ নয়। আপনি
কৃষ্ণের ষোল হাজার গোপিনী নিয়ে লীলা করতে দেখেছেন। আপনি কি দেখেন নি, কৃষ্ণ একা
হাতে কালীয়ের ন্যায় ভয়াল বিষাক্ত নাগকে দমন করেছিল, শিশু বয়সে পূতনা ও কংস বধ
করেছিল। কনিষ্ঠ আঙ্গুলে গিরি ধারন করেছিল। আমার কাছে প্রমান আছে এইসব লীলা কৃষ্ণ
বৃন্দাবনে করেছিলেন আর এই বৃন্দাবন ত্যাগ করে কৃষ্ণ মথুরা ও দ্বারকায় চলে যায়
প্রায় ১১ বছর বয়সে। তারপর তিনি ১২৫ বছর বেঁচে ছিলেন আর বৃন্দাবনে আসেন নি। ঐ কিশোর
বয়সে কোন কামের গন্ধ পান নাকি। অবশ্য এখনকার সময়ে বসে আপনার ভাবনায় তা আসতে
পারে। আপনার তো ঠিক এই জায়গা গুলো বিশ্বাস
করেন না। আপনাদের যা অবস্থা, তাতে আপনারা হাজারদুয়ারী বিশ্বাস করেন, কিন্তু সেখানে
রাখা সিরাজউদদউলার অন্তর্বাস দেখে হাঁ হয়ে যান। এত বড় কারোর দেহ থাকতে পারে নাকি?
এটাই হল বাস্তব অবস্থা। কিছুদিন পর তাজমহল আছে বিশ্বাস হবে, কিন্তু ওটা সম্রাট
শাহজাহান তৈরি করেছেন সেটা মানবেন না হয়তো!! সময়ের সাথে ঘটনার পরম্পরা।
আপনি বিশ্বাস করেন আর না করেন, এসবের
মাহাত্ম্য বর্তমান। আপনি দেখতে পান না, মানে অন্ধকার তা তো নয়। সেথায় আলো থাকতে
পারে, আপনার দৃশ্য পৌঁছায় না সেটা আপনার দুর্বলতা। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এত
গবেষণা করে আজ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে আমরা কত মহাশূন্য আর এক্সপ্লোর করবো এতো
অসীম। তারা কবি নজরুলের ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে’ তথ্যে সিলমোহর
দিয়েছেন। আপনি তো নামমাত্র মানুষ। আপনার কাছে শেষপ্রশ্ন- ছাগলের বাচ্চা ছাগল হয়,
গরুর বাচ্চা গরু হয়, কুকুরের বাচ্চা কুকুরের বাচ্চা কুকুর হলে মানুষের বাচ্চা কেন
মানুষ হয় না? তাঁকে কেন আপনি বলেন আমার ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে। কেন বলেন স্যার
ওকে দিয়ে গেলাম মানুষের মত মানুষ করবেন? কেন বলেন গুরুদেব ওকে আশীর্বাদ করুন যেন ও
মানুষ হয়ে ওঠে? ভাবুন, জানুন, উত্তর দিন। আপনি মনে রাখবেন আপনার জন্মের আগে
প্রকৃতির নিয়মে আপনার মায়ের বক্ষে খাবার চলে আসে। এর ব্যাখ্যা আছে নাকি আপনার
কাছে? ফকির লালন শাহ খুব ভালো বলেছেন- হাল গেল পাল গেল নাঙল গেল মাঠে/বলদ
রইল গাভীর পেটে/জল খাবার যায় মাঠে রে।। এর ব্যাখ্যা তৈরি করে নাহয় দেবী
সরস্বতী আর ব্রহ্মার বিবাহ তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আপনি ততক্ষণ
লালন শাহের গানের লাইনের অর্থ উদ্ধার করুন, না পারলে গুরু ধরুন। আপনার সামর্থ্য
নিয়ে আপনি সচেতন হোন।
আমি
কি দেখিলাম মরা নদীর চরে...
একটা
সর্পের মাথাই ব্যাঙের নৃত্য
ময়ূর
কেমন নাচেরে....।।
কি
দেখিলাম মরা নদীর চরে।
বাপে
আমায় দেইনি জন্ম
জন্ম
দিল পরে।
আমার
যখন হইল জন্ম মা ছিলনা ঘরে রে।।
কি
দেখিলাম মরা নদীর চরে।
হাল
গেল পাল গেল নাঙল গেল মাঠে
বলদ
রইল গাভীর পেটে
জল
খাবার যায় মাঠে রে।।
কি
দেখিলাম মরা নদীর চরে।
হাল
গেল পাল গেল নাঙল গেল বটে
কৃষাণ
ভাই আর নাই জন্ম-
জল
খাবার যায় মাঠে রে।।
কি
দেখিলাম মরা নদীর চরে।
© অধ্যাপক সনৎকুমার
পুরকাইত (উপরের সঙ্গীত ছাড়া)
No comments:
Post a Comment