[১]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – এক
© অধ্যাপক
সনৎকুমার পুরকাইত
স্থান
কলকাতার আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত সকল মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ইকোপার্ক।
প্রাণচঞ্চল তিলোত্তমা মহানগরী কলকাতার
কোলাহল কাটিয়ে এই ইকোপার্ক ব্যস্ত জীবনের একটু হাঁফ ছেড়ে প্রাণভরে মুক্ত অমলিন
বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার ঠিকানা। যাইহোক, আসল কথায় আসা যাক। এহেন ইকোপার্কে সুকন্যা ম্যাডাম দাম্পত্যসুখে হাসিতে লুটোপাটি খাচ্ছিল। সুকন্যা, সুকন্যা দত্তগুপ্ত কলকাতার বনেদি পরিবারের মেয়ে। পড়াশুনায় ভালো।
চাকরীও জুটিয়েছে। মফস্বলের একটি কলেজের অধ্যাপিকা। বিয়ে হয়েছে রাজারহাটের সুমন বিশ্বাসের সাথে। সুমন পেশায়
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কর্মস্থল সল্টলেক সেক্টর ফাইভ। সুখের অন্ত্য নাই। যাইহোক,
সপ্তাহের মাঝে কোন এক কর্মব্যস্ত দিনের পড়ন্ত বিকেলে সুকন্যা ও সুমনকে দেখা গেল
ইকোপার্কের এক বসার বেঞ্চে। আড়চোখে দেখে সবাই ভাবছিল ওই বুঝি সর্বসুখী। কিন্তু এত সুখের মাঝেও অন্তরে চাপা টেনশন কাজ করছিল সুকন্যার। কারন, কলেজে
নতুন জয়েন করার পর থেকে এ পর্যন্ত ওর আর্লি ডিপারচার নিয়ে পরপর চারটে মিটিং এ এজেন্ডা ছিল। সুকন্যা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রোজ দুটোর আগে কলেজ পালিয়ে যায়। বিষয়টা নিয়ে সবাই বিরক্ত। সেবার তো ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালকে লিখিত জমা
দিল। প্রতিবার মুখ পুড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে মিটিং শেষে বেরোতে হয়। ওখান থেকে বেরোলেই আবার
যে কে সেই। এই হল সুখের নমুনা। নিজের সুখের কারনে প্রতিদিন শত সহস্র
ছাত্রছাত্রীদেরকে বঞ্চিত করে বিনা অনুশোচনায় স্থানত্যাগ করেন। আর অপরদিকে কমলিনী
ম্যাডাম সাড়ে চারটের ক্লাসটা নিতে গিয়ে রোজ শ্বাশুড়িমাতার কাছে কথা শুনতে হয়। আর
বুঝি কেউ কলেজে চাকরী করে না। তোমার এত দেরি হয় কেন? কমলিনী বোঝাতে গিয়ে বারবার
ব্যর্থ মনোরথে প্রত্যাবর্তন করেন। তাতে কি তাঁর সুখ তো হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে
নিয়ে। সবাই কমলিনী ম্যাডাম বলতে পাগলপারা। তাঁর হৃদয় সুখের আতিশয্যে ভেসে যায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও
সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি
প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[২]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – দুই
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
শশাঙ্কের
জীবনে চল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে গেল এ বছর। অনেক লড়াই করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কোম্পানিতে টপমোস্ট পজিশনে এখন শশাঙ্ক রায়মণ্ডল। ব্যস্ততা কমেছে, কিন্তু দায়িত্ব
বেড়েছে। সমাপ্তি আর পাঁচ বছরের শিশু সূচনাকে নিয়ে ছোট তাঁর ছোট্ট পরিবার। বেশ সুখে
কাটছিল দিন। বেশ কয়েকমাস ধরে শশাঙ্ক দেরি করে ফিরছে। মদ্যপান করেও আসছে মাঝে মাঝে।
সমাপ্তি কিছু জিজ্ঞাসা করলেই প্রচণ্ড রেগে যাচ্ছেন। শশাঙ্ক এখন তাঁর আপিসের বস। আপিসের বস তাঁর জুনিয়র মহিলা স্টাফকে লিফ্ট দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বাড়িতে যতই অশান্তি হোক না কেন আপিসের স্টাফদের সাথে কোন খারাপ প্রভাব পড়ে
না। এ হেন জুনিয়র মহিলা স্টাফকে নিয়ে সকাল বিকাল নতুন করে স্বপ্ন দেখেন। একদিন
সূচনা আব্দার করে বাবাকে বলেছিল, ‘ও বাবা, আজ তুমি আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে চল।
সবাইয়ের বাবা তো আসে বলো। তুমি চল। বাবা শশাঙ্ক পেপারে মুখ গুঁজে বসে শুনতে শুনতে হটাত
চিৎকার করে বলে উঠলেন আমার যাওয়ার সময় নেই। তুমি তোমার মায়ের সাথে যাও’। বাবার
চিৎকার শুনে বাবাকে সেদিন নতুন করে চিনেছিল পাঁচ বছরের সরল শিশুকন্যা সূচনা। এমন
সময়, মেয়ের স্কুল ডন বস্কে পরীক্ষা শুরু হল। বাংলা পরীক্ষায় পরিবার নিয়ে রচনা এসেছিল। সর্বসুখী বসের মেয়ে রচনা লিখল... পরিবার নিয়েই
রচনা লিখেছিল একেবারে প্রাঞ্জল ভাষায়। সে লিখেছিল 'আমাদের পরিবার খুব বাজে। আমার বাবা আমাকে একদিনও স্কুলে দিতে আসে না। আমাকে বকে দেয়। মাকেও মারতে যায়।'.....ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলার ম্যাডাম তাঁর এই রচনা
পড়ে প্রিন্সিপালের নজরে আনেন এবং মেয়েটির কাউন্সেলিং দরকার বা তার বাবা মায়ের সাথে
কথা বলা দরকার। সেইমতো সবকিছু এগোল। শশাঙ্ক যথারীতি ম্যাডামকে দুটো বাজে কথা
শুনিয়ে দিল। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ।তবুও বস লিফ্ট দিতে ফেল করে না। এখানেই সুখের উৎস ভিন্ন হলেও সুখ তাঁর মতো করে খুঁজে নিয়েছিল শশাঙ্ক। তারপর
এক ছুটির দিন ছোট্ট মেয়ে কচি কচি আঙ্গুলগুলি স্পর্শ করলো শশাঙ্কের হাতের উপর।
‘বাবা, আজ আমরা একসাথে খাবো। অনেকদিন তোমার সাথে খাওয়া হয় নি। এসো না। এসো। আমি আজ
তোমাকে খাইয়ে দেবো’। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সকলের অজান্তে চোখটা বারেবারে মুছে
নিচ্ছিল সমাপ্তি। শশাঙ্কের চোখের কোনা বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। জড়িয়ে ধরল
শশাঙ্ক, দুহাত এগিয়ে ফুলের মতো সূচনাকে জড়িয়ে ধরল নিজের বুকের মাঝে। এখন আর শশাঙ্ক
সুখ খুঁজতে জুনিয়র স্টাফকে লিফট দিতে ছোটে না। মেয়েকে সময় দেয়। সমাপ্তির সাথে পালা
করে মেয়েকে স্কুলে দিতে যায় শশাঙ্ক। আনন্দে ভরে ওঠে জীবন। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও
সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি
প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[৩]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – তিন
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
২৫ শে
সেপ্টেম্বর, ২০১৬। ছুটির দিন। রোববার। ভেবেছিলাম একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠব।
কিন্তু আজ ভোরবেলা হটাত করে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরের কিছু একটা গুঞ্জন কানে আসছে।
জানালার পর্দাটা সরাতে দেখলাম ভোর না সকাল হতে চলেছে। সামনের তিনতলা মজুমদার ভিলার
সামনে প্রচুর লোকসমাগম। কিছু সাদা পোশাকের কলকাতা পুলিশের সিপাইকে দেখা যাচ্ছে।
সবাই একে অপরের সাথে নিজেদের মধ্যে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। আমিও কৌতূহল নিয়ে
তরতর করে নেমে গেলাম। ব্যাপারটা কি জানতে। সিঁড়িতে বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের লোকটির
সাথে দেখা হতেই কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ওই বলতে শুরু করল। জানো দাবাবু, সামনের
বাড়ির সেই মজুমদার বুড়িমা কবে মরেছে তা কে জানে।
পচে গন্ধ বেরোচ্ছে। তাই নিয়ে হুলুস্থুল চলছে নিচে। পুলিশ এয়েছে, তুমি আবার
এসবের মাঝে জড়িয়ো না বাপু। যাইহোক, আসল কথায় আসা যাক, সামনের বাড়ি মানে ঐ মজুমদার
ভিলার একমাত্র বাসিন্দা ছিলেন নবতিপর তিলোত্তমা মজুমদার। একসময় তিলোত্তমা দেবীর
ভরা সংসার ছিল। অনীক মজুমদার মানে তিলোত্তমা দেবীর স্বামী মারা গেছেন আজ প্রায় বছর
পনের হল। তবে মারা যাওয়ার আগে দুই ছেলে ও এক মেয়ে সবাইকে ভাল জায়গায় পৌঁছে দিয়ে
গেছেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী অনীক বাবুর প্রচুর সম্পত্তি থাকলেও ছেলেরা তাঁর
ব্যবসায় কোনদিন আকৃষ্ট হয় নি। তাই মিঃ মজুমদার পড়াশুনার সাথে সাথে তাদেরকে বিদেশে
চাকরী বা ব্যবসা কোনটাতেই না করেন নি। প্রত্যাশা ছিল যে একদিন কেউ না কেউ তাঁর
ব্যবসার হাল ধরবে। না কেউ ধরে নি হাল। তাই তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই ব্যবসার
মালিকানাও ধীরে ধীরে হস্তান্তর হতে শুরু করে। এখন মজুমদার বাড়ির একমাত্র কন্যা
চন্দ্রানী তাঁর বিবাহিত জীবনে সুখে সংসার করছেন। দারুন বিত্তশালী স্বামী। বাড়ি,
গাড়ি প্রতিপত্তি সবই আছে। ছেলেরা কেউ মজুমদার ভিলাতে থাকে না। তাই আজ গত পনের বছর
ধরে বিশালাকার মজুমদার ভিলার একমাত্র
বাসিন্দা ছিলেন এই তিলোত্তমা দেবী। কেই বা থাকবে! দুই ছেলের একজন আমেরিকায় থাকে। নামকরা ডাক্তার। সময় পেলে বছরে এক দুবার আসে। ডাঃ শুভঙ্কর মজুমদার। শুভঙ্কর তিলোত্তমা দেবীর বড়
ছেলে। তখনও ডাক্তার হয়ে ওঠে নি। মাকে কথা দিয়েছিল, বিলেত থেকে এফ.আর.সি.এস.
কমপ্লিট করেই কলকাতায় ফিরে সেবা করবে মানুষের। কিন্তু আর ফেরা হয় নি। ততদিনে বিদেশী আদব কায়দা বুঝে নিয়ে ডাক্তার বিদেশিনীর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। গত পনের বছরে মাকে দেখতে কতবার দেশে এসেছে সে হাত গুনে বলে দিতে পারবে প্রতিবেশীরা। অন্যদিকে, ছোট ছেলে রমেন ব্যবসার কাজে সৌদিতে। তার আর আসার সময় কোথায়? রমেন মজুমদার ছোট বেলা থেকে খুব একটা ভালো রেজাল্ট না করতে পারলেও বাবার সম্পত্তি ধ্বংস করে সৌদি আরবে কি যেন একটা ব্যবসা ফেঁদেছে। চিরকাল অভিমানী রমেন বলে গেছে যে মজুমদার দম্পতি নাকি বড় ছেলে আর মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে তার দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসৎ পায় নি। সেই অভিমানে সময় পেলেও রমেন খুব একটা দেশে আসে না। শোনা যায়, সেখানে বিয়েও করেছে। তিলোত্তমা দেবী গত পনের বছর নিঃসঙ্গ জীবনে আত্মীয়পরিজন ছাড়া প্রতিবেশীদের সাথে সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু, গত মাস তিনেক তিলোত্তমা দেবীকে খুব একটা দেখা যেত না। বড় ছেলে শুভঙ্কর এসেছিল গত জুন মাসে। মাকে নাকি বলে গেছে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসবে। মায়ের চোখের দু কোন বেয়ে জল গড়িয়ে আসে। মা তিলোত্তমা খুব একটা আর চলাফেরা করতে পারছিল না। তাই মাস তিনেকের জন্য কিছু খাবার কিনে দিয়ে ডাঃ শুভঙ্কর মজুমদার বিদেশ পাড়ি দিয়েছে ঘরের দরজা জানালা বাইরে থেকে বন্ধ করে। তিলোত্তমা দেবী অবশ্য সে সব খাবার স্পর্শ করে দেখেন নি। অন্তত পুলিশের বক্তব্য তাই। পুলিশ যখন দরজা ভেঙ্গে ঘরের ভিতরে ঢোকে তখন তিলোত্তমা দেবীর দেহের রক্ত মাংস বিন্দুমাত্র ছিল না। শুধুই জীর্ণ কঙ্কালটাই খাটের উপর পড়েছিল। হয়তো যেদিন শুভঙ্কর চলে গেছে সেদিন লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমানে আর তীব্র অভিমানে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। তিলোত্তমা দেবীর কি ছিল না। সবকিছু ছিল। টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি ধনরত্ন সব ছিল। ছিল না শুধু সন্তানদের কাছ থেকে ভরসা। ছিল না তাঁর সন্তানদের দায়িত্ববোধ। তৈরি করতে পারেন নি সন্তানদের কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষা। আজ এই বার্ধক্যে পৌঁছে সব থেকেও তাঁর কাছে কিছুই ছিল না। মেয়ে চন্দ্রানী সুখের সাগরে ভেসে মায়ের কথা খুব একটা মনে পড়ে না। মাঝে মাঝে টেলিফোনে যোগাযোগ রাখত। মা তিলোত্তমা বুঝেছিলেন যে এদের সাথে আমার যোগাযোগ বাড়ছে, সংযোগ কমছে। পুলিশ বিকৃত দেহ নিয়ে মজুমদার ভিলা সিল করে দিয়ে চলে গেল। সামনের জটলাটা ফাঁকা হয়ে গেল। প্রশ্ন রয়ে গেল, সুখ কোথায়? প্রতিষ্ঠিত তিন সন্তানের অভিভাবকহীন মরা পচা গলা দেহে নাকি দারিদ্রে ক্লিষ্ট সন্তানের কাছে বয়স্ক পিতামাতার শুধু দিনান্তে প্রানেমনে সংযোগ স্থাপন। যশ, খ্যাতি আর প্রতিষ্ঠায় যদি আমরা অন্ধ হয়ে যায়, তাহলে অন্তত বাবা মাকে নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত পৌঁছে দিই। তাতে যে কটা দিন বাঁচবে নিজেদের সুখ দুঃখের হিসাব নিকাশ একে অপরের সাথে শেয়ার করে শান্তিতে মরতে পারবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও
সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি
প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[৪]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – চার
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
কাশীনাথ মিত্র এ পাড়ার খুব নামকরা মাস্টারমশাই।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতার চাকরী করে যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা সব জুটেছে কপালে। এখন তাঁর
ভরা সংসার। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ভালো পরিবারের ভালো চাকুরে ছেলে দেখে। বড় ছেলে
সুশোভন কে বিয়ে দিয়েছেন একটি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে দেখে। মিত্তিরদের লক্ষ্মীমন্ত বড়বউ
উপাসনা। যেমনি শিক্ষিত, তেমনি গুনবতী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার ডিগ্রিতে
ফার্স্ট ক্লাস। বছর তিনেক হল তাঁদের একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে
অভিনন্দন। অভিনন্দন মিত্রকে সাউথ পয়েন্ট এর কিডস সেকসানে এডমিশন করেছে। তুলসী তলায়
প্রদীপ দেখানো থেকে ছোট স্কুলে নিয়ে
যাওয়া। হেঁশেল থেকে নাচ গানে পারদর্শিতার অভাব নাই। কাশীনাথ মিত্রের এই নিয়ে পাড়ায়
দারুন সুখ্যাতি। বেশ সুখেই কাটছিল দিন। সকালে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে স্কুলে দিয়ে
অপেক্ষা করে আবার স্কুল শেষে তাকে নিয়ে আবার ফিরে আসে। এভাবেই দিন যায়, দিন আসে।
ছেলেকে স্কুলে দিয়ে অন্য বাচ্চাদের মায়েদের সাথে গল্প করে সময় কাটায় উপাসনা। তারপর
বাবুকে নিয়ে দুপুর গড়িয়ে বাড়িতে ফেরা। এভাবেই চলছিল, এমনটাই সবাই জানতো। এমনি সুখের
সংসারে আগুন ধরল। সেদিন মিত্রবাবু ব্যাঙ্কের কাজে একটু গড়িয়াহাট যেতে হয়েছিল। ফেরার
পথে তাঁর মনে হল আজ নাতি ও বৌমাকে সঙ্গে করে নিয়ে একসাথে ফিরবেন। এতক্ষনে নিশ্চিত
অভির ক্লাস শেষ হয়ে গ্যাছে। সাউথ পয়েন্টের কাছাকাছি আসতেই মিত্র মহাশয় অবাক হলেন।
নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। চোখদুটো দু একবার রগড়ে নিয়ে ভালো করে
দেখলেন। যা দেখলেন তা মিত্র মশায়ের চোদ্দ পুরুষের নাম ভুলে যাওয়ার জোগাড়। সতীসাধ্বী
উপাসনা হাতেনাতে ধরা পড়লো রতনবাবুর ডান্সিংকারে। একেবারে আলুথালু অবিন্যস্থ
কেশরাজি নিয়ে নেমে এল মিত্তির বাড়ির লক্ষ্মীমন্ত বড় বউ উপাসনা। রতন বাবুর সাথে
তাঁর পরিচয় গত মাস পাঁচেক আগে। রতন লাহিড়ী হলো বাবু’র বন্ধু শিবার বাবা। বেশ
কয়েকদিনের আলাপে সুন্দর সম্পর্কটা ধীরে ধীরে গাড়ির কালো কাঁচের ওপারে চলে গেছিল।
অবৈধ নেশায় ধরা দিয়েছিল কোন এক কালো দিনে। ভাঙল সুখের হাট। এখানে গীতিকারের গান
রচনায় সার্থকতা।
সবাই তো সুখী
হতে চায়
তবু কেউ সুখী
হয়... কেউ
হয়না
জানিনা বলে যা
লোকে... সত্যি
কিনা
কপালে সবার নাকি
সুখ সয়না।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও
সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি
প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[৫]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – পাঁচ
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
কবি সুপ্রকাশ ঘোষাল। ওপার বাংলায় জন্ম ও শৈশব
কাটলেও বাবা মায়ের হাত ধরে এক সময় এদেশে চলে আসেন। তারপর এখানে উচ্চশিক্ষা ও
লেখালেখি শুরু। তাঁর লেখনিতে বেশ জোর আছে বলতে হবে। দুই বাংলার আপামর মানুষ তাঁর
লেখনিতে বেশ গুণমুগ্ধ পাঠক হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রত্যেকটা বই বেস্টসেলার তকমা পায়।
অনেকেই একনিষ্ঠ ভক্ত হলেও শত্রু যে বিশেষ নেই তা বলা যাবে না। এখন তাঁর বিরাট নাম,
একডাকে সবাই চেনেন। দুই বাংলার মানুষ মেতে আছে তাঁর প্রেমের কবিতায়। তাঁর কবিতায়
মানুষ হাসে, তাঁর কবিতায় মানুষ কাঁদে। তাঁর কবিতায় মানুষ নতুন করে প্রেমে পড়ে।এ
বছর ডি. লিট. পুরস্কার এ মনোনীত হয়েছেন কবি সুপ্রকাশ ঘোষাল। তাঁর মত সুখী আর কে
থাকতে পারে বলো। অনেকদিনের স্বপ্ন পুরন হতে চলেছে সুপ্রকাশ
বাবুর। চারিদিকে কবি সুপ্রকাশের ব্যাপক নাম ডাক। এখন বাড়ির মেন গেটের সামনে নেমপ্লেট
বসাতে হয়েছে। পাবলিশার্সদের আনাগোনা বেড়েছে। সবাই জানে কবির সুখের অন্ত নাই। সুখী
তো বটেই। সুপ্রকাশ বিয়ে করেছিলেন এক সুন্দরী রমণী-শুচিস্মিতার সাথে। ছেলেপুলেও
আছে। দুই সন্তান- সঙ্ঘমিত্রা ও সুশোভন। কিন্তু ওই পর্যন্ত। সংসারের কোন খেয়াল
রাখেন না। ছেলে মেয়ে তাদের পড়াশুনা থেকে শুরু করে সবকিছুই একা হাতে সামলায়
শুচিস্মিতা। এই নিয়ে সুপ্রকাশের সাথে কম ঝামেলা হয় নি। এতো গেল একদিকের কথা। যাকে
আমরা সর্বসুখী বলে মনে করছি তিনি কিন্তু সর্বসুখী না। কারন, কবি সুপ্রকাশ বাড়ি
ফিরে যখন কমোডে বসেন। রাতের পর রাত জেগে, খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করে যে মানুষ দুই
বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতার জন্য ভেবেছেন আর কলমের গতি বাড়িয়েছেন, তাঁকে সময় গ্রাস
করেছে। একটু চাপে যখন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে, তখন কবির চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু
ঝরে। সব সুখ সম্মান শুন্যে মিলিয়ে যায়। বাইশ বছর ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগী। অর্শের
ব্যাথা তাঁর সব আনন্দ নিয়েছে কেড়ে। যিনি ডি. লিট. সম্মান পাওয়ার আনন্দ পরিবারের
সাথে শেয়ার করতে পারছেন না, শুধুমাত্র তাঁদের প্রতি কর্তব্য পালন করেন নি বলে।
আমরা যারা তাঁর লেখা পড়ে পাগলপারা হই, তারা কেউ জানি না তাঁর এই দুরারোগ্য ব্যাধির
কথা। সবাই বহিরাঙ্গের কথা ভাবি, সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। অন্তরঙ্গের কথা জানার
চেষ্টাও করি না। তাই আবার প্রশ্ন রেখে যায়, সুখ কোথায়? যে লোক লিখতে পারে নি
কোনদিন সে তাঁর স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে চুটিয়ে সংসারের স্বাদ আস্বাদন করেছেন তিনি
তো সুখের স্বর্গে বাস করেন। নাই বা চিনল তাঁকে সারা পৃথিবীর লোক। খ্যাতি মানুষকে
মহৎ করে তোলে, কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। তার ফল অত্যন্ত করুন। সুখ স্বপনে,
শান্তি শ্মশানে। সুখ অনুভব করতে হয়। কেউ আপনজনদের বঞ্চিত করে নিজ সুখ প্রতিষ্ঠা
করতে বধ্যপরিকর, আবার কেউ নিজ স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে পরহিতে জীবন শেষ করে। আমরা
ভুলে যায় যে, যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা। শুকরের বিষ্ঠা। তাই আপনজনের প্রতি কর্তব্য
প্রাথমিক সুখ প্রদান করে সেটা দেরিতে হলেও অনুভব করেছিলেন কবি সুপ্রকাশ। প্রসঙ্গত
বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি
তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ।
[৬]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব –
ছয়
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
সৌরভ আর অমল দুজনে খুব ভাল বন্ধু। ছোটবেলা থেকে
একে অপরের সাথে মাণিকজোড়ের ন্যায় ঘুরে বেড়াত। এ পাড়ার সব লোক একবাক্যে তা স্বীকার
করে এখনও। তারপর ধীরে ধীরে প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে বড় স্কুলের দরজায় পা রাখতে গিয়ে
হোঁচট খেল অমল। সে বছর না পারলেও পরের বছর পঞ্চম শ্রেনিতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে আবার
দুই বন্ধু একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা করে। শুধুমাত্র ক্লাসের টাইমটা বাদ দিলে বাকি
সময়টা একসাথে কাটে দুই হরিহর আত্মার। বাদ সাধল মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায়। এবারেও
আটকা পড়লো অমল। ততদিনে সৌরভ মাধ্যমিক পাশ করে শহরের বড় স্কুলে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি
হয়ে গেছে। এমনিতেই একটা বছর একা একা কেটেছে। তবুও বাড়ির চাপে পড়ে বাড়িতে বসে আরও
একবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বাকি সম্মানটুকু বিসর্জন দিয়ে আর ঝুঁকি নিতে পারল না
অমল। পরপর দুবছর প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ
না করতে পেরে অমল পড়াশুনো ছেড়েই দিল। সৌরভ সেই বছরই জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিয়ে শিবপুর
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। অমলের সাথে সৌরভের যোগাযোগ ধীরে ধীরে কমতে কমতে
বিচ্ছিন্ন হল কালের অমোঘ নিয়মে। মাঝে অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেছে। অমলের পালে আর
সৌরভের সুগন্ধ আসে না। তার নৌকায় অনেক নতুন নতুন বন্ধুরা ভিড় করেছে।অমল তার মতো
করে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে অমল নতুন সংসার পেতেছে। ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছে।
একটা ইঞ্জিন ভ্যান কিনেছে। সারাদিন পরিশ্রম করে ভালো আয় করে। ছেলেমেয়েকে কে.জি.
স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বড় ছেলে অনন্ত ক্লাস ফাইভে উঠেছে। প্রথম দশে নাম। স্ত্রী
সুমিত্রা ও সন্তানদের নিয়ে অমলের সংসারে সুখের অন্ত নাই। অমলের মত সুমিত্রারও বেশি
কিছু চাহিদা নেই। তাই তাদের উপার্জনের কিছু থেকে প্রতিদিন নিয়ম করে সুমিত্রা মেয়ের
বিয়ের জন্য সরিয়ে রাখে আর মাসের শেষে কাছের পোষ্ট আপিসে গিয়ে জমা করে দেয়। অমলের
সাথে সুমিত্রা স্বপ্ন দেখে। তারা হাসে প্রান খুলে। একে অপরকে সময় দেয়, গুরুত্ব
দেয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। এভাবেই দিন যায়, দিন আসে। সপ্তাহ ব্যাপী গ্রামের
বাৎসরিক মেলা শুরু হয়েছে। তাদের গ্রাম আর আগের মতো নেই। অনেক উন্নত হয়েছে।
রাস্তাঘাট পটপরিবর্তন ঘটে গেছে। তো একদিন সুমিত্রা ও সন্তানদের নিয়ে পৌঁছে গেল অমলের
ইঞ্জিন ভ্যানটা। ভ্যানটা এক সাইডে রেখে মেলার মধ্যে প্রবেশ করে সবাই। তাদের চোখে
মুখে আনন্দের ছাপ প্রতীয়মান। খুশিতে ডগমগ ছেলেমেয়েরা। মেলা ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছাল
কাঠের নাগরদোলার কাছে। ছেলেমেয়ের আব্দারে তারাও চড়ে বসল নাগরদোলায়। নাগরদোলা
ঘুরছে, অম্ল-সুমিত্রার সুখের চক্র ঘুরছে। আনন্দে বিহ্বলতা কাটিয়ে নাগরদোলা থেকে
নেমে সোজা মা কালী রোল সেন্টারে। সেখানে সবাই মিলে একটা টেবিল জুড়ে এগ চাউমিন খেয়ে
বেরিয়ে ভ্যানের দিকে যাবে অমল। ঠিক সেই সময়, অমলের সামনে চেনা চেনা একটা মুখ ভেসে
এল সামনের রাস্তার উপর রেস্টুরেন্ট থেকে।সৌরভ। সেই ছোটবেলার সৌরভ। সৌরভ অমলকে দেখে
চিনতে পারে নি। অমল এগিয়ে গিয়ে দেখল একটি মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি চলছে। কি জানি
হয়তো ওর স্ত্রী হবে। আরও দেখল অমল টেবিল জুড়ে দামী দামী খাবার অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
সেসবে হাত দেওয়ার আগে তাঁদের মধ্যে কোন একটি বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেছে।
মেয়েটি রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। সৌরভও উপায়ান্তর না দেখে বিল মিটিয়ে
বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। খাবার গুলোর ভবিষ্যৎ দেখার জন্য অমল আর দাঁড়িয়ে না
থেকে ছোট ছেলেটাকে কাঁধে তুলে ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে সবাই একটা করে
দু টাকা করে বরফ (আপনারা পড়ুন আইসক্রিম) কিনে চুষতে লাগলো। কি পরম আনন্দে তারা এই
সুখ চুষে খাচ্ছে তা একমাত্র অন্তর্যামী জানেন। সুমিত্রা বাচ্চাদের নিয়ে ভ্যানে বসে
থাকতে থাকতে অমলকে পাঁচশো গরম গরম জিলিপি নিতে বলল। অমলও দৌড়ে গেল। জিলিপি নিয়ে
ফিরে আসার পথে আবার সৌরভের সাথে দেখা। অমল তখন কথা না বলে থাকতে পারল না। কিরে
ভালো আছিস সৌরভ? প্রথমটা না চিনতে পারলেও অমলের সেই চিরাচরিত ভঙ্গিমা মনে করিয়ে
দিল। বলল ভালো তো ছিলাম। কিন্তু কাল হল বিয়ে করে। এ মহিলার জন্য যাই করি না কেন
কোন কিছুতেই তুষ্ট করা যায় না। সব সময় একটা অশান্তি লেগে আছে। তা তুই কেমন আছিস?
কোথায় থাকিস? আমি ভালো আছি রে বন্ধু। আর
যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই আছি। সৌরভের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। পশ্চিম
গগনে সূর্য ঢলে পড়ছে। অমল বলল আসি বন্ধু, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। অমল তার স্ত্রী
সন্তানদের নিয়ে মহানন্দে মেলা থেকে ঘুরে বাড়িতে ফিরে এলো। রাত্রে অমল বলল সুমিত্রা
আজ আর রান্না করার দরকার নেই। যা ভাত আছে ওতে জল ঢেলে জিলিপি দিয়ে খেয়ে নেবক্ষন।
সেইমত তারা সেদিন রাতের খাওয়া সেরে সুখনিদ্রায় গেল। পরে একবার সৌরভের সাথে অমলের
দেখা হয়েছিল। তখন অমল শুনেছিল সৌরভের ডিভোর্স হয়ে গেছে। প্রশ্ন সুখ কোথায়? ভালো বাসায়
না ভালবাসায়? এক রমণীর প্রভাবে অমলের জীবনে নতুন স্বপ্ন রচনা আর এক জনের পাল্লায়
পড়ে সৌরভের বিলাস বৈভবে পরিপূর্ণ জীবনে অমাবস্যার কালো চাঁদ। অর্থ তো এখানে
নিমিত্তমাত্র। অনুভূতিটাই আসল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট
চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে
দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[৭]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – সাত
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
শুভনীল, সমীরন, অপূর্ব, কৃষ্ণেন্দু আর অরুনাভ
একসাথে পড়াশোনা করেছে। তিন বৎসর হোস্টেলে দিন কেটেছে। দক্ষিণ কলকাতার স্বনামধন্য
আশুতোষ কলেজের ছাত্র। সকলের বিষয় একই না হলেও হোস্টেলে থাকার সুবাদে বন্ধুত্ব
জোরালো। এক সাথে কলেজ, সিনেমা, পার্ক, আড্ডা আর রবিবারের সকালে জেলমাঠে গিয়ে
ক্রিকেটের পাঠ নেওয়া। মাঝে মাঝে সকালে উঠে যোগমায়া দেবী কলেজের মেয়েদের যে ঝাড়ি
মারে নি তা নয়। তবে ওই পাঁচ জনের মধ্যে শুভনীল বরাবর একটু রক্ষ্মনাত্মক। ওর পছন্দ
পড়াশুনার ফাঁকে একটু ব্রিটিশ কাউন্সিল বা বান্ধব সমিতির লাইব্রেরীতে গিয়ে বই
ঘাঁটা। আর অবসরে নন্দন চত্বরে গিয়ে ছবির প্রদর্শনী দেখা বা দু একটা আর্ট ফিল্ম
দেখা কিংবা উত্তম মঞ্চের নাটক উদরস্থ করা। ভাবধারা ভিন্ন হলেও পাঁচ বন্ধুর মতান্তর
ঘটেছে খুবই কম। আজ শুভনীল বসে আছে উত্তর কলকাতার বই পাড়ার বিখ্যাত কফি হাউসে। আজ
থেকে বিশ বছর আগে এই দিনটিতে তার জন্মদিনের পার্টি শেষে বসন্ত কেবিন থেকে সোজা এই
কফি হাউসে টানা আড্ডা। সেদিনের সেই কথা ভাবতে ভাবতে শুভনীল একটু আবেগপ্রবন হয়ে
পড়ে। সেদিন তাঁদের আড্ডার বিষয় ছিল কে কেমন মেয়ে বিয়ে করবে। সেদিন সবাইয়ের মতো শুভ
তার মতামত জানিয়েছিল। কিন্তু মাঝে বেশ কয়েকটা বছর চলে যায়। সবাই একে একে জীবনে
প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে একে অপরের সাথে সংযোগ কমে যোগাযোগ বেড়েছে। মাঝে শুভনীল অনেক
চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে সে বিয়ে করবে না। বিয়ে করলে তার
স্বাধীনতা, তার সুখ, তার আনন্দ, বিলাস সবকিছুতে একটা নিয়ন্ত্রিত হবে, হারিয়ে যাবে
তার সৃষ্টি সুখ। তাই বিয়ে করা যাবে না। সারা জীবন একা থেকে সাহিত্যচর্চা করে যাবে।
এই ভাবনা থেকে শুভনীল আর সাত পাকে বাঁধা পড়ে নি। আজ একচল্লিশটা বসন্ত পেরিয়ে জীবন নদীর
কিনারায় পৌঁছে শুভ ভাবতে শুরু করেছে যে সে যেটা করেছে তা কি ঠিক, নাকি তার বন্ধুরা
ঠিক করেছে? কে বেশী সুখী? আজ শুভনীলের অর্থ আছে, গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, আছে যশ,
খ্যাতি, প্রতিপত্তি। সব আছে। এর সাথে আছে সুখ, আছে স্বাধীনতা। আছে মদ, আছে
সিগারেটের নেশা। যখন খুশি যেখানে যেতে পারে, সিনেমা, বইমেলা, কফি হাউস, নন্দন। কেউ
বাঁধা দেবার নেই। সবাই আটকা পড়ে গেছে সংসারের জালে। আমিই সুখী, কেবল আমিই সুখী। এই
ভাবে বিহ্বল হয়ে কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আসছে। এমন সময় দেখা হয়ে গেল সমীরণের সাথে।
সঙ্গে তার স্ত্রী সুমনা ও ছেলে আর মেয়ে। কিরে কেমন আছিস সমীরণ? ভালো আছিস? কোথায়
গেছিলিস? ভালো আছি রে। ছেলেকে ফিজিক্স অনার্সে ভর্তি করতে প্রেসিডেন্সি কলেজে
এসেছিলাম। আর মেয়ে কোন ক্লাস? মেয়ে তো সাউথ পয়েন্টে। ওর ক্লাস এইট। এই কোনরকমে চলে
যাচ্ছে বউ বাচ্ছা নিয়ে। শুভনীল কে বিদায় জানিয়ে সমীরন এগিয়ে গেল ট্রেন ধরবে বলে।
শুভনীল সিগারেট ফুঁকাতে ফুঁকাতে এসে কলেজ স্কয়ারের চাতালে বসে ভাবতে লাগলো। কে
সুখী? তার কাছে সব আছে। কিন্তু কোথায় সেই শিশুর হাসি? কোথায় সেই সন্তানের সাফল্যের
বিজয় উল্লাস? কোথায় সেই ফুটফুটে রমণীর পরামর্শ আর ভালবাসা। এসব পেয়ে কি সমীরণদের
সুখ স্বাধীনতা সব উবে গেছে? তা নয়। সব আছে। তাহলে তার এই সম্পত্তি যার জন্য সে এত
পরিশ্রম করেছে তার উত্তরসূরি বা কোথায়? তার অবর্তমানে এসকল সম্পদ তুচ্ছ। শুভনীলের
আকাশে সূর্য অস্তমিত হলেও আজ সে বুঝেছে অপার্থিব প্রেমের থেকে বাৎসল্য প্রেম, মধুর
প্রেমে আটকা পড়া ঢের ভালো। দায়িত্ব নিয়ে কর্তব্য পালনে অনেক বেশী স্বাধীনতার সুখ
প্রদান করে। এই তো সেদিন রাত্রে ফ্লাটে ঘুম থেকে উঠে রাত্রে বাথরুম যেতে গিয়ে
মাথাটা ঘুরে গেল। ব্যাস, চোখ খুলতেই দেখি হসপিটালের বেড-এ। ভাগ্যিস বাড়িওয়ালার
বখাটে ছেলেটা খোঁজ নিয়েছিল। নইলে সেদিন তো ভবলীলা সাঙ্গ হবার কথা। এ সকল চিন্তা
করতে করতে শুভনীল উঠে বাড়ির পথ ধরল। কি জানি, হয়তো এবার বিকেলে ভোরের ফুল ফোটাবে।
পরম সুখের সন্ধান করবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র
সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন
তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
[৮]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – আট
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
স্থান আরোগ্য হসপিটাল। ১০৮ নং কেবিন। ভি.আই.পি.
লাউঞ্জ। বেড এ শুয়ে আছে স্বরলিপি। কোন সাড়া নেই আজ তিনদিন ধরে। স্বরলিপি, মানে স্বরলিপি
গাঙ্গুলি ওরফে লাবন্য। জনপ্রিয় অভিনেত্রী। বয়স পঁচিশ পেরিয়ে কয়েকমাস। অধিক মাত্রায়
স্লিপিং পিলস সেবনের কারনে হসপিটালে ভর্তি। লাবন্য তখন খুব ছোট্ট। বর্ধমানের এক
গরীব মাষ্টারমশাই বাবার হাত ধরে ফুলের পাপড়ির মতো ভাসতে ভাসতে বাবার সঙ্গে স্কুলে
যেত। পাড়ার সবাই তাকিয়ে থাকতো তার রূপ লাবন্যে। তার রুপের সাথে তাল মিলিয়ে জন্মলগ্নে
নামকরণে দেরি করেন নি কন্যাবৎসল শুভময় গাঙ্গুলি। সেদিন শুভময় বাবু মনে মনে ঠিক করে
ফেলেছিলেন যে মেয়েকে তিনি স্কুল টিচার করে তুলবেন। সবকিছু সেই গতিতে ধাবমান ছিল।
শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণের সাথে সাথে লাবন্য তার রূপ লাবন্যের পাশাপাশি নাচে গানে
পড়াশুনায় সবার নজর কাড়ল। অষ্টম শ্রেণীতে জাতীয় বৃত্তি পরীক্ষায় স্বর্ণপদক আসল।
সর্বভারতীয় সঙ্গীত পরিষদের পঞ্চম বর্ষের পরীক্ষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও ক্লাসিকাল
মিউজিকে ডিস্টিংশান পেল। পাশাপাশি বেঙ্গল মিউজিক কলেজ থেকে নৃত্যে চতুর্থ বর্ষে
একটুর জন্য ডিস্টিংশান হাতছাড়া হলেও পরীক্ষকদের নজর কেড়েছে। স্কুলে লাবন্য নামে
সবাই একডাকে চেনে। স্কুলের কোন প্রোগ্রাম করার থাকলে আগে লাবন্যের ডাক পড়ত। এ নিয়ে
শুভময়ের গর্বের শেষ ছিল না। স্কুল থেকেও বেশ কয়েকবার ব্লক, জেলা হয়ে রাজ্যস্তরের
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। সাফল্য সবক্ষেত্রে না এলেও সংখ্যাটা ফেলে দেবার মতো
নয়। এ হেন লাবন্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট পাশের স্কুলে ভর্তি হতেই
পূর্ণিমার চন্দ্রকলা কমতে কমতে ধীরে ধীরে অমাবস্যার ঘোর কালো অন্ধকার নামানোর
সুত্রপাত হয়ে গেল। নতুন স্কুল, তার উপর রূপে গুনে আসামান্যা লাবন্য। স্বাভাবিকভাবে
বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকল। এভাবে বেশ খুশিতে দিন কাটছিল। একদিন লাবন্য স্কুল থেকে
ফেরার সময় প্রবল বেগে বৃষ্টি নামল। প্রতীম এর সাথে কাছেই একটি শেডের তলায় অপেক্ষা
করতে লাগলো। প্রতীম হল লাবন্যের পাড়ার বখাটে ছেলে। এই স্কুলে সে আগে থেকে পড়ে। এখন
তার দ্বাদশ শ্রেনি। লাবন্য ওকে দাদা বলে ডাকে। প্রতীমও ভালো ব্যবহার করতো। সেদিন
মাথায় বদবুদ্ধি হাজির হল। লাবন্যকে প্রতীম বলতে লাগলো
-আচ্ছা লাবন্য তোমার এত সুন্দর রূপ লাবন্য,
পড়াশুনায় ভালো। তুমি সিনেমায় নামছ না কেন?
-সিনেমা! সে কি আমাদের মত গ্রামের মেয়ের কোন
চান্স আছে? তাছাড়া সেখানে চান্স পেতে কত সুন্দর হতে হয়!
-তুমি জান না লাবন্য। তুমি কত সুন্দর! তুমি
নিজেকে আয়নার সামনে কখনও দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছ? সিনেমায় নামতে গেলে যা যা লাগে সব
গুণাবলী প্রয়োজন সবই তোমার মধ্যে আছে। বিশেষ করে তুমি যখন স্টেজে নাচ কর, তখন
দর্শক পাগল হয়ে একদৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি তো ভাবি যে তুমি কেন এখানে
পড়ে আছ!
এসব কথা শোনার পর লাবন্যের দেহে মনে রোমাঞ্চের
বন্যা বয়ে গেল। গ্রামের সরল মেয়ে রুপালী পর্দার সোনালী নায়িকা হয়ে উঠবে। উহু,
জাস্ট ভাবতে পারছিল না সেদিন।
-তুমি জান, সিনেমায় নামতে গেলে কার সাথে
যোগাযোগ করতে হয়? কি কি করতে হয় বল না প্রতীম দা।
-আমি সব বলবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা কথা
বলতে হবে যে বাড়িতে কিছু বলা যাবে না। পুরোটা সারপ্রাইজ হবে। তোমার প্রথম সিনেমা
দেখে তোমার বাবা মা অবাক হয়ে যাবে। কলকাতায় আমার এক দাদা আছে। সিনেমা জগতের অনেক
স্টারদের সঙ্গে তার ওঠা বসা। আমি তোমার কথা বলে রাখব আর তোমাকে দেখলেই ওরা তো লুফে
নেবে। তুমি কিন্তু পুরো বিষয়টা গোপন রাখবে।
-কিন্তু, বাবা মা তো জানতে চাইবে। আমি কোথায়
যাব? কি প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছি-এসব তো জানতে চাইবে। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমার সব
প্রোগ্রামে বাবা মা কেউ না কেউ গেছে আমার সঙ্গে!!!
-তুমি বলবে, আমাদের স্কুলের একটা প্রোগ্রামের
রিহার্সাল আছে। ফিরতে দেরি হবে। ব্যস।
অনেক কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে পরিশেষে লাবন্য এক
অজানা স্বপ্নের পথে পাড়ি দেবার সিদ্ধান্ত নিল। বাবা মা কে মিথ্যা বলে
পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী স্টেশনে পৌঁছে গেল যেখানে প্রীতম আগে থেকে অপেক্ষা করছিল।
লাবন্য যেতেই দুজনে কলকাতাগামী ট্রেনে চড়ে বসল। লাবন্যের বুকের মধ্যে একটা চাপা
আতঙ্ক কাজ করছিল। যাইহোক দুপুরের দিকে কলকাতায় সেই দাদার বাসায় নিয়ে হাজির হল
প্রীতম। বস্তির মধ্যে একটি ছোট্ট খুপচি ঘর। লাবন্য বুঝতে পারে সে ভুল করে ফেলেছে।
কিন্তু আর ফেরার উপায় নেই। চুপচাপ মাথার মধ্যে প্লান তৈরি চলছিল আর চোখের কোন থেকে
জল গড়িয়ে আসছিল। সেই সময় ভিতর থেকে তার ডাক পড়ল সিনেমাদাদার কাছে যাওয়ার। লাবন্য
তখনও আশায় ছিল। কিন্তু, কোন কিছু বোঝার আগেই সেখানেই কয়েক মুহূর্তে শেষ লুট গেল
তার ষোলটা বসন্ত পেরিয়ে যাওয়া গচ্ছিত ফুটন্ত নবযৌবনের রসকলি। যন্ত্রণাক্লিষ্ট চোখে
তাকিয়ে দেখল লাবন্য, যাকে সে বিশ্বাস করেছিল সেও বাদ গেল না। লাবন্য হাউ হাউ করে
কাঁদতে লাগলো।
-ওরে পাগলী, কাঁদছিস কেন? সিনেমায় নামতে গেলে ওদেরকে
খুশী করতে এসব সহ্য করতে হয়।
-আমাকে বাড়ি নিয়ে চল। আমি বাড়ি যাব। আমি মায়ের
কাছে যাব। তোমরা খুব বাজে।
মা মা বলতে বলতে লাবন্য অজ্ঞান হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামতে নরপিশাচ প্রীতম আর তার সিনেমাদাদা অজ্ঞান অচেতন লাবন্যকে নিয়ে বড় রাস্তার পাশে ফেলে এল। রাত্রে
যখন চোখ মেলে তাকাল তখন দেখল এক আলো ঝলমলে সুন্দর ঘরে শুয়ে রয়েছে।
-আমি কোথায়? আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।
জলের গ্লাস হাতে এক বিশাল দেহের মূর্তিময় মানুষরূপী
দেবতা এগিয়ে এলেন।
-মা, তুমি অবশ্যই বাড়ি যাবে। আগে একটু সুস্থ
হয়ে নাও। এই জলটা খেয়ে নাও।
লাবন্য একটু সময় নিয়ে বুঝতে পারল সে কালের করাল
গ্রাস থেকে আপাতত মুক্তি পেয়েছে। ধীরে ধীরে উঠে তার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে
সমস্ত ঘটনা তাঁকে বলল। তিনি আবার ঘটনাচক্রে সিনেমা জগতের ডাকসাইটে অভিনেতা সুবিরেশ
স্যানাল।
-দেখ মা। যা হবার হয়েছে। এখন তুমি আমাকে তোমার
বাড়ির ঠিকানা বল। তোমাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করি।
-না, আমি আমার সব শেষ করেছি নিজের ভুলে। বাবা
মায়ের বিশ্বাস হারিয়েছি। আমি আর ফিরতে চাই না।
-মা রে, আমাদের এই জগত ভালো না। এখানে কাজ করতে
পারবি না। অনেক সমস্যা হবে।
-আমার আর কি খারাপ হবে বাবু! আমার জীবনে কি আর
আছে শেষ হবার?
তার জিদের কাছে হার মেনে সুবিরেশ ভাবলেন, যে
মেয়েটির রূপ গুন আর নাচে গানে পারদর্শিতা আছে যখন কাজে লাগানো যাক। সেইমতো কাজ
শুরু করে দিল লাবন্য। কারন, সুবিরেশের ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ সুনাম আছে। তাঁর কথা কেউ
অমান্য করতে পারেন না। পর্দায় নতুন নামে পরিচয় এলো। স্বরলিপি গাঙ্গুলি। যেমন অভিনয়
তেমনি গানের গলা নবাগতা নায়িকার স্বরলিপির। প্রযোজকদের ভিড় বাড়তে থাকে। একের পর এক
ছবিতে সাইন করতে থাকে। জীবনে আসে নতুন মোড়। স্বরলিপি আজ স্টার অভিনেত্রী। নিজের
সবকিছু হারিয়ে অনেক কিছু পেয়েছে। বাবা মাকে ছেড়ে পেয়েছে স্যানাল বাবুর মত মানুষকে।
এখন তাঁর আলাদা ডুপ্লেক্স হয়েছে। বাড়িতে কাজের লোক আছে। ইচ্ছে থাকলেও বাবা মায়ের
সামনে যেতে মন চায় নি। খ্যাতি তাঁকে বিড়ম্বনায়ও ফেলেছে। এখন আর আগের মতো যেখানে
সেখানে যেতে পারে না। রাস্তার মোড়ে ফুচকা খেতে পারে না। সবার সাথে শপিং করতে পারে
না। সেসব তবু মানিয়ে নিয়েছিল কর্পোরেট স্বরলিপি। সেদিন বিকালে যখন প্রিয়া সিনেমা
হলের সামনে প্রীতমের সাথে আবার দেখা হল। স্বরলিপি সিটিয়ে গেল। প্রীতম কথা বলতে
চেয়েছিল। লিপি কথা না বলে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসেছিল। তার ঠিক সপ্তাহ খানেক পর থেকে
স্বরলিপির ফোনগুলি ঘনঘন বাজতে থাকে। অজানা নাম্বার থেকে। সবার একটাই কথা ম্যাডাম
ফাঁকা আছেন? এখন রেট কত নিচ্ছেন? স্বরলিপি ফোন স্যুইচ অফ করে রেখেছিল। কাজের
মেয়েরা ল্যান্ডফোন টা সামলাচ্ছিল। এসব দেখে লজ্জায় ঘৃণায় অপমানে একসাথে একুশটি
স্লিপিং পিলস খেয়ে গত সোমবার রাত্রে শুয়েছিল। তারপর সকাল থেকে সাড়া না পেয়ে
হসপিটালে নিয়ে যায়। পুলিশে অ্যারেস্ট করতে সেই নাকি বলেছে, দিদির ফোন নাম্বার দিয়ে
লোকাল ট্রেনের জানালার উপরে লিখেছিল, “বিনা খরচে সুন্দরী নায়িকার সাথে রাত কাটাতে
চান? এখুনি নিচের নাম্বারে ফোন করুন”। তারপর থেকে ফোন আসতে শুরু করে। প্রশ্ন
সেদিনের লাবন্যের সুখ আর আজকের স্বরলিপির সুখের নিউক্লিয়াস ভিন্ন চরিত্রের আর
ভিন্ন মাত্রারও বটে। তাই আপনি ঠিক করুন প্রিয়জনের পরামর্শ ব্যাতিরেকে মরীচিকার
পিছনে ছুটে নিজেকে শেষ করবেন নাকি আপনার জনের কাছে স্বল্প সুখে সুখী হবেন। প্রসঙ্গত
বলে রাখি, এই গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি
তাঁর জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ।
[৯]
‘সুখে থাকার দ্বিমেরু তত্ত্ব’ পর্ব – নয়
©
অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
হঠাৎ আসা হাল্কা হাওয়ায় মাঝে মাঝে ছোট চারাগাছ কোন কারনে উৎপাটিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই চারাগাছ কে যদি পুনঃরোপন করা যায় যত্নসহকারে তাহলে তার শিকড় এতটা গভীরে চলে যায় যে ঐ চারাগাছ মহীরুহে পরিনত হয় এবং প্রবল ঝড়ের তান্ডবেও তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তেমনিভাবে, বর্তমান দিনে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সম্পর্ক কোন ঠুনকো কারনে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে যদি সেই সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায় তাহলে তা মধুর থেকে মধুরতম হয়ে ওঠে। দুনিয়ার কোন বাহ্যিক শক্তি সেই সম্পর্কের ভিত টলাতে পারে না। আনন্দ, সুখ, সহনশীলতা আর বিশ্বাসের স্তম্ভ পায় প্রেম। প্রগাঢ় হয় ভালোবাসা। পড়শীরা ইর্ষা করে আড়চোখে তাকায়। পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসায় তৈরি হয় ভক্তি। ভক্তিতে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা। আর শ্রদ্ধা হল ভালো সম্পর্ক এর চাবিকাঠি। কারন, শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না। আজ সবটাই অবিনাশের জীবনের ক্যানভাসে সত্যি হয়ে আঁকিবুকি টানছে আর অবিনাশ দক্ষিনের বারান্দায় বসে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করছে। করবে না বা কেন? এই হৃদয়ে কম আঘাত বয়ে বেড়াতে হয়েছে গত চারবছর ধরে? সেই যন্ত্রনায় প্রলেপ দিতে না হয় একটু মৃদুমন্দ বাতাসে সুখস্মৃতি রোমন্থন করা। আসুন এবার আসল কথায় আসা যাক।
আরামকেদারায় বসে ছিল বছর তিরিশের সুঠামদেহী অবিনাশ। অবিনাশ দত্তগুপ্ত। অবিনাশের চুলগুলো হালকা উড়ছে। দুরে কোকিল ডাকছে। এখনো শীতের আভাস কাটেনি। তবে সেই কামড়ানো শীতের লেশমাত্র নেই। পটভুমি ডুয়ার্সের জঙ্গল মধ্যস্থিত জয়ন্তী নদীর তীরে ‘বনান্তে’ কটেজ বনবাংলোর বারান্দা। বেশ আয়েশ করে আরামকেদারায় বসে আছে অবিনাশ। অনেকদিন পরে সে জীবনে একটু স্থবিরতা পেয়েছে।পর্না স্নানে গেছে। সেই সুযোগে চার বছরের সাথী গোল্ড ফ্লেকের অগ্নিকুন্ডে গোপন পরিভ্রমন। কারন পর্ণা এগুলো একদম পছন্দ করে না। দীর্ঘ চার বছরের অভ্যাসকে আবার একদিনে হুস করে ভুলে যাওয়া যায় না। এটা তাদের দ্বিতীয় হনিমুন। ছত্রিশটা বসন্ত পেরিয়ে আসা অবিনাশের জীবনে এযেন এক নব বসন্ত।
আজ থেকে প্রায় ছ’বছর আগে অবিনাশের সাথে পর্ণা সাতপাকে বাঁধা পড়েছিল। পর্ণা মানে শ্রীপর্ণা মজুমদার। উত্তর কলকাতার মেয়ে। বেশ বনেদী পরিবারের মেয়ে। হটাত করে একদিন অবিনাশের সাথে সিটি সেন্টারে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল। সেদিন সৌম্য কান্তি সুঠামদেহী অবিনাশকে দেখে শ্রীপর্ণার ভাল লাগা কাজ করলেও প্রেমে পড়ে যায় নি। মানে লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট নয়। এমন সময় সুনন্দা অর্থাৎ শ্রীপর্ণার বান্ধবী সুনন্দার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে একটা মেসেজ করতে যাবে বলে যেই ফোনটা বের করতে যাবে। দেখল ব্যাগে সেলফোনটা নেই। ভালো করে মনে করতে স্মরণ এলো স্নানে যাওয়ার আগে ফোনটা চার্জে বসিয়ে ছিল কিন্তু আর নেওয়া হয় নি তাড়াহুড়াতে। কিংকর্তব্য শ্রীপর্ণা উপায়ান্তর না দেখে সামনের টেবিলে বসে থাকা উদাসী অবিনাশের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেছিল-
-এক্সিউজ মি। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। মে আই ইউজ ইউর সেলফোন? অ্যাকচুয়্যালি............।
-ওহ সিওর। প্লিজ ফিল ফ্রি টু............।
তারপর সেই ফোন থেকে শ্রীপর্ণা সুনন্দার ফোনে একটা তের সেকেন্ডের কল
করেছিল। ভদ্রতার খাতিরে সেদিন শুধু মিচকি হাসি দিয়ে একটা শুকনো ধন্যবাদ জ্ঞাপন
করেছিল অষ্টাদশী শ্রীপর্ণা। ব্যাস, এটুকুই। তারপর অবিনাশ ভুলে গেছিল সবকিছু।
কিন্তু না। শ্রীপর্ণা ভোলে নি। তার মনের মণিকোঠায় অবিনাশের জন্য কি যেন একটা ভালো
লাগা কাজ করতে শুরু করেছিল। এখানে অবিনাশ সম্পর্কে একটু পরিচয় দেওয়া দরকার। অবিনাশ
দত্তগুপ্ত। নাগেরবাজারে বেশ পুরানো বনেদি পরিবারের এক শিক্ষক পরিবারের সন্তান। বয়স
ছাব্বিশ বছর। সদ্য একটি চাকরী জুটিয়েছে। ভালো চাকরী, বেতনও লোভনীয়। শান্ত শিষ্ট
অবিনাশ নিজের কাজের প্রতি দায়বদ্ধ হলেও নিজেকে সময় দিতে কখন বন্ধুদের সাথে কখনও
নিজে নিজেই বেরিয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায়। তা কাজের ফাঁকে অবিনাশের মুখটা
শ্রীপর্ণার মনের দর্পণে ভেসে উঠছিল বারেবার। একদিন, মাঝরাত্রে সুনন্দাকে ফোন করে
বলল
-এই শোন না, তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। তুই
কাল চট করে একবার সিটি সেন্টার চলে আয়। আমি কিন্তু অপেক্ষায় থাকব। ঠিক দশটায়। মিস
করলে এক লাথি খাবি।
শ্রীপর্ণা বলেছে মানে যেতে হবে সুনন্দাকে। এর
বাইরে অন্য কোন কথা চলবে না।
সারানিশি নিদ্রা জাগরণে মিলিয়ে কাটল
শ্রীপর্ণার। পরদিন সকাল সাড়ে নটার মধ্যে গিয়ে হাজির যথাস্থানে। সুনন্দা হাজির হতেই
তার হাত থেকে ছোঁয়া মেরে ফোনটা নিয়ে কললিস্ট ঘেঁটে নিয়ে অবিনাশের সেল নাম্বারটা
বের করে নিজের ফোনে কপি করে নিয়ে ডিরেক্ট ডিলিট করে দিয়ে তারপর থামল। সুনন্দাকে
বোকা বানাতে শ্রীপর্ণা বলে-
-ধুস, ভাবলাম তোর ফোনে ছবিটা আছে। কিন্তু
এখানেও নেই। এই নে রাখ......।
-কোন ছবিটারে পর্ণা?
-বাদ দে। খিদে পেয়েছে।চল কিছু খাওয়া যাক।
খানিক সময় কাটিয়ে সারপ্রাইজ সাসপেন্স রেখে
সেদিন শ্রীপর্ণা বেরিয়ে গেল।
সেই রাত্রে শ্রীপর্ণা ওই নাম্বারে প্রথম মেসেজ
করে। এরকম পরপর তিনদিন সৌজন্য মেসেজ পাওয়ার পর উল্টোদিক থেকে একটাই রিপ্লাই আসে।
-কে?
এতেই শ্রীপর্ণা বুঝে যায় অবিনাশ সাচ্চা ছেলে
আছে। এর সাথে বন্ধুত্ব করা যেতে পারে। তারপর মেসেজ, ফোনে কথা, চ্যাটিং, ফেসবুক,
হোয়্যাটসঅ্যাপ ইত্যাদির মাধ্যমে আলাপ, প্রেম গড়িয়ে ভালো লাগা থেকে একেবারে ভালোবাসায়
পৌঁছল। তারপর সময়ের স্রোতে ভেসে সেই ভালোবাসা ভালো বাসায় আশ্রয় দিল দুই
প্রেমিকপ্রেমিকা কে। অবিনাশের হাত ধরা সদ্য গ্র্যাজুয়েট শ্রীপর্ণা আর পড়াশুনা বা
চাকরীর চেষ্টা না করেই সংসারের সুখে ভেসে যেতে থাকে। দারুন প্রেম, ভালবাসার জোয়ারে
ভেসে অফিসকে টাটা বাই বাই জানিয়ে দুজনে সোজা হিমাচলের মানালিতে মধুচন্দ্রিমায়
নিশিযাপন করতেও ভোলে নি। দুই পরিবারের সম্পর্ক আর অবিনাশের সংসারে হাসিখুসিতে দিন
কাটে। এভাবেই সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। ঘটনার ঘনঘটা এক
সোমবার সন্ধ্যায় যখন অবিনাশ অফিস থেকে বাড়িতে ফিরল। এমনিতে সময়ের সাথে সাথে অবিনাশের
কাজের চাপ বেড়েছে। তাই ফিরতে একটু দেরি হয়। কিন্তু আজ শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে
একটু আগেই বাড়িতে চলে এসেছে। বিয়ের পর প্রায় দুবছর কেটে গেছে। ভালবাসার রঙ একটুও
ফিকে হয় নি, বরং তার প্রগাড়তা বেড়েছে। প্রতিদিনের ন্যায় সবকাজ ফেলে শ্রীপর্ণা এক
গ্লাস জল নিয়ে অবিনাশের সামনে হাসিমুখে দাঁড়াল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে শ্রীপর্ণার
মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। অবিনাশ কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
-কি হয়েছে পর্ণা? কোন সমস্যা? আমাকে বল? আমি কি
তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসায় তুমি কি খুশি হও নি?
শ্রীপর্ণা দৌড়ে এসে অবিনাশের বুকে চাপড়াতে
লাগলো আর হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। অবিনাশের কথা তার কানে যায় না। আবিনাশ বারবার
জিজ্ঞাসা করায় তখন অবিনাশের জামাটা টেনে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল।
-এসব কি? তোমার জামার সিঁদুরের দাগ কেন? তুমি
তলে তলে এতদূর? তাই তো বলি হটাত আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরা কিসের লাগি! সত্যি করে
বল তুমি আজ অফিসে গিয়েছিলে তো? নাকি অন্য কোথাও.........। এইসব নানান কথা বলে
শ্রীপর্ণা আবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। অবিনাশ নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে
ব্যর্থ মনোরথে প্রত্যাবর্তন করে। কোন কথায় শুনতে চাইল না শ্রীপর্ণা।
-আমার মানুষ চিনতে এত ভুল হল! হায় ভগবান! আমি
আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে পারব না। আমি আজই মা’কে ফোন করে চলে যাব। বৃথা এ
জীবন। কাউকে বিশ্বাস করতে নেই।
অবিনাশ মুহূর্তের মধ্যে বোকা বনে গিয়ে চুপচাপ
সোফার উপরে বসে মাথা নিচু করে থাকে। এদিকে শ্রীপর্ণার চিৎকারে পাশের ঘর থেকে
অবিনাশের বাবা মা এসে কারন জিজ্ঞাসা করলে শ্রীপর্ণা কিছুই বলে না। লজ্জায়, ঘৃণায়,
অপমানে চোখ লাল হয়ে যেতে লাগলো। অবিনাশকে জানতে চাওয়ায় তখন অবিনাশ বলতে থাকে।
-আমার শরীরটা আজ ভালো যাচ্ছিল না বলে আমি অফিস
থেকে একটু আগেই ফিরে আসি। বনগাঁ লোকালটা সামনে পেয়ে উঠে পড়ি। কিন্তু বিধাননগরে
নামার সময়ে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। আমার মনে হয় ঐসময় কোন মহিলা উঠতে গিয়ে ভিড়ের মধ্যে
তার কপালের সিঁদুরটা লেগে গেছে। সেটাই পর্ণা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইছে না।
সব কথা শোনার পর বাবা পাশের ঘরে চলে যায়। মা
ধীরে ধীরে শ্রীপর্ণার পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বলতে থাকে, ‘মা, তোমাদের মধ্যে কোন
বিষয়ে আমরা থাকি না। তবে আমার মনে হয় তোমার কোথাও বোঝার ভুল হচ্ছে। তোমার থেকে তো
অবিনাশকে আমি একটু বেশিদিন চিনি। তোমরা দুজনে একটু শান্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথা
বল। আমার মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।’ শ্রীপর্ণা কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে গোঙাতে
থাকে।
পরদিন সকালে উঠে শ্রীপর্ণা অবিনাশ ও তার বাবা,
মাকে জানায় যে সে বাবার বাড়িতে চলে যেতে চায়। অবিনাশের বাবা শ্রীপর্ণার বাবার
বাড়িতে ফোন করে ডাকে। ঘটনা শোনার পরে শ্রীপর্ণার দাদা ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নিলেও
মা বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে শ্রীপর্ণাকে নিয়ে যেতে চাইলেন। এত সুন্দর সম্পর্ক, সুখের
সংসার সব তছনছ হয়ে গেল শুধুমাত্র নিমেষের সন্দিগ্ধতায়। বিনা ডিভোর্সে সেপারেশান
হয়ে গেল দুজনের সাজানো বাগানের ফুটন্ত কলিদ্বয়।
মাঝে মাঝে হয়তো দুএকটা মেসেজ চালাচালি হয়েছে,
কিন্তু দুজনের দীর্ঘদিন আর দেখা হয় না। শ্রীপর্ণার রাগ আর অবিনাশের অভিমান দুজনকে
দুজন দূরে ঠেলে দিয়েছে। তাতে দুজনের দুরত্ব হয়তো বেড়েছে, সাথে সাথে অনুরাগ বেড়েছে।
কারন তাদের একাকিত্বে সুখস্মৃতিগুলো ভিড় করেছে। যাইহোক, সময় এগিয়ে যায়। শ্রীপর্ণার
দাদারা তাকে অবিনাশের কাছে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু শ্রীপর্ণার মা শ্রীপর্ণাকে মাথায়
তোলে।
শ্রীপর্ণা আবার পড়াশুনায় মন দেয়। চাকরীর
প্রস্তুতি নিতে শিয়ালদহে রাইসের মেন ব্রাঞ্চে ভর্তি হয়। বাড়িতে প্রিপারেশন চলে আর
রাইসের গাইড ও বন্ধুর সুনন্দার সহযোগিতায় একটা প্যানেলে জায়গা করে নেয় শ্রীপর্ণা।
মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। জীবন থেকে মানুষ জীবনের শিক্ষা গ্রহণ করে।
সেদিন শনিবার শ্রীপর্ণা রাইসে গেছিল। তখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসে নি।
কম্বাইন্ড কোর্সের পরীক্ষা দিতে গেছিল। ফেরার পথে শিয়ালদহ এসে দেখে কোন একটা
স্টেশনে দুঘণ্টা অবরোধের জেরে ট্রেন ইরেগুলার চলছে। প্ল্যাটফর্মে উপচে পড়া ভিড়।
যাইহোক, শ্রীপর্ণা একটা ট্রেনে উঠতে পারল, কিন্তু নামার সময় যুদ্ধ করে নামতে হল।
আজ রাইসের শেষ দিন। হাসিমুখ নিয়ে শ্রীপর্ণা বাড়িতে প্রবেশ করলে দাদা সুকোমল চমকে
উঠলেও ঠাণ্ডা মাথায় তাকে কাছে ডেকে বলে, ‘তুই একবার নিজেকে আয়নার সামনে গিয়ে দেখ
আর মাকে দেখা।’
-কেন রে দাদা? কি হয়েছে?
-তুই নিজেকে নিজে দেখ। তারপর যদি কোন প্রশ্ন
থাকে জিজ্ঞাসা করিস।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীপর্ণা। মাথার সিঁদুর
কোন কিছুর সাথে ঘসা লেগে কপালের একদিকে লেপটে আছে। মাথার সামনের চুলগুলো এলোমেলো। শ্রীপর্ণা
আর মা সবিতাদেবী ভাবছেন। এমন সময় দাদা গিয়ে শ্রীপর্ণাকে বলে।
-তুই ভেবে দেখ। আজ চার চারটে বছর ধরে অবিনাশের
মতো ছেলেকে যে কারনে এত কষ্ট দিয়েছিস সে যদি আজ তোর এইরূপ দেখে প্রশ্নবানে জর্জরিত
করে তোর কাছে দেবার মতো কোন উত্তর নেই।
-তুই বিশ্বাস কর দাদা, ট্রেনে আজ......।
-জানি, সব জানি। শ্রীপর্ণা, বাইরের জগতটা এতটা
সহজ নয় রে, যতটা তোরা ভাবিস ঘরে বসে। আজ বাইরে বেরিয়েছিস, তাই জানলি বলে। তোর এমন
উত্তর আসছে। আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এমন পরিস্থিতির স্বীকার ছিল অবিনাশ। তুই তার
কথা শুনতে চাস নি। তার মতো ছেলে বলে আজ চারবছর পেরিয়ে গেলেও সে বিয়ে করেনি বা
ডিভোর্সের কথা বলে নি। এখনও সময় আছে, অবিনাশের সাথে কথা বলে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে
তার কাছে ফিরে যা।
শ্রীপর্ণা সারারাত ভাবে। আর তার মায়ের কথা
মাথায় নেই। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে দাদার কথাগুলো তার কানে বিঁধছে। নিদ্রাহীন রাত
জেগে ভোর হবার আগেই শক্তহাতে ফোনটা হাতে তুলে নিল। রাগের জেরে যে নাম্বার ডিলিট
করে দিয়েছিল, অনুরাগের বশে সে নাম্বার মনের কোনে প্রথিত হয়ে ছিল। চোখের কোন কেঁদে
কেঁদে ভিজিয়েছে। নাম্বারটা ডায়াল করতে প্রথম কলেই অবিনাশ রিসিভ করে। যেন সে চারবছর
ধরে ফোনের দিকে দিবানিশি তাকিয়ে বসে ছিল এই ভেবে-এই বুঝি পর্ণার ফোন আসে। ফোন
রিসিভ করতেই শ্রীপর্ণা বলে ওঠে-
-কেমন আছো অবিনাশ.........শশশশশশশ। আমি আমার
ভুল বুঝতে পেরেছি। দুজনে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। তারপর সম্বিত ফিরলে শ্রীপর্ণাবলে,
‘অবিনাশ, তুমি আমায় নিয়ে চল তোমার কাছে। তোমার বুকে আমায় একটু জায়গা দাও। আমি
তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চায়। আই লাভ ইউ অবিনাশ। আই লাভ ইউ ভেরি মাচ।’
সবিতা দেবী মেয়ের কান্না শুনতে পেয়ে এসে মাথায় হাত
বুলিয়ে দিতে থাকে। শ্রীপর্ণা মাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।
পরদিন দাদা আর মায়ের সাথে শ্রীপর্ণা সোজা অবিনাশের বাড়িতে। শ্রীপর্ণা অবিনাশের
বাবা মায়ের কাছে ক্ষমা চায়। তারপর তো আপনাদের তো শুরুতেই জানিয়েছি। ওরা এখন
দ্বিতীয় হনিমুন করতে ডুয়ারসের জঙ্গলে। ওরা এখন আগের থেকে অনেক কাছের, অনেক আপন। আজ
শ্রীপর্ণা বুঝেছে প্রকৃত সুখের চাবিকাঠি কোথায়? শ্রীপর্ণা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে
সে চাকরীতে জয়েন করবে না। সংসারে থাকবে। অবিনাশের জন্য থাকবে। মাতৃত্বের স্বাদ
নিয়ে নারীর পূর্ণতা আস্বাদন করবে। আর কোন ব্যাপারে অবিনাশকে সে জ্বালাবে না। শুধু
প্রেম করবে সময় পেলে। এইজন্য মনে হয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলতেন, ‘দূরে
না গেলে কাছে আসা যায় না।’ যেমনটা অবিনাশ ও শ্রীপর্ণার জীবনে ঘটেছে। আজ ওরা
শক্তহাতে এই সম্পর্কের চারাগাছ নতুন করে রোপণ করেছে যা কেউ উপড়ে ফেলতে পারবে না।
চলুন এবার কেটে পড়ি, অবিনাশের সিগারেট শেষ আর পর্ণাও স্নান করে বেরিয়েছে। এবার
কিন্তু সিক্তবসনা শ্রীপর্ণা পিছন থেকে অবিনাশ কে জড়িয়ে ধরতে পারে। আপনারা যারা
আমার গুণমুগ্ধ পাঠক, তারা অন্তত চোখ বন্ধ করুন প্লিজ। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই
গল্পের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট চরিত্র ও ছবি সবই কাল্পনিক। ঘটনার মধ্যে কেউ যদি তাঁর
জীবনের বাস্তব ছবি প্রতীয়মান হতে দেখেন তাহলে অনুগ্রহপূর্বক এড়িয়ে যাবেন। ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment