Tuesday 23 January 2018

প্রসঙ্গঃ নেতাজী জন্মজয়ন্তী ও বাঙ্গালীর ভাবাবেগ -অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

প্রসঙ্গঃ নেতাজী জন্মজয়ন্তী ও বাঙ্গালীর ভাবাবেগ
-অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

আজ সকালে বেরিয়েছিলাম, দেখলাম একটি ক্লাবের সামনে নেতাজীর জন্মদিন পালনের লাগি বেশ আয়োজন। সবকিছুর সাথে দেখলাম নেতাজীর ছবির ঠিক উপরে বাঙলার বর্তমান জীবিত নেতা ও নেত্রীর ছবিও বিদ্যমান। তা আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা ভাই, তোমাদের কি প্রোগ্রাম আজ? বলল আজ পতাকা উত্তোলন করবেন আমাদের লোকাল নেতা। নেতাজীর জন্মদিন তো। বাচ্চাদের হাতে লজেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তারস্বরে মাইকে ডিজে হিন্দি গান বাজছে। রাত্রে পিকনিক হবে। ছাগলের মাংস দিয়ে। জানিনা তরলে তরঙ্গিণী হয়ে ভেসে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবে কিনা! এদের স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে শুরু করে সব উদযাপন নাকি এমন রূপ পেয়েছে। শুনলে, দেখলে লজ্জা ছাড়া আর কিছুই লাগে না। উল্টো করে পতাকা উত্তোলন আর ভুলভাল জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন এখন নিয়ম হয়ে গেছে। ভালো মানুষ ক্লাবে আর খুব একটা আসে না শুনলাম। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ক্লাবে সদস্যপদ নিতে বাড়ির ছাড়পত্র পায় না। এই হল আমাদের বাঙ্গালী।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে ভারতীয় রাজনীতির এক কুশলী নেতা মহামতি গোখেল বাঙ্গালী সম্পর্কে বলেছিলেন "what Bengal thinks today, India thinks tomorrow." একেবারে সঠিক কথা বলেছিলেন তিনি, সেটা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দেশপ্রেমে কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙ্গালী সর্বদা অগ্রদূতের ভূমিকা নিয়ে এসেছে। বাঙালীর সাহিত্য সাধনার গুনমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে ব্রিটিশ এর ভারত ছাড়ানোর গণ আন্দোলন ও গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়েছিল তা এই বাংলায় সুত্রপাত ঘটে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা আত্মবলিদান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে বেশীরভাগ বাঙ্গালী ছিল। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রাসবিহারী বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন সহ অগনিত দেশমাতৃকার বাঙ্গালী সন্তান ছিল এই মহাযুদ্ধের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বিন্য়-বাদল-দিনেশ, যতিন্দ্রনাথ, ক্ষুদিরাম, কানাইলাল, বটুকেশ্বর দত্ত, মদন মোহন মাল্যব্য, ভগৎ সিং সহ একগুচ্ছ বাঙ্গালী প্রান অকালে ঝরে গেছে।
সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা ও গান, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর প্রবন্ধ ও রচনা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে যথেষ্ট ভূমিকা নিয়েছিল। বলাই বাহুল্য, এই বাঙ্গালী কবি গীতাঞ্জলীকে সাথে করে বিশ্বকবি হয়ে উঠেছিলেন। বাঙ্গালী কবির রচিত সঙ্গীত ভারতসহ বিশ্বের আরও দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে আজও সম্মানিত। ভারতবর্ষের প্রথম নোবেল পুরস্কার আসে এই বাঙ্গালী কবির হাত ধরে। শুধু তাই নয় পরবর্তীকালে এই বাংলার ছেলে অমর্ত্য সেন নোবেলজয়ীদের তালিকায় ভারতের নাম লেখান। মাদার তেরেসা যে শান্তির জন্য নোবেল পেলেন তা কিন্তু এই বাংলা থেকেই। বাংলার সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা বিশ্বের দরবারে সমাদরে আজও গৃহীত। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বন্দে মাতরম জাতীয় স্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে বড় ভূমিকা নেয়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এর নেতৃত্ব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তাঁর জয়ে গান্ধীজী পর্যন্ত নেকনজরে দেখেছিলেন। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ক্ষুরধার বুদ্ধি, দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, ব্যক্তিত্ব, ত্যাগ, বিভিন্ন দেশের সাথে মিত্রতা স্থাপন, মোটা মাহিনার চাকরী প্রত্যাখান, আজাদ হিন্দ ফৌজ সেনা গঠন ব্রিটিশের শক্ত ভিত টলিয়ে দিয়েছিল। সুভাষ বোস থেকে নেতাজী হয়েছিলেন গান্ধীজীর থেকে অনেক বেশী ভূমিকা নেওয়ায়। সারা ভারতবর্ষের সকল প্রদেশের মধ্যে এই বাংলা বেশী বঞ্চনার শিকার।
শুধু আশ্রমে বসে ব্রিটিশের সাথে চুক্তি করে করে একজন জাতির জনক হয়ে গেল যার জন্মদিন জাতীয় ছুটি হিসেবে তকমা পেল আর আজ পর্যন্ত নেতাজী যিনি ব্রিটিশকে ভারত ছাড়া করলেন তাঁর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটি দিতে কেন্দ্র সরকারের টালবাহানার শেষ নেই। যার মৃত্যু নিয়ে তিনখানা কমিশন বসিয়ে আজও পর্যন্ত সঠিক কোন প্রমান দিতে গিয়ে রাজনীতির খেলা চলছে। একজন সব ত্যাগ করে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা দিলেন আর একজন জাতির জনক হয়ে গেলেন! ইতিহাসের ইতিহাস বলে জাতির জনক নয় জাতির কলঙ্ক গান্ধীজী। তিনি যদি নিজের স্বার্থ পূর্ণ করতে তৎপর না হতেন তিনি জাতির জনক হয়ে কোনদিন জাতির হাতে খুন হতে হত না। এই গান্ধী পরিবারের কারনে, স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার পরেও নেতাজীকে দেশে পরিকল্পনা করে ফিরতে দেওয়া হয় নি, কারন লর্ড মাউন্টব্যাটেন নেহেরুকে বলেছিলেন যে, ভেবে দেখুন নেতাজী যদি দেশে ফেরে তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রীর দাবীদার। আপনি কি চান তিনি ফিরে আসুন। নেহেরুও চায় নি, বলা ভাল জাতীয় কংগ্রেস কোনকালেই চায় নি। ব্রিটিশ তাকে চিনেছিল বলে তারা তো এখনও চায় না। ঐ গান্ধী পরিবারের কারনে আজ দেশ তিন টুকরো, ঐ গান্ধীজীর কারনে আজ এক দেশে দুটি নীতি। আলাদা সুযোগ সুবিধা নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীর পৃথক সংবিধান পেয়েছে ঐ গান্ধীজীর অনুপ্রেরনায়। সেখানে বিরোধিতা করেছিল কেবল বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পরিণামে তাঁকে নির্মম ভাবে মারার নির্দেশ দিয়ে বিদেশ ভ্রমণে চলে গেছিলেন নেহেরু। বঞ্চনা আর ষড়যন্ত্র। তারা কতটা দেশপ্রেমী ছিলেন তা জাতির হাতে গান্ধী পরিবারের দুই প্রধানমন্ত্রীর খুন এবং সঞ্জয় গান্ধির প্লেন ক্রাশে মৃত্যু প্রমান করে।
বাংলার ছেলে স্বামী বিবেকানন্দ সারা পৃথিবীর ধর্ম মহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করতে ভারত থেকে গেছিলেন এবং বিশ্বের তাবড় ধর্মগুরুদের সঙ্গে লড়াই করে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে বাংলা তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। আজও আমরা দেখি জাতীয় ক্ষেত্রে বাংলা বঞ্চনার শিকার। সৌরভ গাঙ্গুলি থেকে ঋদ্ধিমান সাহা বড় উদাহরণ।
বাঙ্গালী জাতি লড়াই করতে জানে আবার অন্যের উন্নয়নে ঈর্ষা করতে থাকে। তাই এই বাঙ্গালীর সঙ্গে প্রতারনা করার সাহস সকল জাতি দেখিয়েছে। কে কেমন সম্মান প্রদান করলেন তা না ভেবে আমরা বাঙ্গালীরা বাঙলার গর্বিত মৃত্যুঞ্জয়ী বীর সন্তানদের জন্য কুর্নিশ করি। আমাদের দাবী হবে নেতাজী জন্মজয়ন্তী জাতীয়ভাবে সাড়ম্বরে পালিত হোক। স্বামীজির জন্মদিবসে জাতীয় যুবদিবসের তকমা লাগাতে হবে। বাঙলার সন্তানদের কৃতিত্বকে কোন অংশে ছোট করা যাবে না। যাদের কারনে আজ শান্তিতে আমরা ঘরে শুয়ে এই প্রতিবেদন টাইপ করতে পারছি তাঁদের প্রতি আমাদের এই উদাসীন মনোভাব লজ্জার কারন বলে মনে করি। জয় দেশ মাতৃকার জয়, জয় ভারত মাতার জয়, জয় হিন্দ। নেতাজী লহ প্রণাম।

No comments:

Post a Comment

জগতের ধর্মগুরু লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র

  লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র   গল্পের নায়ক যেখানে কৃষ্ণ সেখানে বলে রাখা ভালো আধ্যাত্মিক নয়ন না থাকলেও যদি কেউ তাঁর বিবেক ...