Friday 13 November 2020

 জীবন দর্শন - ১

সনৎকুমার পুরকাইত


জীবন, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার গভীরতা কত? আমরা প্রত্যেকে নিজের জীবনে ঘটে চলা নিত্যদিনের ঘটনা দিয়ে তা পরিমাপ করে থাকি। কিন্তু আপেক্ষিকতাবাদের নিরিখে হয়তো তা কিছুই নয়। গত কয়েকমাস যাবত নিজের সাথে নিজের দীর্ঘলড়াই আর জীবনের স্বাদ গ্রহণ করার পাশাপাশি মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব হতে হতে একটা সময় মনে হয়েছিল জীবনের লড়াই এত কঠিন? কি হবে বেঁচে থেকে? তার সাথে নিকটজনের এক অভূতপূর্ব আচরণ দেখে জীবনে বেঁচে থেকেও মৃত্যুর কাঠিন্য অনুভব করে মনে হয়েছিল এর থেকে অনেক সহজ মৃত্যুপুরীতে ভ্রমণ করা। যখন সবকিছু অন্ধকার, নিজের সকল প্রাপ্তির মাঝে এ যেন এক অনিবার্য সর্বনেশে পরিণতি। একদিন একান্তে যখন এমন ভাবনা মাথায় ঘুরছে সেইসময় সামনে এল এক অসামান্য ছবি, যা দেখে মনে হল আমার এই যন্ত্রণা অনেক অনেক কম। ফিরে আসতে শুরু করলো জীবনের স্পন্দন টিকিয়ে রাখার মনোবল।

ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি পাহাড়ি হরিণ যখন সারাদিন দূর পাহাড়ে তৃণগুল্ম খেয়ে আশ্রয়ে ফিরছিল ঠিক তখন পাথরে পা পিছলে দুই পাথরের মাঝখানে এমনভাবে আটকে যায় যে সে শত চেষ্টা করেও আর উঠতে পারে না বরং আরও নিজেকে সেই পাথরের মাঝে হারিয়ে যেতে সাহায্য করে। লোভের বশবর্তী হয়ে এতদূরে সে চলে গেছিল যে কেউ সেখানে সচরাচর যায় না। যদি কোন প্রাণী যায় তারা তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করতে অক্ষম। তাই জীবনের যে কটা দিন সে বেঁচে ছিল, প্রতিদিন ক্ষুধাকে সঙ্গী করে বাঁচার জন্য প্রাণপণ চিৎকার, মৃত্যুকে সামনে দেখে হতাশ হয়ে রোদ, জল, ঝড়ের মাঝেই নিজেকে সঁপে দেওয়া আর সৃষ্টিকর্তার কাছে তার এই অপরিসীম লোভের জন্য অনুশোচনা করার মাঝেই তিলেতিলে প্রতিদিন মরেছে। যে ভদ্রলোক প্রথম দেখেছেন বা যিনি ছবি তুলেছেন তিনি হয়তো এই ভয়াবহ পরিণতি দেখে শিউরে উঠেছিলেন।

এখানেই প্রিয় পাঠকদের উদ্দেশ্যে জানাই যে গুরুকরণ করার সার্থকতা বর্তমান আছে ঐ ছবির মাঝে। যদি কোন মালিকের গৃহপালিত গরু ছাগলের মত এই হরিণ কারুর আশ্রয়ে থাকতো তাহলে দিনের শেষে যখন সে না ফিরত, নিশ্চয়ই তার মালিক তাকে খুঁজে ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। এমন যন্ত্রণাময় মৃত্যু তো দূরের কথা, একটুও মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে সইতে দিত না। ঠিক মানবজীবনের এই দিশাহীন চলার পথে যদি সঠিক গুরুর সঠিক মার্গে আমরা অবস্থান করে আমরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়ে থাকি তাহলে আমরাও জীবনের স্বাদ আর মৃত্যুর গহন অন্ধকার অনায়াসে এক করে দিতে পারবো। আশ্রয় হয়ে শরণাগত হলে তবেই পূর্ণ সাত্ত্বিক জীবনের স্বাদ মেলে। নইলে কুকুর বিড়ালের মত ইতর প্রাণের মত মানুষের মহামূল্যবান জীবন দগ্ধে শেষ হবে শুধু অহমিকার জালে।

শাস্ত্রমার্গ অনুসারে জীবনের আনন্দ এতটাই বেশী যে মানুষ মরতে ভুলে যায়, মৃত্যুতে ভয় পায়। মানুষ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সেই অন্ধকার কূপে মাথানত অবস্থায় কাঁদতে কাঁদতে বলে, হে প্রভু, তুমি আমাকে এই অন্ধকার কূপ হতে উদ্ধার করো, আমি তোমার গুণকীর্তন করবো। সেই ডাকের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, তার ফলশ্রুতি হিসাবে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে আসে আলোর মাঝে জীবনের স্বাদ নিতে। কিন্তু ধরাতে এসে এত আলো পেয়ে যায় যে পূর্বের প্রতিশ্রুতি সব ভুলে গিয়ে নিজের সামর্থ্য নিয়ে বড়াই করতে করতে জীবন চলে যায়। সেই জীবনে থাকে শুধু অহমিকা আর সুখের সাগরে থেকে অ-সুখের যন্ত্রণা। ঠিক তখন আবার স্মরণ করে সেই তৃতীয় পুরুষকে। এভাবেই চাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে কষতে প্রকৃত জীবনের মানেই বোঝেই না অনেকেই।

জীবন যখন নিজের খেয়ালে চলে, সবকিছু প্রত্যাশামত প্রাপ্তি হয় তখন মনে হয় জীবন কত সুন্দর। মনে আসে বাঁচার আনন্দ। আর এই বাঁচার আনন্দের মাঝে ধীরে ধীরে তৈরি হয় জীবনমৃত্যুর প্রভেদ এবং সঠিক মার্গে থাকতে থাকতে মানুষের জাগ্রত হয় এক নবচেতনা, যে চেতনার সাহায্যে পার্থিব সকল বিষয় থেকে নিজেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অধিকারী হয়ে ওঠে এক অপূর্ব অলৌকিক ক্ষমতার। যে ক্ষমতা তাঁর নিজের পরিশ্রম আর অধ্যয়নের মধ্যে দিয়ে অর্জন করে তাঁর মধ্যে আসে বিনয় ও তিতিক্ষা। সেখানেই তিনি জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পারেন জীবন আর মৃত্যুর মাঝে কোন পার্থক্য নেই।

ঠিক সেদিন থেকে আপনি পেতে শুরু করেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। একজন আপনার পাশ থেকে সরে গেলেও আপনার চারিদিকে শুভাকাঙ্ক্ষীর বলয় তৈরি হয়। আপনার জীবনবোধের তেজ সহ্য করতে না পারলে দুরাচারী, পাপাচারী, ব্যাভিচারি আপনার সংসর্গ ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু, যারা এই মার্গ সন্ধানে ছিল, তারা আপনার মানবসত্ত্বাকে উপড়ে ফেলে প্রদান করে দেবত্ব। সেইস্তরে বাঁচামরা সবেতেই আপনার হাস্যবদন পরিলক্ষিত হবে। ভালোবাসা, প্রেম, প্রীতি, সহানুভূতি, দয়া, মায়া এসকল আবেগের মাঝে মানুষের বেঁচে থাকা। যখন এই আবেগ কেটে গিয়ে বেগ আধিপত্য বিস্তার লাভ করে তখন ফুটে ওঠে অহমিকা আর অপরকে ছোট করার বাসনা। সেখানেই পৃথক হয়ে যায় মানুষের বেঁচে থাকার স্বাদ আস্বাদনের মহিমা।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত

© সনৎকুমার পুরকাইত


জীবন দর্শন - ২


গত রাত্রে একটা গান শুনলাম, সেই গানের কথাগুলো এখানে ছবির সাথে তুলে দিলাম। সম্ভবত গানের গীতিকার ও শিল্পী ধ্রুব মহাশয়। সঙ্গীতের মধ্যে লেখা থাকে জীবনের কথা কারণ সঙ্গীত হল সমাজ জীবনের দর্পণ আর সেটা যদি হয় লোকসঙ্গীত। এই সঙ্গীতের কথায় জীবনের একটা দর্শন ফুটে উঠল। যে পাখি উড়ে যেতে চায়, তাকে আটকে রাখতে নেই। উড়ন্ত বিহঙ্গ হয়ে যে এসেছে ধরায়, তার জন্য এই বিশ্বচরাচর উন্মুক্ত করে দেওয়া ভালো। একটা সময় তার পক্ষদ্বয় ক্লান্ত হবে, সেদিন সে আর তার উৎসমূলে ফেরার ক্ষমতা রাখে না। এখানে আমরা দেখতে পাই যে পাখি তার মত বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে তবু সে প্রেমের বন্ধন স্বীকার করবে না। দশ দুয়ারে ঘুরে ঘুরে যে শত শত মন দখল করে তাকে কি দরকার এই মনের খাঁচায় আবদ্ধ করার। তাকে ছেড়ে দাও বিশ্বসংসারের জন্য। হয়তো তার অনেক বড় কাজের দায়িত্ব রয়েছে।

এই বিশ্বসংসারে এমন কিছু মানুষ আসেন যারা কোন ব্যক্তির জন্য আসেন না, আসেন জগতসংসার কে উদ্ধার করতে। এমন অনেক মহাপুরুষ আছেন যারা নিজ স্বার্থ পরিত্যাগ করে জগতের কল্যাণে নিজেকে করেছেন উন্মুক্ত। তাঁদের নিজেদের কথা নিজেরাও ভাবার সময় পান নি। আমরা দেখেছি শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু জগতে প্রেমসুধা বিতরণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন অস্থির সমাজ ব্যবস্থাকে রুখতে। তিনি ঘরে কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করে চলে গেছিলেন। একাকিনী বিষ্ণুপ্রিয়া বা মাতা শচীরানী তাকে সোনার খাঁচায় আটকে রাখেন নি। তাঁর প্রেম জগতের জন্য, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে সীমাবদ্ধ থাকার জন্য নয়। আবার ভগবান বুদ্ধ সকল প্রকার রাজসিক সুখ পরিত্যাগ করে সমাজের কল্যাণে নতুন মার্গ সন্ধান করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন এক নতুন জীবনে। সেখানেও গোপা বা গোতমী কেউ বাধা দেন নি। তাঁরা এসেছিলেন অনেক গুরু দায়িত্ব পালন করতে। তাঁদেরকে আটকে রাখা যায় না।

কিন্তু, পক্ষান্তরে কিছু কিছু মানুষ আবার অহমিকার জালে আবদ্ধ হয়ে এই সংসার থেকে চ্যুত করেন নিজেকেই। উদ্দেশ্য আরও আরও সুখ, আরও আরও প্রাপ্তি। লোভ, লালসা, মোহ, বাসনা আর কামনার আগুনে পুড়তে পুড়তে কখন যে বিপথগামী হয়ে নিজের ক্ষতি নিজে ডেকে আনেন তা তাঁরা নিজেরাই জানেন না, বলা ভালো সেই কাণ্ডজ্ঞান তাঁদের থাকে না। তাঁদের কাছে মনে সময় অফুরন্ত, সময়ের সাথে একটু খেলা করা যেতে পারেই। কিন্তু আমরা সবাই যে সময়ের দাস সেটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। যৌবন মদমত্তা উন্মত্ত হস্তির ন্যায় ঘুরে বেড়াতে চায় এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। তারপর একদিন সময়ের কাছে হার মানে সকল বাহ্যিক দশা। সেদিন খুঁজতে বসেন অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত শক্তির দিকে। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে না করলে সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয়।

প্রসঙ্গক্রমে, একদিন এক পাখি বন্দরের পাশ দিয়ে উড়ে যেতে যেতে দেখল এক বিরাট জাহাজ নোঙর করা আছে ঘাটে। তার বাসনা হল সে জাহাজের মাস্তুলে বসে সব কিছু উপর থেকে দেখবে আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে জীবন। বেশ, সাথীদের ত্যাগ করে বিপথগামী হয়ে চলে গেল জাহাজের মাস্তুলে। এভাবেই বসে থাকতে থাকতে একটা সময় জাহাজ জেটি ত্যাগ করে দূরদেশে পাড়ি দিতে এগোতে থাকল। তবুও সেই পাখি মাস্তুল ত্যাগ না করে চারপাশের দৃশ্য দেখতে লাগলো। একটু একটু করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাখি ভাবছে এত ব্যস্ততার কি আছে ঐ তো তীর দেখা যাচ্ছে, একটু পরে উড়ে গিয়ে সাথীদের সাথে ভিড়ে যাবে। আরও এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে। পাখি এখন আর তীর দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু অহমিকা আর লালসার জোরে এখন আর তীরের কথা না ভেবে, ভাবছে এই তো উত্তর দিকে তীর ছিল তো। যাচ্ছি একটু পর। এ তো বেশী দূর নহে, এর থেকে অনেক বেশী দূরে উড়েছি। নিজের সামর্থ্যের উপর পূর্ণ বিশ্বাস। কিন্তু, ক্ষনিক পরে পাখির সম্বিৎ ফিরতেই উড়তে শুরু করল উত্তর দিকে। অনেকটা উড়ে যাওয়ার পরে তীর দেখতে পেল না, আবার এদিকে জাহাজও এগিয়ে চলেছে। জাহাজকে হারাতেও চাইছে না এই মাঝ সমুদ্রে। একটু একটু করে উড়ে যায় আবার ফিরে এসে বসে সেই মাস্তুলে। এভাবে উত্তর ছেড়ে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিন দিকে গিয়ে তীরের সন্ধান না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে মাস্তুলে এসে বসে ভাবতে থাকে এবার কি করণীয়। মহাজন বলছেন কিছুই করার নেই, যেদিন সামর্থ্য ছিল, সেদিন সময় থাকতে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে অহমিকার পাখায় ভর করে শুন্যে উড়ছিলে। আজ তুমি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত। তুমি না পারবে উৎসে ফিরতে, না পারবে তোমার স্বপ্নের মাস্তুলে বসে জীবন কাটাতে। একটাই মার্গ, সে হল মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সাথে সাথে প্রকৃত জীবন দর্শন। মৃত্যুই তোমার পথ।

ঠিক তেমন এই জগত জীবের কাছে সঠিক সময়ে সঠিক মার্গে নিজেকে প্রতিস্থাপিত না করতে পারলে ঐ পাখির মত সুখের ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে একদিন প্রকৃত সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে হারিয়ে যেতে হবে এই বিশ্ব সংসার থেকে। তাই তো গীতিকার বললেন, পাখিটার এমন স্বভাব/ নিজের অভাব পূরণ করে নিজের মত/ পাখিটা হাসে খেলে অন্তরালে/সুনিপুন করে কত। ফলে নিজের সুখ পেতে গিয়ে সবাইকে করে অসম্মানিত আর সেই ক্ষনিকের সুখ থেকে হারিয়ে যায় চিরকালের মত। জীবশিক্ষার প্রধান অঙ্গ নীতিশিক্ষা। সেটার মধ্যে বিরাজ করে ত্যাগ, তিতিক্ষা, বিনয় আর প্রেমের উজ্জ্বল শিখা। তা যদি একবার আত্মস্থ করা যায় পাওয়া যায় পরমসুখ, আসে পরাবৈদিক শান্তি। খুঁজে পায় জীবনের মানে, এভাবেই জীবনকে করে সমৃদ্ধ। মৃত্যুর মাঝেও অমরত্ব লাভ করে দৃষ্টান্ত হয়ে যায়। আপনার জীবন আপনি কেমনভাবে কাটাবেন, সেটা আপনার জীবন দর্শনের উপর নির্ভর করবে।

© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল সার্চ
গানের কথাঃ ধ্রুব
গানের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=8_b7Ueg2Xn0


জীবন দর্শন - ৩

প্রিয় পাঠক, এর আগের একটা পোস্টে আমি বলেছিলাম যে বটগাছের থেকে জীবের জীবন দর্শন পাওয়ার আছে। অনেক ছাত্রছাত্রী ও পাঠকের আবদারে সেই তত্ত্ব আজ প্রকাশ করতে এলাম। আগেও বলেছি ভণ্ডামি আর গোঁড়ামি বাদ দিলে আমাদের ধর্মীয় বিধান আর নীতিশাস্ত্রের নির্দেশ জগতজীবের কল্যাণের মার্গ করে উন্মোচন। সেই পথে আমরা যদি এগিয়ে চলতে পারি জীবন হবে নিয়ন্ত্রিত, যুক্তিসম্মত ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য নমস্য। বাইরে থেকে দেখলে এইসকল বিষয় অনেকের কাছে এক তথ্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু অন্তর দিয়ে অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন করলে এর মধ্যে নিগুঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারবেন। খুঁজে পাবেন জীবন গঠনের আসল রসদ, সে আপনি যে ধর্মে বিশ্বাস করুন না কেন, চলার পথ ভিন্ন হলেও গন্তব্য সবার এক। এবার যে যেমন মার্গে নিজেকে প্রতিস্থাপিত করেন তাঁর গন্তব্যে পৌঁছাতে তেমন সময় লাগে।

এবার আসি আসল কথায়। আমরা সবাই বটগাছ চিনি, মানে দেখেছি। বিশেষ করে যারা গ্রামে থাকি তাঁরা সবাই এই বটগাছের মহিমা অন্তর দিয়ে জানি। এই বটগাছ হল আমাদের আশেপাশে যত বৃক্ষ দেখা যায় সে সকল বৃক্ষের শ্রেষ্ঠ বৃক্ষ বলে পরিগণিত। কিন্তু মজার বিষয় এত বড় বৃক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এই বটবৃক্ষের নীচে কোটি কোটি বটের বীজ পড়ে থাকলেও একটা বটের চারা জন্মায় না। বিজ্ঞান এর কারণ হয়তো অন্যভাবে বের করবে কিন্তু আমি আজ আলোচনা করবো একটা রূপক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। আপনারা ভাবুন কেউ দেখেছেন কোনদিন যে বটের তলায় কোন বটের চারা জন্মাতে? দেখেন নি, দেখবেনও না। কিন্তু ঐ বটের বীজ যদি কোন পক্ষী ভক্ষন করে বিষ্ঠা ত্যাগ করে এবং সেই বিষ্ঠা যদি গাছের ডালে কিংবা কংক্রিটের ছাদে গিয়ে পড়ে সেখানে দেখা যায় বটের চারা জন্ম নিয়েছে অর্থাৎ বটের বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটেছে। সেখানে জীবনের নিয়ম অনুযায়ী মৃত্তিকা বা জলের সদা উপস্থিতি না থাকলেও চলে। আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন পুরানো মন্দির বা বাড়ির দেওয়াল, ছাদ বা গাছের ডালে এহেন বটের গাছ বিদ্যমান থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় পরবর্তীকালে এই বটগাছের বিকাশের সাথে সাথে সেই বাড়ি বা প্রাচীন মন্দির ধ্বংস হতে বসেছে। এবার নিম্নগোত্রীয় উদ্ভিদের ক্ষেত্রে যেমন খেজুর, তেঁতুল বা আম, জামগাছ ইত্যাদির বীজ সেই গাছের নীচে পড়লে সেখানে তার অঙ্কুরোদগম ঘটে থাকে স্বাভাবিক নিয়মে। ব্যতিক্রম এই বটবৃক্ষের ক্ষেত্রে। এর থেকে কোন জীবন দর্শন উঠে আসে? আসুন এবার জেনে নিই।

একদা ক্লাস নিতে গিয়ে একটি ধনী পরিবারের ছেলে বলেছিল যে স্যার আমার কলেজে না আসলেও চলে, কারণ আমার বাবা ইচ্ছে করলে আমার জন্য সব বিষয়ে এক একজন গৃহশিক্ষক রাখতে পারেন। সে ছেলের মধ্যে প্রচুর দাম্ভিকতা, অর্থের অহমিকা। পিতার সুত্রে প্রাপ্ত। সেইক্ষেত্রে এই বটবৃক্ষের দর্শন পুরোপুরি কার্যকরী। আমরা যারা উচ্চপদাধিকারীর সন্তান, কেউ আমরা যেমন বড়াই করে বলতে পারি না যে আমি আমার বাবার মত পদাধিকারী হবই হব, তেমনি কোন উচ্চপদাধিকারী পিতাও গর্বের সাথে বলতে পারেন না যে আমার সন্তান আমার মত শিক্ষক, অধ্যাপক, ডক্টর কিংবা ব্যারিস্টার হবেই হবে। তিনি ভালোবেসে বলতে পারেন যে আমি আমার সন্তানকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করবো যাতে সে আমার মতো ডক্টর হতে পারে। এটা হল তাঁর ইচ্ছে, অধিকার নয়। কিন্তু, যে পিতা চা দোকানদার, ভ্যানচালক কিংবা সব্জিবিক্রেতা, তাঁদের সন্তান কিন্তু না চাইলেও তাঁদের মত হয়ে যেতে পারে ঠিক ঐ আম, জামের মত নিম্নগোত্রীয় বৃক্ষের মত। কঠিন সদিচ্ছা আর একান্ত সাধনার বলে বলীয়ান হলে তবে দেখা যায় অন্যথা ঘটে থাকে। ঘটেও, অনেক পিছিয়ে পড়া পিতার সন্তান আইএএস অফিসারও হয়েছেন। সেটাই তাঁদের সাধনা।

ঐ বটের বীজ যেমন পাখির পেটের মধ্যে যে তাপমাত্রার সংস্পর্শে এসে যেমন অঙ্কুরোদগম হয়, ঠিক তেমন আপনার যতই টাকা থাকা প্রতিপত্তি থাক আপনার সন্তানকে শিক্ষা নামক আঙ্গিনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানস্বরূপ পাখির পেটের মধ্যে শিক্ষকের জ্ঞানরূপ তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসার মধ্যে দিয়ে আপনার সন্তানের প্রতিষ্ঠা মিলবে। যারা কেবল অর্থের অহমিকা ছেড়ে এই নৈতিক শিক্ষার মধ্যে থেকে এগিয়েছেন তাঁরা পিতার থেকে আরও বড় পদাধিকারী হয়েছেন। তাই শুধু পিতৃপরিচয় দিয়ে নিজের জায়গা করা যায় না, নীতিশিক্ষা আর আদর্শকে অবলম্বন করে বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর মাঝে নিজেকে তৈরি করতে হবে। সেখানে আসেন ভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন সংস্কৃতির ধারক বাহক। সেই সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে হবে আর তাতেই স্নান করে নিজেকে পবিত্র করলে অর্থের অহমিকার সাথে নিজের সঙ্কীর্ণতা দূর হবেই হবে। সেদিন একজন অধ্যাপক, ডক্টর, ব্যারিস্টার চিৎকার করে বলতে পারবেন, নিশ্চিন্ত হতে পারবেন যে আমার সন্তান আমার মতই হবে, যেদিন বটবৃক্ষের তলায় বটের বীজ পড়ে বটের মত বিরাট মহীরুহের জন্ম, বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে। শুধু বড় হলেই তো হয় না, বড় মন থাকা চাই। তাই তো ঠাকুর রামকৃষ্ণ বললেন, ওরে নরেন বটগাছের মত হয়ে ওঠ, যেখানে সংসার জ্বালায় পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া জীব এসে একটু শীতল ছায়ার জন্য আশ্রয় নেবেন। কাঠবিড়ালি বা পাখির মত কিছু প্রাণী এসে মলমুত্র ত্যাগ করলেও কোন ক্ষতি নেই। নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে গেলে কাঠবিড়ালি বা পাখির মতো যে সকল মানুষ আপনার মনকে বা জীবনকে নোংরা করতে আসে তাঁদেরকে এড়িয়ে যান, কারণ আপনার ছত্রছায়ায় অনেক মানুষ উপকৃত হন। তাঁরাই আপনার জীবন ও কর্মকে বাঁচিয়ে রাখবেন। আপনি মরেও বেঁচে থাকবেন। এই দর্শন আপনাকে অমরত্ব প্রদান করবে।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

প্রিয় পাঠক আজ একটি প্রশ্নের উত্তর আপনাদের সবার সামনে তুলে দিলাম। হয়তো এমন প্রশ্ন অনেকের মনে ঘোরাফেরা করে।
#প্রশ্নঃ আচ্ছা, প্রবাদ কথা অনুযায়ী কর্মই যদি ফল হয় তবে- বৃদ্ধাশ্রমের মানুষদের কোন কর্মের ফল? বা একজন ঘুষ দেওয়া চাকরীধারী(প্রতিযোগিতার যোগ্যতা ছাড়া উত্তীর্ণ) তিনি কোন কর্মযোগের ফল? একটু বৃত্তান্ত যদি বলা যেত.........
#উত্তরঃ দেখ অভিজিৎ, এই জগতে কারণ ছাড়া কোন কাজ সম্পন্ন হয় না। যা কিছু প্রবাদ প্রবচন তার কিছুটা আঞ্চলিক জনজাতির মুখে মুখে রটেছে। তার পিছনে সংস্কার থাকতে পারে যেমন, তেমন লুকিয়ে থাকতে পারে যুক্তিবাদ। কিছু আছে খনার বচন, কিছু আছে চাণক্যের শ্লোক। তার বাইরে বর্তমান আছে শাস্ত্রের বচন। যেমন কর্ম তেমন ফল যদি বলো, তাহলে সেই সত্যতা রয়েছে বটে। কর্মের উপর বিচার করে চিরকাল ফলাফল তৈরি হয়ে এসেছে। সে কুকর্ম হোক আর সুকর্ম, সব কর্মের একটা ফল আছে।
তোমার বক্তব্য অনুযায়ী, বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় মানুষের কি দোষ? তাঁরা কোন কর্মের ফলে এমন দোষে দুষ্ট? সকল পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি মানুষ বৃদ্ধ হলে তাঁকে দেখভাল করেন তাঁর সন্তান। কিন্তু সেই সন্তান যদি ঠিকঠাক নৈতিক শিক্ষায় না বড়ো করতে পারেন, তাহলে সে সন্তান বাবা মা কে বৃদ্ধকালে দেখেন না। নিজে না প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে, সেই সন্তান উচাটন হয়ে যায়, সমাজের মূল স্রোত থেকে ছিটকে যায়। জড়িয়ে পড়ে অত্যাচার, অনাচার আর ব্যাভিচারে। সে সন্তান হয় দুরাচার, সমাজবিরোধী। তাঁর কাছ থেকে সেবা প্রত্যাশা করা একেবারে অন্যায়। যে সন্তান নিজে খেতে পায় না, তাঁর নৈতিক শিক্ষা থাকলে নিজে না খেয়ে বাবা মা কে খাওয়াবেন। নইলে সম্পদের প্রাচুর্যে ডুবে থেকেও বাবা মা কে বঞ্চিত করবে জীবনের সুখ থেকে। সে সন্তান অন্ধ। যে নিজে চোখে দেখতে পায় না, সে কি করে অন্যকে আলো দেখাবে? সন্তানকে এমনভাবে মানুষ করতে হবে যে লোকের কাছে তাঁর জন্য বাহবা পাওয়া যাবে, আর সেই কারণে জন্মদাতা হয়ে উঠবে বাবা। সব জন্মদাতা কিন্তু বাবা হয় না। এখানেই কর্মের ফের। কর্ম যদি ঠিক থাকে তাহলে সুফল পাবেন।
.
আবার আপনি দেখবেন, কোন বৃদ্ধ বাবা মা যদি যৌবনে তাঁর বাবা মাকে সন্তানের সামনে নিগ্রহ করেন কিংবা দায়িত্ব অস্বীকার করে নিজ সুখ চরিতার্থ করতে ব্যস্ত থাকেন। সেক্ষেত্রে সেই শিশুমন তেমন রুক্ষ্ম স্বভাব অর্জন করতে থাকেন। সেদিন সেই পিতামাতা ভাবেন না যে তাঁরাও একদিন বৃদ্ধ হবেন, সমস্ত সামর্থ্য হারিয়ে একদিন তাঁদের সন্তানের দারস্থ হতে হবে। সেদিনের সেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা না করায়, তাঁদের ভবিষ্যতের আলো দায়িত্ব নিয়ে তাঁরা নিভিয়ে দেন। এবার আসি উল্টোপুরানে, সন্তান সুপ্রতিষ্ঠিত, উচ্চ আয়, বিদেশে থাকেন। ফলে বাবা মা কে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে হয়। এক্ষেত্রেও সন্তানকে প্রতিষ্ঠা ও উপার্জনের যন্ত্র তৈরি করেছেন, সমাজবদ্ধ জীব তৈরি করেন নি। টাকা আছে, আবেগ নেই। যোগাযোগ আছে, সংযোগ বিচ্ছিন্ন। এর পশ্চাতে কিন্তু অবস্থান করে সেই যৌবনের পিতামাতা। তাঁদের কর্মের ফেরে ফল ভোগ করতেই হয় তাঁদের।
অনেক মানুষ নিঃসন্তান থেকে যান শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে। তাঁদের অনেকেই আবার অন্যের সন্তানকে দত্তক নেন। সেক্ষেত্রেও দেখা যায় তাঁদের অনেককেই বৃদ্ধাশ্রমে কাটাতে হয়েছে শেষ জীবন। কেন? সেখানেও দেখা যায় তিনি সেই দত্তক নেওয়া সন্তানকে কোন একটা স্বার্থপূরণে এনে পালন করেছিলেন। তাই তাকে কোনদিন মন থেকে আপন করতে পারেন নি। দেন নি প্রকৃত শিক্ষা। ফলে সেই সন্তান বড় হবার সাথে সাথেই পালক পিতা মাতা অপেক্ষা প্রতিবেশীর কথা শুনে চলতে বেশী পছন্দ করেন এবং বিশ্বাস করেন যে তিনি ঐ পিতামাতার সন্তান নন। ফলে তাঁর মনে জন্মায় একটা বীতশ্রদ্ধ মনোভাব। ভেঙ্গে যায় বাবামায়ের এতদিনের স্বপ্ন। আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, এপিজে আব্দুল কালাম, রতন টাটা প্রমুখের সন্তান ছিল না। কারণ এঁদের মধ্যে প্রথম দুজন বিয়ে করলেও আধ্ম্যাত্মিক জগতের ডাকে সাড়া দিতে ডুবে যান ভাবসাগরে আর পরের তিনজন তো বিয়েই করলেন না। সেক্ষেত্রে তাঁদের জীবনে এই বৃদ্ধাশ্রম বা সন্তানের অভাব যন্ত্রণা লাগে নি। কারণ সমাজের প্রতি এরা এতটা দায়বদ্ধ ছিলেন যে এই অভাব পূরণ করে দিয়েছিলেন শতসহস্র গুণমুগ্ধ ভক্ত। তাঁরা নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে আসেন নি, তাই তাঁদের এই বিশ্বসংসারের পার্থিব জ্বালা স্পর্শ করতে পারে নি। রতন টাটা এখনও বেঁচে। তিনি এধরণের কাজে এখনও লিপ্ত। অন্যেরা তো বার্ধক্যে পৌঁছালেন না, কর্ম জগতে থাকতে থাকতে চলে গেলেন। জন্মই সন্ন্যাস, কর্মই ধর্ম আর মৃত্যুই ত্যাগ। তাই কর্ম করার সামর্থ্য যতদিন তাহা অপেক্ষা বাঁচার মধ্যে কোন মহিমা নেই। তখন গলগ্রহ হয়েই থাকতে হয়।
নীতিশাস্ত্র যারা মেনে চলেন নি তাঁরা নৈতিক জ্ঞানের স্পর্শ যেমন পান নি, তেমন পরবর্তী প্রজন্মকে তা প্রদান করতে পারেন নি। মহাজন বলেন, আমরা অতীতের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হয়ে বর্তমানের আলোকে আলোকিত হয়ে ভবিষ্যতের পথে পাড়ি দিতে থাকি। তাই যার অতীত ভালো না, তিনি যদি বর্তমানটা নিজের চেষ্টায় ভালো না করে তাঁর ভবিষ্যৎ ঘুণাক্ষরে ভালো হয় না। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি ভালো না হয়, তাহলে তাঁর থেকে বর্তমান প্রজন্ম কিভাবে নৈতিকতা প্রত্যাশা করতে পারে? তাই এমন জীবনচর্চা করতে হবে যাতে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যেন স্বামীজি বা আব্দুল কালাম মহাশয়ের মত কর্ম করে যেতে পারা যায়। সেখানেই মানুষের বেঁচে থাকা। কর্মের মাঝে মানুষের অমরত্ব। আমরা যারা এই পোষ্ট পড়লাম, চেষ্টা করব নিজেদের পিতামাতাকে সেবা করার এবং আমাদের সন্তানদের সেই সেবার শিক্ষা প্রদান করার। ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
(পরের প্রশ্নের উত্তর পরের পর্বে ............)
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ফেসবুক
© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত
পূর্ব প্রকাশিতের পর.........
প্রিয় পাঠক, এবার আসি গতদিনের প্রশ্নের দ্বিতীয় পর্বে।
#প্রশ্নঃ একজন ঘুষ দেওয়া চাকরীধারী (প্রতিযোগিতার যোগ্যতা ছাড়া উত্তীর্ণ) তিনি কোন কর্মযোগের ফল? অর্থাৎ যোগ্যতা ছাড়া ভেট দিয়ে চাকরি মেলে কোন কর্মফলে?
#উত্তরঃ আবারও বলি এই জগতে যা কিছু ঘটে তার পশ্চাতে কোন না কোন কারণ থাকে। আর কর্মফল সে তো কর্মের বিধি অনুসারে হয়ে থাকে। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কর্মফল বা ভাগ্য বলে স্থিতিশীল কিছু নেই। জীব প্রতিমুহূর্তে তা নির্মাণ করে জীবের বর্তমান কর্ম ও নির্ণয়ের মাধ্যমে। এই প্রশ্ন শুধু অভিজিৎ বা মৃত্তিকার নয়, শত সহস্র পিছিয়ে পড়া মেধাবী ছাত্রসমাজের প্রশ্ন। কালে কালে, দেশে দেশে এ প্রশ্ন চিরকাল ছিল, আছে ও থাকবে। তবে মূলপ্রশ্নের সাপেক্ষে বলি চাকরিপ্রাপ্তির এই ফল অনেকটা দাতা আর গ্রহীতার রসায়নে তৈরি। এখানে দেখা হয় যে কোন পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হচ্ছে? সাধারণ নিয়মে সংশ্লিষ্ট নিয়োগের বিজ্ঞাপনে যে সকল নিয়ম নির্ধারণ করা হয়, সেটাই যোগ্যতা বলে ধরা হয়। তার বাইরেও যদি নিয়োগ পান তাহলে গ্রহীতার থেকে দাতা বেশী অপরাধী। কারণ তিনি বিধান ভেঙ্গে অন্য নিয়োগবিধি তৈরি করে অপরাধ করলেন। তার এই কর্মফল পরে পেতে হবে।
কিন্তু, প্রশ্ন উঠবে অযোগ্য প্রার্থী যে চাকরি পেয়ে গেলেন কোন কর্মের ফেরে? সেখানে একটা কথা মাথায় রাখবেন, নিয়োগকর্তা যে পিছনের দরজা খুলতে পারেন সেই কাণ্ডজ্ঞান তাঁর ছিল এবং সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে তিনি টাকাও গুছিয়েছেন এবং ঠিক লোকের সন্ধান করে তার হাতে সেই ভেট গুঁজে দিয়েছেন। এখানে আপনি যদি তা না পারেন তাহলে আপনি এই চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ। অন্যায়, অপরাধ, অনাচার বা দুরাচার সেগুলো পৃথক আলোচনা। সেইহেতু এখানে কিন্তু ঐ প্রার্থীর কোন অপরাধ হল না, কারণ তার দরকার চাকরি। তিনি যেভাবে পেতে হয় সেই চেষ্টা করবেন। এবারে নিয়োগকর্তা যদি একটা প্রচ্ছন্ন বিধানের সাথে অপর একটি বিধান প্রকট করেন, আপনাকে সেই দুই বিধান জানতে হবে। এটাই যিনি করতে পারেন এবং চাকরি অর্জন করেন তিনি জয়ী। তার সেই অনুসন্ধানের কারণে তিনি জয়ী। এবারে আপনার প্রশ্ন আসতে পারে আমি তো জানি যে ঘুস দিয়ে চাকরি হচ্ছে, কিন্তু আমার সামর্থ্য নেই, তাহলে কি আমি অপরাধী? আপনি অপরাধী নন, তবে নিয়োগকর্তার ইচ্ছেতে এই কর্ম সম্পাদন হয় যেহেতু সেই ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে আপনাকে কর্ম করতে হবে। কারণ আপনার লক্ষ্য চাকরি পাওয়া।
এবার সেই নিয়োগকর্তা যে অপরাধ করছেন তার ফল তিনি পাবেন সাথে সাথেই অথবা পরে, সে এজীবনে হতে পারে আবার পরজন্ম বিশ্বাস করলে মরণের পারে হতে পারে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, এই অপরাধে কত আধিকারিক চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, কতজন নিজ নিজ পদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। অনেক সরকারের পতন ঘটেছে। এবার সেই পতনের আশঙ্কায় সরকার যদি লুট করার সামর্থ্য অর্জন করে থাকে সেটাই তার কর্ম এবং তার ফল হিসাবে পুনঃবহাল থাকা। এবার আপনি বলবেন যে আমি ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলে সেটা অপরাধ হবে না? সেক্ষেত্রে বলব একদম অপরাধ না, কারণ ওটাই ছিল নিয়োগের বিকল্প বিধি। আপনি সেটাই গ্রহণ করেছেন মাত্র। তবে বিবেকের দংশনে আপনি যোগ্য প্রার্থীর সামনে যাবেন না লজ্জায়, কিন্তু সচরাচর যারা এই সুবিধা নিয়ে থাকেন তাঁরা নির্লজ্জ প্রকৃতির হয়ে যায় অসদুপায়ে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যোগ্য পদে আসীন হবার পর।
মুশকিল হল, জীবের যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠার জন্য চাকরীর প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থা কতটা উন্মুক্ত করতে পারলো বা দুর্নীতি থেকে মুক্ত করে যোগ্য প্রার্থীর সামনে তুলে ধরতে পারলো সেটা একটা বড় বিষয়। যে রাষ্ট্র কর্মের সংস্থান করতে পারে না, উল্টে যোগ্যতার সাথে আপোষ করে নতুনভাবে রেজাল্ট বা প্যানেল তৈরি করে সেখানে কর্মফল বলে কিছুই থাকে না। সেখানে নীতি বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতি আর স্বজনপোষণকে করেছে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। আবার অনেক প্রতিযোগী হাতে ডিগ্রি নিয়ে চাকরি না পাওয়ার দুঃখে হতাশায় ভুগছেন। কিন্তু বাস্তবে সেই পদের যোগ্যতা তাঁদের আছে কিনা সেটা যাচাই করার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনটাই থাকে না, কারণ অনেক আগেই রাষ্ট্র সেই মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে করেছে কলুষিত। সেখানেই ঘটে বিপর্যয়। প্রকৃতপক্ষে, রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট, প্রজা কষ্ট পায়/গিন্নীর দোষে বাড়ি নষ্ট, লক্ষ্মী ছেড়ে যায়। যদি কোন মূর্খ লোক প্রশাসনে আসে সেখানে জ্ঞানীরা করে পলায়ন। অনাচার, অত্যাচার আর দুর্নীতিতে সবকিছু হয় অতিষ্ঠ। রাষ্ট্র হল নাগরিকের অধিকার রক্ষার ধারক ও বাহক। সেখানে সেই যদি কুকর্মে মত্ত হয়ে যায়, সেখানে প্রার্থীর কর্মের ফলাফল বিচার হয় না। হয় অনাচার, সেখানেই হয়ে যায় চরম অন্যায়। মহাভারতে পাণ্ডবদের বিনাকারণে জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা থাকলেও সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে পাণ্ডবরা বাঁচলেও অন্যায়ভাবে নিষাদপত্নী ও তাঁর পাঁচসন্তানকে পুড়ে মরতে হয়েছিল। এখানে যে তত্ত্ব লুকিয়ে আছে আপনার প্রশ্নের উত্তরে সেই একই তত্ত্ব প্রচ্ছন্ন আছে। সেখানেও মূল উদ্দেশ্য ছিল আগুন থেকে মুক্তি পাওয়া, দুর্নীতি করে তাঁরা মুক্তি পেয়েছিল এবং তার ফলস্বরূপ পাঞ্চজন্য অনুসারে ব্যাধের তথা সেই নিষাদের হাতে কৃষ্ণের মৃত্যু। আর অন্যায় করে আগুনে পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্য ছিল বলে সেই কর্মের ফল হিসাবে কুরুবংশ ধংস।
প্রতীকি ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

জীবন দর্শন - ৬

-“আমি তোমায় একান্ত কাছের করে পেতে চাই, খুব খুউউউউউ....ব কাছের করে পেতে চাই”।
- ঠিক কত কাছে?
- “যতটা কাছে এলে সকল দূরত্ব অতিক্রম করা যায়”।

এই কথোপকথন আমার অন্য একটি লেখা থেকে তুলে দিলাম, কিন্তু শেষের লাইনটি আমার কাছে এক জীবন দর্শন হয়ে প্রস্ফুটিত। আমার এক মাষ্টারমশাই বলতেন, জীবনে তুমি সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যতটা পথ পরিক্রম করবে সেটাই হবে তোমার অভিজ্ঞতা। তাই জীব একই জিনিস বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উপলব্ধি করে থাকেন। তখন এক ভেবে লিখে গেলেও আজ নিজের লেখা নিজে পাঠ করতে গিয়ে নতুন করে অনুভব করলাম। সকল দূরত্ব অতিক্রম করার তাৎপর্য কি? দূরত্ব বলতে এখানে কি বোঝানো হয়েছে?

আমার প্রিয় পাঠক, যারা আমার লেখা পড়েন তাঁদের সবাইকে জীবন দর্শনের পাতায় স্বাগতম। আজ জীবন খাতার ষষ্ঠ পাতা খুলে নিলাম আলোচনার স্বার্থে। আজকের আমরা আলোচনা করব দূরত্ব নিয়ে। আমরা জানি কোনো বস্তু বা বিন্দু একটি অবস্থান থেকে আরেকটি অবস্থানে স্থানান্তরিত হলে, প্রথম অবস্থান থেকে দ্বিতীয় অবস্থান অবধি ভেক্টরকে সরণ বলে। সরণের পরিমাণ হলো দুটি অবস্থানের মধ্যবর্তী ন্যূনতম দূরত্ব, অর্থাৎ সরলরৈখিক দূরত্ব। এতো গেল পদার্থবিদ্যার কথা। কিন্তু যে জীব তাঁর প্রিয়জনের কাছে নেই, সেই দূরত্ব সম্পূর্ণ একটা মনস্তাত্ত্বিক দিক। সেই দূরত্ব পরিমাপের কোন স্কেল আছে কি? আমরা সরলরৈখিক দূরত্ব অর্থাৎ দৈশিক দূরত্বের পাশাপাশি সময় দূরত্ব, মানসিক দূরত্ব, চেতনার দূরত্ব, দর্শনের দূরত্ব ইত্যাদি শুনতে পাই।

জীবের এই দূরত্ব জ্ঞান বোঝাতে আমি দুটি উদাহরণ তুলে ধরব। আশা করি অনেকের কাছে তা যথাযথভাবে প্রতীয়মান হবে। আপনারা লক্ষ্য করবেন যখন আমরা একজায়গায় দাঁড়িয়ে বসে গল্প করি, তখন খুব বেশী হলে এক মিটারের মত দৈশিক দূরত্ব থাকে একে অপরের থেকে। অর্থাৎ একজন কথা বললে নির্বিঘ্নে অপরজন শুনতে পান। কিন্তু যদি সেই গল্প বা আলোচনার নিরিখে ঝগড়া, বিবাদ, অশান্তি তৈরি হয় দেখা যায় আমাদের সবার কথা ধীরে ধীরে উচ্চস্বরে হতে থাকে। এই বিবাদ বা মনোমালিন্য যত বাড়তে থাকে ততই স্বর বাড়তে থাকে। কিন্তু কেন? আমরা কেউ ভেবে দেখেছি? দেখি না। একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন যে আমাদের মধ্যে দৈশিক দূরত্ব একই থাকলেও মানসিক দূরত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অর্থাৎ আমরা একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মনে মনে অনেক দূরে চলে গেছি। যার কারণে একে অপরের মনে হচ্ছে যে আরও জোরে বলা দরকার। কারণ, একে অপরের কথা অন্যের কথার মাত্রা ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তা নিজের যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠার মর্যাদা প্রতিপন্ন হয়। এই হল দূরত্বের আপেক্ষিক চেতনা।

আবার একে অপরের সামনে দাঁড়িয়ে দুচোখ দিয়ে দর্শন করি, কিন্তু প্রেম যত গাঢ় হতে থাকে এবং চরম পর্যায়ে গিয়ে একে অপরকে আবেগে আলিঙ্গন করে থাকে অর্থাৎ দুজনের মধ্যে দূরত্ব সবথেকে কম হয়ে গেল, তখন একে একে নিজের চোখ দুটি বন্ধ করে নেন। এটা ভাবজগতের বিষয়, আপনি নিজে নিজেই অনুভব করুন আর ভাবুন ঠিক যখন একে অপরের মধ্যেকার দূরত্ব সবথেকে কমিয়ে ফেললেন অপরজনকে ভালো করে চেনার বা দেখার জন্য তখন কেন চোখদুটি বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, এতক্ষন আপনাদের মধ্যেকার দৈশিক দূরত্বের সাথে একটা মানসিক দূরত্ব ছিল তা প্রেমের আলিঙ্গনে এখন আর নেই। তাই আপনাদের চোখ দিয়ে দেখতে হয় না। তখন অন্তর দিয়ে অনুভব করেন একে অপরকে, হৃদয় ও মনের মেলবন্ধন ঘটে দুটি প্রাণের মধ্যে। জাগ্রত হয় ভক্তি ও শ্রদ্ধা, গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় প্রেম। সকল দূরত্ব ছিন্ন করে একে অপরের মাঝে বেঁচে থাকে। একজন বাঁচে অপরের চেতনায়, চলতে চায় একই মার্গে, পৃথক পৃথক দর্শন হয়ে যায় একাকার। এই কয়েকদিন আগে পর্যন্ত কেউ কাউকে না চিনলেও দেখা যায় বিবাহ বা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলে জীব একসুরে কথা বলতে চান, যদি সেই বন্ধনের মধ্যে সততা থাকে। যদি সেখানে প্রতারণার বীজ শুরুতেই স্থাপিত হয়ে থাকে সেখানে দর্শন কেন সেই সম্পর্কের মাঝে কোন প্রাণও থাকে না।

সাধারণত, যখন কোন জীব আমাদের বন্ধন থেকে মরে যান, তাঁকে সময়ের হাত ধরে আমরা ভুলে যেতে পারি বা কালের নিয়ম বলে মেনে নিই। কিন্তু, আমাদের সুন্দর এক বন্ধন থেকে যখন কেউ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যান তাঁকে ভুলতে আমাদের কষ্ট হয়। কিন্তু দেরীতে হলেও আমরা ভুলে যায়। এক্ষেত্রে জীবের আবেগজনিত কারণে কষ্ট পাবে, তবে কর্মের মাঝে যতই তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন, ততই তাড়াতাড়ি তিনি এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন। এই জগতে মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক বিনে কোন সম্পর্ক স্থিতিশীল নহে। বর্তমান নীতিভ্রষ্ট সমাজে জীব তাঁর জননীকে ভুলে গেলেও জন্মদাত্রী কোনদিন সে সম্পর্কের ছেদ ঘটাতে পারেন না। সে সম্পর্ক তো বাৎসল্য প্রেমের সম্পর্ক, সেখানে দূরত্ব থাকলেও কোনকালেই দূরত্ব ছিল না, আজও নেই।

প্রকৃতপক্ষে, যারা উদ্দেশ্য নিয়ে কাছে আসে তাঁদের ক্ষেত্রে কোন দূরত্ব কমে না, নৈকট্য আসলেও মানসিক দূরত্ব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। উদ্দেশ্য পূরণ হলে সেদিন সমাপ্ত হয় একে অপরকে চেনা, শুরু হয় নতুন করে জানা। তৈরি হয় একে অপরের প্রতি ঘৃণা, বাসা বাঁধে অশ্রদ্ধা আর প্রকট হতে থাকে প্রকৃত দূরত্ব। একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই উদ্দেশ্য পূরণ না হলেও এই একই ঘটনা ঘটে থাকে। সরে যেতে থাকে একে অপরের থেকে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বা প্রেম যতক্ষন দূরে থাকে ততক্ষণ তার প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়, নৈকট্য বাড়লে তা সাময়িক গভীরতা বৃদ্ধি ঘটালেও বিনিময়ে কেড়ে নেয় প্রকৃত ভালোবাসার স্বরূপ, ভেঙ্গে যায় শ্রদ্ধার বন্ধন। ঘটে যায় অপ্রীতিকর দূরত্ব বৃদ্ধি।

সময়ের সাথে সাথে আমরা দেখছি ভারতের মাটিতে বসে আমেরিকা, ইউরোপ বা আফ্রিকানদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলে দেখা যায় একেবারে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীকে তিনি চেনেন না। হতে পারে সেখানে সংস্কৃতি বা মর্যাদার দূরত্ব বর্তমান। কিন্তু ঐ বন্ধুদের সাথে তাঁর যোগাযোগ থাকলেও আত্মিক সংযোগ কোনদিন তৈরি হয় না। এই হল দূরত্বের বিধান। দূরত্ব যেমন কমালে আত্মীয়তা জাগ্রত হয় তেমন এতটাই কাছে আসার দরকার নেই যে সকল দূরত্ব অতিক্রম হয়ে যায়, কারণ যেদিন সকল দূরত্ব অতিক্রম হয়ে যাবে, সেদিন থেকে একটু একটু করে নতুন দূরত্ব তৈরি হয়। আমরা এই শিক্ষা তো দুধজলে বিস্কুট ডোবানো থেকে পেতেই পারি। এমনভাবে ডোবা যাবে না, যাতে নিজের সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে দুধে ভেঙ্গে পড়তে হয়। নইলে এক বালিশে মাথা দিয়ে হাজার মাইল দূরের মানুষের সাথে চ্যাট করতে হবে অর্থাৎ যে দূরে থাকে সেই কাছের আর যে কাছে থাকে সেই সবথেকে দূরের হয়ে যায় মনের অজান্তে। তাইতো কবিগুরু বললেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূরত্ব কোনটি জানো? নাহ, জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, উত্তরটা সঠিক নয়। সবচেয়ে বড় দূরত্ব হলো যখন আমি তোমার সামনে থাকি, কিন্তু তুমি জানো না যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি”।

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ফেসবুক

© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত


প্রিয় পাঠক, জীবন দর্শনের সপ্তম পাতা একটা ইন্টার্ভিউ প্রকাশ করা হল। প্রিয় অভিজিৎ এর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যে দর্শন উঠে এল তা সবার সমানে উত্থাপন করে দিলাম। আপনার অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না।
#অভিজিৎ - আপনাকে একটা প্রশ্ন উপস্থাপন করলাম, একটা মানুষকে ঠিক কত দিক দিয়ে বিচার করে ওই ভালোটা বলা যেতে পারে? বা ভালো কি শুধু ভালোর মধ্যে অন্তরঙ্গ? কিভাবে ভালো খারাপের বিচার শালিসি হয়? জানি অপ্রাসঙ্গিক তাও.........
#উত্তর - ভালো বলতে কোন ভালোর কথা বলছ? আর একটু প্রশ্নটা ক্লিয়ার করো।
#অভিজিৎ - আমরা মানে মানুষেরা কি বিচার করার প্রাপ্তি পাই, মানুষটি ভালো হিসাবে? বা একটা মানুষকে ভালো কখন বলতে পারি? সেতো আবার সবার কাছে ভালো নয় তো, তাহলে স্বয়ং কিভাবে বিচার করে ভালো বলি মানুষকে?
#উত্তর - ভালো মন্দ মূল্যায়ন অনেকটাই স্বার্থের দ্বন্দ্বে আঘাতপ্রাপ্ত। যদি মূল্যায়ন নীতি আর ধর্মের নিরিখে হয় তাহলে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যদি স্বার্থ জড়িয়ে থাকে সেই বিচারে, তাহলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সেখানে ভালো মন্দের সাথে জড়িয়ে যায় প্রবঞ্চনা আর নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করবার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া। আবার দেখতে হবে কে মূল্যায়নের দায়িত্বে আছেন। তিনি যদি নিজেই সৎপথে না থাকেন তাহলে তাঁর কাছে ভালো বলতে তিনি সবসময় তিনি যেটাকে ভালো মনে করেন, ভালো বোঝেন সেটাই করেন। কিন্তু সৎমার্গের জীব নিজের বিপক্ষে গেলেও ধর্ম আর নীতিজ্ঞানকে বাঁচাতে প্রকৃত ভালো কে ভালো বলেন, মন্দকে মন্দ বলেন। সেখানেই তাঁর ভালো হয়ে ওঠা। হতে পারে সেই ভালো গুনের জন্য তাঁর দৈন্যদশা। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে তাঁর এই পরিণতি শুধুমাত্র সঠিকভাবে সাদাকালো বিচার করবার কারণে নয়, বরং সময়ের কাছে সমাজের বিকিয়ে যাওয়ার পরিণতি।
#অভিজিৎ - আমি যথাযথ উত্তর পেলাম।
#উত্তর - তাছাড়া বিশ্বকবির কথায় “সত্যকার আদর্শ লোক সংসারে পাওয়া দুঃসাধ্য। ভালবাসার একটি মহান গুণ এই যে, সে প্রত্যেককে নিদেন এক জনের নিকটেও আদর্শ করিয়া তুলে।”
#অভিজিৎ - আচ্ছা দাদা নিজেকে নিয়ে একাত্ম হতে পারছি না। মনোযোগ বারংবার বিঘ্নিত হচ্ছে। কাজের ওপর দায়িত্ব হারিয়ে পড়ছে। ক্রমে ক্রমে চিন্তার দৈর্ঘ্য বাড়ছে, যেটাকে নিয়ে থাকতে চাইছি সেটার ওপরে মনোমালিন্য ঘটছে। জানিনা বন্দি আছি বলে কিনা.....কিন্তু এমনভাবে থাকতে কোনোরকম ইচ্ছেও নেই। একটু সমাধান দেবেন.....।
#উত্তর - মনোযোগ হারায় বর্তমান কে বাদ দিয়ে যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বেশী ব্যস্ত তাঁদের ক্ষেত্রে। তেমন যদি তোমার ক্ষেত্রে হয় তাহলে তুমি খুঁজে বের করো তোমার এই তৎপরতা কিসের জন্য? এর পশ্চাতে কোন ঘটনা বা কোন ব্যক্তির চাওয়া পাওয়া জড়িয়ে আছে। মনে রাখতে হবে সময় আর পরিস্থিতির কাছে আমরা দাস, সেটা কাটিয়ে উঠতে গেলে ধৈর্য ধরে বর্তমানকে সাজাতে হবে। সেটা হলে ভবিষ্যৎ তৈরি ঠিক হয়ে যাবে। আর যদি কোন ব্যক্তির চাহিদাগত অভিমান কাটাতে তোমার এই পরিণতি হয়, তাহলে তুমি তাঁকে সাবধানে এড়িয়ে যাও। কারণ তাঁর এই চাওয়া পাওয়া কোনদিন শেষ নাও হতে পারে, কিন্তু এই চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলবে মনের অজান্তে।
#অভিজিৎ - সমাধান খুব সুন্দর। কিন্তু গন্ডি থেকে হারিয়ে যাচ্ছি কেন আমি? আমিকে বারংবার খুঁজতে হয় কেন আমাকে? কেন এত ছন্দপতন? এর হিসাব কিভাবে আসবে?
#উত্তর - যারা নিজেরা বুঝতে পারেন যে তাঁর পদস্খলন হচ্ছে, তাঁরা এটাও বুঝতে পারেন সেখান থেকে মুক্তির উপায় কি কি? শুধু সংযমের অভাব আর ষড়রিপুর তাড়নায় তাঁকে সঠিক মার্গে প্রবেশ করতে বারবার বাধা প্রদান করে থাকে। প্রতিদিন দিনের শেষে গিয়ে তিনি ভাবেন যে এটা করা উচিত হয় নি, কাল থেকে আর করব না। পরেরদিন সকালে উঠে আবার সেই একই ভ্রম করে বসেন। এটাই হল স্থিতিশীলতার অভাব। এর থেকে মুক্তির উপায় তো ‘আমি’ কে জানতে পারা। জীব তাঁর আমিত্ব কে জানতে চাই না বা পারে না বলেই তো তাঁর এত অহমিকা। কারণ, এই আমিত্ব খুঁজতে বসলে তা একেবারে শুন্য হয়ে দাঁড়ায়। এ দুনিয়ায় তুমি ভিন্ন সব বর্তমান, তুমি এসেছিলে রিক্ত হস্তে, যাবার সময় যাবেও রিক্ত হয়ে। মাঝে থেকে যাবে শুধু তোমার কর্মধারা। সেখানেই বেঁচে থাকবে তোমার আমিত্ব।
#অভিজিৎ - পূর্বে এমন হত না, এমন সময়ে আমি এইগুলো বেশি অনুভব করছি! কিন্তু কেন আমি???? এর থেকে দাদা মুক্তির কোনো উপায় নেই?
#উত্তর - আছে অভিজিৎ, মুক্তির উপায় চিরকাল আছে। সমস্যা থাকলে সমাধান থাকবেই। তবে সমস্যা সংকটজনক হলে সেই মুক্তির উপায় সাধনার মত কঠিন হয়ে যায়। তাই সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। ভালো বই পড়তে হবে, জানতে হবে। যত মানুষ, তত চিন্তাধারা। তাই যত পড়বে, তত মানুষকে জানবে। চিনতে পারবে ভিন্ন ভিন্ন মার্গ। মার্গ চেনা হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে অসুবিধা হয় না। কারণ মার্গ ভিন্ন হলেও গন্তব্য সবার এক। তাই কর্ম করতে হবে। মনে রাখতে হবে নিজেকে অলসতা থেকে মুক্ত করাই হবে প্রধান সোপান কারণ কবিগুরু বলেন, “সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে”।
#অভিজিৎ - কিন্তু এইসময়ে দাঁড়িয়ে মনোযোগী তে অভাব কেন এতো? এর সমাধান কিভাবে পেতে পারি দাদা?
#উত্তর - যোগ, যোগসাধনা করতে হবে। স্বামীজি বলেন গীতা পাঠ করা অপেক্ষা ফুটবল খেলা শ্রেয়। এর অর্থ তিনি গীতা পাঠ থেকে বিরত থাকতে বলেন নি। বলেছেন মনকে বাঁধতে হলে শরীর ভালো রাখা দরকার। শরীরচর্চা করলে মন হয় নির্মল। তাঁর জন্য দরকার নিয়মানুবর্তিতা, জীবনে শৃঙ্খলা, সৎ ও সাত্ত্বিক জীবন যাপন করা। অভিজিৎ, ভালো মানুষের সঙ্গ করো, কুকথা আর অসৎ মার্গ ত্যাগ করো। মনে রেখো, “ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না”। তাই প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যক্তির ভূমিকা অনেক বড়, যদি তিনি সৎ মার্গের হন।
#অভিজিৎ - বেশ।
#উত্তর - আর একটা কথা শিক্ষা শুধু গ্রহণে কাজ শেষ হয় না, শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ চাই। “আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়”।
#অভিজিৎ - আমি জানতেই পারিনি এগুলো থেকে কিভাবে আমি বেরিয়ে গেছিলাম।
#উত্তর - যারা নিচের দিকে নামেন তাঁরা ভাবেন যে তাঁর নিজ ক্ষমতায় তিনি নামছেন এবং চাইলে পরে যখন খুশি উঠে আসবেন। তিনি জানেন যে এর পশ্চাতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি রয়েছে কিন্তু অসৎ সঙ্গ তাঁর সেই জ্ঞানকে মাটি করে তাঁকে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য করে তোলে। সেখানেই পতন হতে শুরু হয়। নীচে নামানোর বন্ধু অনেক থাকে, প্রশংসা থাকে। তাই সেই বিড়ম্বনার মাঝে আসল মার্গ থেকে বিচ্যুতি ঘটে নিজের অজান্তেই। যখন সম্বিৎ ফেরে তখন নিজের ক্ষমতা কাজে লাগাতে চেয়ে যখন পারেন না, তখন খোঁজেন মুক্তির উপায়। তুমি কি এমন কোন অসৎসঙ্গ পেয়েছ? তাহলে তা বর্জন করাই শ্রেয়।
#অভিজিৎ- আসলে মন তো দাদা সততার ওপর সেও অনেকখানি নির্ভর করে। যখন মনের বিপরীতে কাজ হয় বা কাজ হতে দেখি তখন হারাতে হয় নিজেকে। মিথ্যের প্রসস্থতা, পরিবেশের অক্ষুন্নতা, সমাজের শিরদাঁড়া নষ্ট হয়ে যেতে দেখা, পরিবারের মধ্যে হিংসা ও সর্বোচ্চ পাওয়ার লালসায় জর্জরিত হওয়া, বিভেদ, সমালোচনা, মানসিকতার অবক্ষয় ইত্যাদি এসব ঘটনা যখন চোখের সামনে আলাপ দেখাতে আসে তখন নিজেকে সবথেকে অপরাধী মনে হয়, মনে হয় হেরে যাচ্ছি বারংবার গোটা হিসাবের কাছে। চিন্তা, ক্ষমতা, বিচার, বুদ্ধি, সহনশীলতা সবকিছু যেন পর হয়ে যায় ততক্ষণে। মনে হয় এত হিসাব পাওয়ার আমিই বা কে ?
#উত্তর- বেশ....
#অভিজিৎঃ আর তখন মুচড়ে যায় সমস্ত মনোযোগ, সংকল্প! হারিয়ে যায় নিজের অজান্তেই, হারিয়ে যেতে হয় নিজের ইচ্ছেই.....। বেলাশেষে মনে হয় সবকিছু প্রয়োজন, বাকিটা অলস মাত্র। এখানে খুব হাসি হাসতে গেলে পাগলের প্রলাপ, নিশ্চুপ থাকলে বোবা, বিদ্রোহ করলে সাহস দেখাচ্ছে বলে আর কাঁদলে লোকদেখানো। এসব খুশি আর কত বইবে মান-হুষ? আসলে নির্লিপ্ততা, বন্ধন, সম্পর্ক, ভালোবাসা এসব মাঝেমধ্যে মনে হয় সাজানো কথা। হারালে বোধ হয় শোনা থাকতো না অরুচিকর সংযোজন। ক্ষমা করবেন দাদা।
#উত্তরঃ অভিজিৎ, তোমার এই অনুভূতি ভালো। কিন্তু ভাই! একটা কথা তো ভুলে গেলে চলবে না, যে তুমি একা হাতে এই সমাজের নোংরা পরিষ্কার করতে আসো নি বা চাইলে পরেও করতে পারবে না। তবে তোমার এই মতাদর্শ আর অনুভূতিকে সঙ্গ করে গড়ে তুলতে হবে সেই সমাজ, যেখানে গরিষ্ঠ হবে সমমনস্ক মানুষের দল। সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে, ক্ষেত্রবিশেষে রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করতেও হয়। কর্ণকে বধ করতে যাতে অর্জুনের সুবিধা হয় সেজন্য কৃষ্ণ কর্ণকে রণভূমি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন আর তাতেই সংহার করতে সুবিধা হয়। তোমার যদি এই মলিনতা না ভালো লাগে, তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। জীবের স্বরূপ নিজে বুঝবে, তারপর অন্যকে বোঝাবে। এর পরিণতি কি আর তা থেকে মুক্তির উপায় কি সেগুলো প্রতীয়মান করতে হবে। তবেই দেখবে সমাজ উচ্ছন্নে গেলেও একদিন জীবের মতি ফিরবে। সেটা একজন দুজন করে হতে পারে। মনে রাখবে নীচে নামার মানুষ বেশী, কারণ নীচে নামতে কোন অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করতে হয় না। যাক ভালো থেকো, আজ উঠি। আবার পরে কথা হবে।
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

জীবন দর্শন - ৮

প্রিয় পাঠক, আজ জীবন দর্শনের পাতায় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা তুলে ধরব। সম্পর্কের মাধুর্য বুঝতে গেলে রেলের ট্রাকের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের সম্পর্ক যতক্ষন রেলের লাইনের মত সমান্তরাল পথে এগিয়ে যায় তার গন্তব্য অনেক দূর এবং স্থিতিশীল হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে কিন্তু দুজনের মধ্যে সমান এবং সমান্তরাল দূরত্ব বর্তমান থাকে। এমন একটা দূরত্বে থাকে যে একে অপরকে ছুঁতে পারে না আবার এতটা নৈকট্যে থাকে যে একে অপরকে দেখতে পায়, একে অপরের কথা শুনতে পায়। এতে কি হয় একে অপরকে দেখতে দেখতে কিংবা শুনতে শুনতে মোহ তৈরি হয়, কিন্তু মায়া তৈরি হয় না সামান্য দূরত্বে অবস্থান ও না ছুঁতে পাড়ার কারণে। এখন এই মোহ কেমন বুঝতে হলে আপনি একটি কাঁচের দেওয়ালে চোখ রাখুন যার এদিক থেকে ওদিকে দেখা যায় এবং কাঁচের অপরদিকে একটি পোকা বসে আছে নির্বিকারভাবে। তাই দেখে কাঁচের উল্টোদিকে একটি টিকটিকি ওই পোকাকে ধরবে বলে বসে অপেক্ষা করে। কিন্তু এই সমান ও সমান্তরাল দূরত্বের কারণে সে কোনদিন ওই পোকার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তার এই না পারাটাই হল বাস্তবতা, কিন্তু তার এই অপেক্ষা করে যাওয়াটাই হল মোহ। মোহ যদি না কাটে তাহলে ওটার লোভে ও সারাজীবন শেষ করে দিতে পারে, কারণ সেখানেই জন্ম নেবে লালসা।

ঠিক তেমনিভাবে আমাদের চলার পথ যদি রেললাইনের মত সমান ও সমান্তরাল হয়ে থাকে তাহলে আমাদের একের প্রতি অন্যের একটা শ্রদ্ধা কাজ করে। কিন্তু রেলের লাইন যদি কোনসময় এই সমান ও সমান্তরাল দূরত্ব ত্যাগ করে কাছে আসে, তৈরি হয় মোহ, লাইন ভেঙে জুড়ে তৈরি হয় জংশন পয়েন্ট যেগুলো অনেককিছু দিয়ে বন্ধন ধরে রাখতে হয়। আবার যদি এই দূরত্ব কোন কারণে বেড়ে যায়, সেখানে ঘটে রেলের বিপর্যয়। ঠিক তেমনি আমরা যখন নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে কাছে চলে আসি, তখন আমাদের একের প্রতি অন্যের জানা শেষ হয়, শুরু হয় অজানা কাহিনী।

আপনি ভেবে দেখুন, সমান্তরাল দূরত্বে থাকার কারণে একে অপরের ভালো কথা শুনেছে, ভালো কথা বলেছে। তাই সেই সম্পর্ক একটা শক্ত বন্ধনের মধ্যে দিয়ে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করেছে। কাছে পাওয়া হয় নি, কিন্তু পাশে চিরকাল পেয়েছে। যখন সেই দূরত্ব কমিয়ে একে অপরের কাছে এসেছে, প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে সেই বিবাহ নামক জংশন পয়েন্ট আটকে রাখতে হয়েছে, নতুবা ঘটেছে বিপর্যয়। আমরা মানুষ চিরকাল একে অপরকে কাছে পাবার তাগিদে পরস্পর পরস্পরের কাছে মুখ লুকিয়ে মুখোশ দেখিয়ে অনেকক্ষেত্রে মিথ্যে আর প্রবঞ্চনার বেড়াজালে নিজের লালসা চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। সেখানে অন্য সবাইকে মনে হতে পারে শত্রু, কারণ যেনতেন প্রকারেণ তাঁর স্বার্থ চরিতার্থ করা জরুরী মনে করেন। বাস্তবতার মাটি ছেড়ে উড়তে চান হাওয়ায়। এভাবেই ঘটে একে অপরের প্রকৃত স্বরূপ জানা। কৌতূহল মিটে গেলে জাগে অনীহা। কিছু কিছু মানুষের নতুনের সন্ধানে ঘটে স্খলন। প্রকৃত সত্য হল এঁরা কেউ কাউকে ভালোবেসে কাছে আসেন নি, আর ভালো-বাসা তৈরির কথাও ছিল না। যেটা ছিল সেটা হল একে অপরকে দিয়ে তাঁর বাসা টা ভালো করে তুলতে চাওয়া।

অনেকে বলেন সম্পর্কে এসে তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়, কিন্তু একবারের জন্য কেউ ভাবেন না যে তাঁরা একে অপরে স্বাধীন ছিল সমান ও সমান্তরাল দূরত্বে থেকে। কিন্তু পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা থেকে হোক আর লোভ ও লালসা থেকে হোক মোহ আর মায়ার জালে জড়িয়ে নিজে থেকেই ঘোষণা করেছিল নিজ স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে কারুর প্রশস্ত কাঁধে মাথা রাখতে, চওড়া বুকে মুখ লুকিয়ে ফাটিয়ে কাঁদতে কিংবা তাঁর ভালোবাসার ছায়ায় খুঁজে পেয়েছিল শক্ত কোন ডালের নিশ্চিন্ত ছায়া। সেদিন থেকে মনের অজান্তে বলেই দিয়েছিলেন আমি তোমাতেই সঁপে দিলাম এ জীবন যৌবন, কিন্তু মোহ কেটে গেলে উন্মুক্ত হয় জ্ঞানচক্ষু। সদর্পে ঘোষণা করেন যে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলে কিংবা জবাবদিহি করতে হলে এই সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না। সেখানেই হয় সম্পর্কের বন্ধন শিথিল। অর্থাৎ রেলের জংশন পয়েন্টের বন্ধন যদি শিথিল হয় তাহলে অপেক্ষা করে এক বড় বিপর্যয়ের। সেটাই ঘটে আসছে আবহমান কাল ধরে। ত্যাগের মাঝেই ঘটে থাকে প্রাপ্তিযোগ। কেউ যদি মনে করে জিদ আর অভিমানকে সঙ্গী করে জীবন দর্শন তৈরি করে জগতজীবকে শিক্ষা দেবে, তাহলে অনন্ত বিশ্বের কাছে তাঁর সেই ভুল হয়ে যাবে ঐতিহাসিক পরিহাস। জীবশিক্ষা তৈরি করতে হলে, নতুন মার্গ দর্শন করাতে হলে ত্যাগ হল শ্রেষ্ঠ পন্থা। তবে জীবন আপনার, আপনার জীবন আপনি পূর্ণ ভোগের অধিকারী। আপনার জীবনকে আপনি নিজেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন, কিন্তু সেটা সম্পর্কের বন্ধনে সম্ভব নহে। এই বন্ধন যদি সত্য হয় তা একটুও বিচলিত হতে দেয় না।

আমাদের নিত্যদিনের চলার পথে নিত্য নিত্য কত মানুষ রোজ দেখা হয় ট্রেনে বাসে ট্রামে। কথা হয়, শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। কিন্তু কেউ কারুর কাছে কর্তব্য পালন করতে যেমন দায়বদ্ধ নন, তেমন কেউ কারুর কাছে কোন অধিকার দেখাতে পারেন না। কারণ ওই একটাই, এঁদের সম্পর্কে সমান ও সমান্তরাল দূরত্ব বিদ্যমান। তাই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও যখন জিজ্ঞেস করা হয় দাদা কেমন আছেন? বলতে হয় ভালো আছি। ওইখানে ওঁর বেশী ঝোলা খোলা হবে না। তাই ওই সম্পর্কের জটিলতা কোনকালে আসে না। এটাই রেললাইনের দুটি ট্রাকের মধ্যে সমান ও সমান্তরাল দূরত্বে অবস্থান করে অনন্তকাল পাশাপাশি অবস্থান করে বহুদূরের গন্তব্যে চলে যাওয়ার মতো, তবু নিজেদের মধ্যে এক বিনিসুতোর বন্ধন দিয়ে সম্পর্কের মালা যেমন দেখা যায়, তেমন তাঁদের মধ্যে কোনদিন তুমুল অশান্তি লক্ষ্য করা যায় না। এ এক গভীর প্রেমের নিদর্শন। এভাবেই আমরা কাছে থেকেও দূরে চলে যায়। আর একটা বিষয় মনে মনে ভাবুন, আমরা যখন কাছে আসি তখন আমরা কেউ কাউকে আর দেখি না, শুধু অন্তরে অনুভব করি। মনে করুন আপনি কাউকে ভালোবেসে সোহাগ করতে তাঁকে আলিঙ্গন করবেন, সেখানে খেয়াল করবেন আলিঙ্গনকালে মনের অজান্তে আপনারা দুজনেই জানবেন দুজনের চোখ একবার হলেও বুজে আসবে। কারণ তখন একে অপরের হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে বা অনুভব করতে ব্যস্ত থাকে। আর যদি চোখ না বুজে আসে তাহলে বুঝবেন সেখানে দূরত্ব কিছুটা হলেও বিদ্যমান, আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। সেখানেই লুকিয়ে সম্পর্কের সবথেকে বড় প্রতারণা। নাটকে মুখোশ পরিধান করে অভিনয়সম হয়ে দাঁড়ায় সেই আলিঙ্গন। থাকে না কোন সজীবতা।

আবার প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কের মাঝে অশান্তি কলহ হলে দেখবেন খুব নিকটে দুজনে অবস্থান করছেন দুজনে, একে অপরের কথা স্বাভাবিক গলায় শুনতে পাবেন। মানে একটু আগে হয়তো তাঁরা একে অপরের সাথে কথা বলছিলেন, পাশের চেয়ারে বসে কেউ তাঁদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা শুনছিলেন। কিন্তু যখন মনোমালিন্য হল, একে অপরের সাথে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করল, তার কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল খুব জোরে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগলো। প্রশ্ন হল এই কলহের সময় আমরা চিৎকার করি কেন? কারণ আমাদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বৃদ্ধি না পেলেও মানসিক দূরত্ব বেড়ে গেছে। একে অপরের জন্য নিজের মনের মণিকোঠায় সেই স্থানে আর তাঁকে কেউ বসিয়ে রাখেন নি। তাই তাঁদের মন থেকে জোরপূর্বক চিৎকার করে নিজের কথা শোনাতে বা প্রতিষ্ঠিত করতে উন্মত্ত হয়ে পড়ে তাঁরা।

এভাবেই চলে সম্পর্কের টানাপোড়েনের রসায়ন। আর সেই রসায়নে রস প্রদান করতে প্রবেশ করে কিছু তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি। কারণ তাঁরা যোগ্য প্রশাসকের মত বিভাজন নীতি চালিয়ে বানরের পিঠে ভাগ করে লুটে খাওয়ার আনন্দ পান। আসলে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে তাঁর প্রাপ্য ভাগের পিঠেটুকুও তাঁর বাড়িতে জোটে না ক্ষেত্রবিশেষে। তাই এখানে সেখানে অযাচিতভাবে প্রবেশ করে মানুষের জীবনকে করে বিধ্বস্ত। নিজের জীবনে এঁরা স্বেচ্ছায় মর্যাদা পান নি, এঁরা মনে প্রাণে শান্তিও পান না খুব একটা। মনের অশান্তি দূর করতে নিজেকে অনেক সময় হারিয়ে ফেলেন সংগঠিত ভাবে। যারা দীর্ঘ সম্পর্কের শিকড় উপড়ে ফেলে এই হালকা হাওয়ায় উড়ে আসা নতুন কোন বীজের প্রতি আসক্তি দেখায় তাঁদের সম্পর্কে শুরু হয় জটিলতা, আর যারা সাময়িক অশান্তির পাল্লায় পড়ে দীর্ঘদিনের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেন না, অন্যের কথায় নিজের কাছের মানুষের সাথে সম্পর্কের জাল ছিন্ন করেন না। তাঁদের সেই সম্পর্কের গভীরতা এত প্রাবল্য পায় যে পরবর্তীকালে তুফান হয়ে গেলেও সেই সম্পর্কের গাছ আর উৎপাটন হতে দেখা যায় না। এটাই হল সম্পর্কের জীবন দর্শন।

© অধ্যাপক সনৎকুমার পুরকাইত

জগতের ধর্মগুরু লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র

  লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র   গল্পের নায়ক যেখানে কৃষ্ণ সেখানে বলে রাখা ভালো আধ্যাত্মিক নয়ন না থাকলেও যদি কেউ তাঁর বিবেক ...