লোকসংস্কৃতি
ও লোকাচারের প্রেক্ষাপটে সুন্দরবন
ভূমিকাঃ
সুন্দরবনের ইতিহাস, ভূগোল বা তার অবস্থানগত
বৈচিত্র্য বর্তমানে বহু মানুষের কাছে জ্ঞাত। কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের
প্রান্তিক মানুষের মাঝে হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা লোকাচার, লোকসংস্কৃতি বা
বিশ্বাস আজও অনেক মানুষের কাছে অজানা। আর যাঁদের কাছে তা জ্ঞাত, তাঁদের অনেকেই
আবার এঁদের এই লোকাচারকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু বর্তমান
নিবন্ধকার মনে করেন যে প্রান্তিক অঞ্চলের আদি বাসিন্দার মাঝে যে সংস্কার বিদ্যমান
তা দেশ ও কালের নিরিখে সমকালীন সময়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব অবশ্যই বহন করে থাকে।
অনুসন্ধান করলে সেইসকল সংস্কার একসাথে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রচ্ছন্ন আছে
সেই শত সহস্র বছরের পুরানো সংস্কৃতির পিছনে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি যা বর্তমান উন্নত
সভ্যতার আধুনিক ল্যাবরেটরিতে বসে গবেষকরা অনুধাবন করতে পারেন না। সুন্দরবনের
লোকসংস্কৃতির বিরাট অংশ জুড়ে অবস্থান করে বনবিবি। এই বনবিবি ছাড়াও আরও অনেক
দেবদেবীর পূজা ও লোকাচার লক্ষ্য করা যায় স্থান ও অধিবাসীভেদে। লোকসংস্কৃতির এক
আঁতুড়ঘর বলা যেতে পারে এই সুন্দরবনকে। আমরা এই প্রবন্ধে দেখে নেব সেই লোকাচার বা
সংস্কৃতি।
চব্বিশ পরগণা জেলাদ্বয়ের সুন্দরবনে তথা সমগ্র ভারতীয়
সুন্দরবনের সাথে এই বনবিবি দেবীর নাম যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এখানকার লোকায়ত
সংস্কৃতিতে এই দেবীর আধিপত্য একচ্ছত্র। শোনা যায় সুদুর আরব থেকে এই দেবীর আগমন।
সেই কারনে সুন্দরবনকে ‘আঠারো ভাটির দেশ’ বলা হয়। এরূপ নামকরণের কারন আরব থেকে
সুন্দরবনে আসতে গেলে তখন আঠারোটি জোয়ারি নদী পেরিয়ে আসতে হত। বনচারী মানুষের কাছে
একমাত্র দেবী হিসাবে আজও পূজিত হন বনবিবি বা বনদুর্গা। বনবিবি জঙ্গলের দেবী।
জঙ্গলে আসা দরিদ্র মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আমরা বনবিবির মন্দিরে চোখ রাখলে দেখতে পাই,
একদিকে দক্ষিণ রায়, মাঝে বনবিবিসহ শাহ্জঙ্গলি ও কোন কোন স্থানে দুখের মূর্তি
থাকে। আমরা আজকের আলোচনায় একে একে জেনে
নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা। দক্ষিণ রায় বা দুখে বা কে? যখন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন
ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ বিদ্যমান, সেখানে আঠারো ভাটির দেশে জাতি
ধর্ম নির্বিশেষে এই বনবিবির পূজা করতে ব্যস্ত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে যেখানে মূর্তি
পূজায় বিশ্বাস নেই, তারাও কেন এই দেবীর পূজায় নিমগ্ন থাকে। কেন মুসলিমের বিবিমাতা
হিন্দুর পুজার বিগ্রহ হয়ে উঠল?
প্রাচীন কাল থেকে আমরা দেখে আসছি প্রকৃতির কাছে
মানুষ কত অসহায়! ইতিহাসের পাতা ওলটালে মিশরে, রোমে, গ্রিসে, পারস্যে সর্বোপরি
আমাদের ভারতবর্ষে জলের দেবতা, বায়ুর দেবতা, আগুনের দেবতা ইত্যাদির অস্তিত্ব
বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষের কাছে প্রকৃতির অসীম ক্ষমতার কাছে মানুষের মাথানত
করার সবথেকে বড় প্রমান। প্রাচীন সভ্যতা বিশারদ সি ই এম জোয়াড বলেন, ‘Early religious ideas might be described as a mixture of fear and cupboard
love.’ আদিম মানব মানবী মনে করত প্রকৃতির বিস্ময়কর ও ভয়ঙ্কর রূপ
প্রকাশের পিছনে কোন এক অদৃশ্য শক্তি সতত সক্রিয় এবং সময়ের সাথে সাথে সেই একক শক্তি
বহু ও বিচিত্র হয়ে ওঠে নিজেদের বিশ্বাস ও রুচির উপর ভর করে। শুধু মিশর, গ্রিস নয়
আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায়ও এই ধরনের দেবদেবীর সন্ধান মেলে। মহেঞ্জোদারো ও
হরপ্পার প্রাচীন সভ্যতার ভগ্নাবশেষ এই সত্যের প্রতি বাস্তব ইঙ্গিত করে। গরু, বিড়াল
ভারত তথা বাংলার লোকায়ত ধ্যান ধারনায় বিশেষ আসন অধিকার করে আছে। যেমন পঞ্চানন বা
শিবের বাহন ষাঁড়, ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল, শীতলার বাহন গাধা, বনবিবির বাহন বাঘ ইত্যাদি।
প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালে এই জীবজন্তুগুলিকে মানুষ একদিকে যেমন ভয় পেত, তেমনি
বিশ্বাসও করত। শ্রদ্ধা বা ভক্তি এল অনেক পরে। সেই কারনে জোয়াড বলেছেন, ‘Fear, in fact, was still the main spring of religion.’। এইভাবে
মানুষ প্রকৃতির সম্পর্ক মহাকাব্য থেকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলিতে দেখে এসেছি।
নিয়ন্ত্রণবাদ ও সম্ভাবনাবাদঃ
ফ্রেডরিক র্যাটজেল, এলেন সেম্পেল ও পল ভিদাল দ্য
লা ব্লাশ কর্তৃক প্রচারিত যথাক্রমে নিয়ন্ত্রনবাদ বা সম্ভাবনাবাদ কিংবা গ্রিফিথ
টেলরের নবনিয়ন্ত্রনবাদ তত্ত্ব বিশ্বের ভূগোল চর্চায় মানুষ প্রকৃতির সম্পর্কের
উত্থান পতন লক্ষ্য করা যায়। কেউ পরিবেশগত কঠোর নিয়ন্ত্রবাদের কথা বললেও কেউ আবার
মানুষের শিক্ষা, রুচি ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষকে প্রকৃতির থেকে অনেক
বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারন সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে
সভ্যতার বিকাশ ও মানুষের দুর্গম গিরি কান্তার মরু পারাবারের গল্প দিয়ে পরিবেশের
উপর মানুষের নিয়ন্ত্রন তুলে ধরা হলেও প্রকৃতির ক্ষনিকের খামখেয়ালিপনায় দীর্ঘ কয়েক
হাজার বছরের সভ্যতার বিনাশ কিভাবে হয়ে গেছে তা এই মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষী আছে
বলেই তাই চরমপন্থা ত্যাগ করে গ্রিফিথ টেলরের নবনিয়ন্ত্রনবাদ মতবাদকে বিজ্ঞানভিত্তিক
বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে কিংবা চাঁদে পাড়ি দিয়েছে তখনও
পর্যন্ত মানুষের এই অসাধ্য সাধনের পিছনে যে কোন এক অজ্ঞাত শক্তির নিয়ন্ত্রন যে
বর্তমান তা সবাই স্বীকার করে। অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার দুরারোগ্য ব্যাধির মুক্তি
দিতে প্রবেশ করাটা বিজ্ঞানের অবদান, কিন্তু ছুরি চালনার আগে কোন এক অজানা শক্তির
কাছে প্রণাম জানিয়ে নেওয়াটাই হল প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
মানুষের যতদিন অভাব আছে বা থাকবে ততদিন এই
প্রকৃতিকে বিশ্বাস করে কারন তার রুটি রুজি সবই এই প্রকৃতিকে রোমন্থন করে পেয়ে
থাকে। সভ্যতার বিকাশের একেবারে প্রাকলগ্নে মানুষ প্রকৃতির সন্তান হিসাবে খেলা
করেছে, প্রকৃতির বুকে খেলা করেছে, বিপদে পড়ে প্রকৃতির বুকে নিজের দেবতা তৈরি করে
নিয়েছে আবার কালের ক্রমবিবর্তনে এই প্রকৃতির বুকে মানুষ লুটিয়ে পড়েছে। এবিষয়ে এলেন
সেম্পেলের কথায়, ‘Man is the product of the earth’s surface. This
means not merely that he is a child of the earth,- dust of her dust; but the
earth has mothered him, fed him, set to task, directed his thoughts….’।
ঠিক তেমনিভাবে পিছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, বৃক্ষপূজা বা বনদেবতা পূজা সারা
পৃথিবীতেই কমবেশি প্রচলিত আছে। বিশেষ করে জল জঙ্গলে যাঁদের লড়াই করে জীবনের স্বাদ
পেতে হয় অর্থাৎ যে সকল উপজাতি গোষ্ঠী এখনও সভ্যতার উজ্জ্বল আলো থেকে এখনও অনেকটাই
দূরে থাকে তাঁরা এই উপাসনার বিশ্বাস আচার বিচারের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবনচর্চা
চলে। মানুষের এই ধরনের আচরণকে ভিদালের ভাষায় জেনরে-ডে-ভি (Genre-de-Vie) বলে।
আদিম মানুষের কাছে দৃশ্যমান
প্রকৃতিই প্রানবন্ত। বৃক্ষজীবনে প্রাণ আছেই বলে আদিম মানুষ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে
রচনা করল দেবপ্রতিমা। এর পূর্বে অবশ্যই বিভিন্ন আচার সংস্কারই ধর্মের ভিত্তি দৃঢ়
করেছে। সম্ভবত প্রাকৃতিক বস্তুপুঞ্জের গণ ও ক্রমানুসারে আদিম মানুষ তাঁদের
প্রতিরূপ পরিকল্পনা করেছে। শিল্পমাত্রেই প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। জীবজন্তুগুলি আবার
প্রাকৃতিক, ভৌতিক শক্তির সঙ্গে আপন ভাবে সমগোত্রীয়তা লাভ করেছে। ঠিক তেমনিভাবেই
আজকের এই আলোচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরবে যে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস আর চিরাচরিত
সংস্কার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুস্থ ব্যবহারের মেলবন্ধন
ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা দেখতে পাব, বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতায় পরিপূর্ণ এই
পৃথিবীর সব থেকে বড় অস্ত্র ধর্ম আর সেই ধর্মকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা
রাজনীতিতে যখন প্রধান রসদ, তখন প্রত্যন্ত সুন্দরবন বাসীর কাছে এই বনবিবির পূজা বা
বিশ্বাস তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম ভুলিয়ে করে তুলেছে এক, সবাই বুঝে নিয়েছে তাঁরা সবাই
প্রকৃতি মায়ের সন্তান। তাঁদের ধর্ম এই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা।
আমরা পাঠকের সামনে সেইসাথে তুলে ধরব সুন্দরবনের এই লোকায়ত সংস্কৃতির কথা।
চব্বিশ পরগণা জেলাদ্বয়ের সুন্দরবনে তথা সমগ্র
বাংলার সুন্দরবনের সাথে এই বনবিবি দেবীর নামে যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এখানকার
লোকায়ত সংস্কৃতিতে এই দেবীর আধিপত্য একচ্ছত্র। শোনা যায় সুদুর আরব থেকে এই দেবীর
আগমন। সেই কারনে সুন্দরবনকে ‘আঠারো ভাটির দেশ’ বলা হয়। এরূপ নামকরণের কারন আরব
থেকে সুন্দরবনে আসতে গেলে তখন আঠারোটি জোয়ারি নদী পেরিয়ে আসতে হত। বনচারী মানুষের
কাছে একমাত্র দেবী হিসাবে আজও পূজিত হন বনবিবি বা বনদুর্গা। বনবিবি জঙ্গলের দেবী।
জঙ্গলে আসা দরিদ্র মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আমরা বনবিবির মন্দিরে চোখ রাখলে দেখতে পাই,
একদিকে দক্ষিণ রায়, মাঝে বনবিবিসহ শাহ্জঙ্গলি ও কোন কোন স্থানে দুখের মূর্তি
থাকে। আমরা আজকের আলোচনায় একে একে জেনে
নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা। দক্ষিণ রায় বা দুখে বা কে? যখন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন
ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ বিদ্যমান, সেখানে আঠারো ভাটির দেশে জাতি
ধর্ম নির্বিশেষে এই বনবিবির পূজা করতে ব্যস্ত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে যেখানে মূর্তি
পূজায় বিশ্বাস নেই, তারাও কেন এই দেবীর পূজায় নিমগ্ন থাকে। কেন মুসলিমের বিবিমাতা
হিন্দুর পুজার বিগ্রহ হয়ে উঠল?
বনবিবির কাহিনীঃ
প্রথমে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা? কি
তার মহিমা? বনদেবী, বনবিবি, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী আরও অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। হিন্দুদের কাছে
তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী।
তাকে বলা হয় সুন্দরবনের ‘গার্ডিয়ান স্পিরিট’ বা রক্ষাকারী শক্তি। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের
৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত, দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয়
বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি
বছর অনুষ্ঠিত হয় ‘মা
বনবিবির পূজা’।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশ
চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান
ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আরব এক ফকির পরিবারে জন্ম নেন বনবিবি। তার বাবার
নাম ইব্রাহীম, মতান্তরে বেরাহিম, মায়ের নাম গুলান বিবি। কথিত আছে, ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনো সন্তান
না হওয়ায় চিন্তিত ছিলেন তারা। পরবর্তীতে ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবি মতান্তরে
গোলালবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি মনোবাসনা অবশ্যই তাকে পূরণ করতে
হবে।
গুলানবিবি গর্ভধারণ করলে
ফুলবিবি হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। তার সেই জমিয়ে রাখা ইচ্ছে পূরণের শর্ত এবার সে আদায়
করে নেয় গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে সেই
জঙ্গলেই গুলানবিবির ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান বনবিবি ও শাহ্ জঙ্গলি। শাহ জঙ্গলি
বনবিবির ছোটভাই নাকি যমজ ভাই, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তাদের দেখাশোনার জন্য নাকি
স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার দাসীকে। বনবিবি সেখানে বড় হয় এক মাদী হরিণের কাছে।
সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবিকে দুই শিশু সন্তানসহ মক্কাতে ফিরিয়ে
নিতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায়
বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সাথে তার এমন হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের ছেড়ে বাবার হাত থেকে চলে যাওয়া তার পক্ষে
অসম্ভব ছিল। বোনের টানে বনবিবির সাথেই জঙ্গলে রয়ে যায় শাহ জঙ্গলি।
অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে
সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি। এখানেই জন্ম হয় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী
দুই ভাইবোনের। এই দুই সন্তানের জন্মের পরে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে
ইব্রাহীম পরিবার। ‘বনবিবির
কেরামতি’ বা ‘বনবিবির জহুরনামা’ নামক গ্রন্থে বনবিবির এমনি আরও অসংখ্য গল্পের কথা বর্ণিত
আছে। বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে
বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি খুঁজে পায় দুটি জাদুর টুপি। এই জাদুর টুপিতে চেপে তারা ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্তানের আঠারো
ভাটির দেশে। অন্য একটি মতানুসারে হযরত জিব্রাঈল (আ.) তাদের আঠারোটি দেশ ঘুরিয়ে
দেখান। হিন্দুস্তানে পৌঁছে আযান দেন শাহ জঙ্গলি।
প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী দেবী বনবিবির একমাত্র চরম
প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ রায় নামে এক ব্রাহ্মন মুনি যিনি এই গভীর জঙ্গলে বসবাস করেন
এবং ক্রোধবশতঃ তিনি মানুষ খেতে ইচ্ছা করেন। সেইসুত্রে তিনি বাঘের ছদ্মবেশ ধারন করে
বনে ঘুরে বেড়ান যাতে জঙ্গলের কোন সম্পদ মানুষ না নিয়ে যেতে পারে। আর কেউ যদি
লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাকে দক্ষিণ রায় তার জীবনকে কর হিসাবে গ্রহণ করে
থাকে। মতান্তরে, এই দক্ষিণ রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত জমিদার যিনি এই আঠারো ভাটির
দেশের সমগ্র ম্যানগ্রোভ সাম্রাজ্যসহ সকল সম্পত্তির মালিক আর এই বনের সকল বাঘ তার
প্রজা। অহংকারে জমিদার মানুষখেকো রাক্ষসে পরিণত হয় এবং বাঘের আক্রমণে মানুষের মাঝে
দক্ষিণ রায় এক সন্ত্রাস হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে যে মধুর
সম্পর্ক ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে।
অসহায় মানুষের আর্তনাদে আল্লাহ্ এই নৈরাজ্য
ঠেকাতে এক বনবাসী তরুণী কন্যাকে বনের কর্তৃত্ব প্রদান করে তাকে বনবিবি করেন।
প্রকৃতপক্ষে এই বনবিবি এবং তার যমজ ভাই শাহ জঙ্গলি শিশুকালে তার পিতামাতা কর্তৃক
পরিত্যক্ত হয় বনের মধ্যে এবং এক হরিণ তাকে লালন পালন করছিল। একটা বিষয় লক্ষণীয়,
দুজনের নামের সাথে প্রকৃতি (বন ও জঙ্গল) জড়িয়ে আছে। আল্লাহ্ এর স্বপ্নাদেশে দুই ভাইবোন
মা ফতিমার আশীর্বাদ নিতে মদিনায় গমন করে। সেখান থেকে মক্কায় গিয়ে এই সুন্দরবনের
জন্য পবিত্র মাটি নিয়ে ফিরে আসে।
বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি যখন
সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিল নিষ্ঠুরতার প্রতীক দক্ষিণ রায় বা
রায়মণি। শাহ জঙ্গলির সেই আযানের ধ্বনি কানে যায় দক্ষিণ রায়ের। তাদের সম্পর্কে
খোঁজখবর নিতে বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠায় রাজা। সনাতন এসে দুই ভাইবোনের কথা জানালে দক্ষিণ রায় আল্লাহ্ র উপর খেপে গিয়ে বনবিবি ও শাহ
জঙ্গলিকে তাড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করল। থামালেন তার মা নারায়নী দেবী। তিনি বললেন, একজন
মহিলার সাথে একজন পুরুষের যুদ্ধ করা শোভা পায় না। নারায়নীর সাথে বনবিবি আর শাহ্ জঙ্গলির সাথে
দক্ষিণ রায়ের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দক্ষিণ রায় নিজে যুদ্ধের
ময়দানে যেতে চাইলে তার মা নারায়ণী তাকে থামিয়ে দেয়। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত
নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বনবিবি আর শাহ জঙ্গলির সাথে ছিল অলৌকিক
ক্ষমতা, কাজেই দীর্ঘযুদ্ধের পরে হার
মানতে বাধ্য হয় নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে দয়াপরবশ হয়ে বনবিবি তার অর্জিত
সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে নারায়ণী ও তার পুত্রকে। নারায়ণীর সাথে সখ্যতা গড়ে
ওঠে। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় বনবিবি, দক্ষিণ রায় রাজত্ব করে জঙ্গলের গহীন কোণে। মাতা বনবিবি জঙ্গলের নৈরাজ্য বিনাশ করে তৃপ্ত হন। কোন কোন স্থানে এই বনবিবির পাশাপাশি তার সই
নারায়ণী দেবীর পুজাও হয়ে থাকে।
এদিকে দক্ষিণ রায়ের শান্তি নেই মনে। প্রতিশোধের
আগুনে জ্বলে মরে। এমতাবস্থায়, গ্রামের দরিদ্র দুখে তার বাবা মায়ের সাথে বসবাস করত।
তার বাবা একদিন মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। সেই থেকে দুখের
মা আর তাকে কোথাও যেতে দেয় না। সবসময় যেন চোখে হারায়, কিন্তু দুখে মনখারাপ করে
ঘুরে বেড়ায়। তার বাসনা জাগে, সেও নৌকায় চড়ে ঐ দূরে মাছ ধরতে যাবে, কাঠ ও মধু
সংগ্রহ করতে যাবে। কিন্তু তার মা তাকে ছাড়তে চায় না। তাই দুখে বায়না করলেও তার
মায়ের ভয়ে তাকে কেউ নিয়েও যায় না। মা বনবিবির কথার মাঝে ‘দুখে’র কথা এসে যায়। এই ‘দুখে’
আর কেউ না, তিনি দুঃখের প্রতীক মাত্র। বাঘ যখন দক্ষিণ রায় এর মতো অহংকারী জমিদার
এর প্রতিরূপ, দুখে সেখানে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি। দুখের পালা শুনলে আমরা এ
বিষয়ে বিশদ জানতে পারি। যাইহোক, এই দুখে এক কিশোর ছেলে, সুন্দরবনের প্রান্তিক
গ্রামে তার বিধবা মাতার সঙ্গে কষ্ট করে দিনযাপন করছিল।
একদিন তার দূর সম্পর্কের কাকা ধোনা (এখানে ‘ধোনা’
কে ধনসম্পদের প্রতীক হিসাবে মানা হয়) তাকে জঙ্গলে গিয়ে মধুসংগ্রহের লোভ দেখায়। তখন
মায়ের কান্না ও নিষেধ উপেক্ষা করে দুখে তাদের সাথে চলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরে
ঘুরে কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। একদিন রাত্রে ধোনা
যখন নিদ্রার কারনে একটি দ্বীপে নামে তখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা দক্ষিণ রায় তার
সাথে দেখা করে বলে যদি সে প্রচুর মধু পেতে চায় তাহলে দুখে কে তার হাতে সমর্পণ করে।
তাহলে সে এক নৌকা ভর্তি মধুর ঠিকানা পেয়ে যাবে। প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরে ভয়ে ও
লোভে পড়ে তাতেই রাজী হয়ে যায়। দক্ষিণ রায় আরও হুমকি দেয় যদি সে তার কথা না রাখে
নৌকাসহ সবাইকে জলে ডুবিয়ে মারবে। এই কথা দুখে সব শুনতে পেয়ে তার মায়ের জন্য কাঁদতে
থাকে। কথামত, মধু সংগ্রহ করে ধোনা দুখে কে নিয়ে গিয়ে সুন্দরবনের গভীরে কেঁদোখালি দ্বীপে ছেড়ে আসবে, যেখানে দক্ষিণ রায়ের প্রবল অত্যাচার থেকে কেউ
রক্ষা পায় না। দুখে গভীর জঙ্গলে যখন বাঘের আক্রমণের কথা ভেবে উপায়ান্তর না দেখে
মায়ের কথা ভাবতে থাকে। মনে পড়ে যায় মা তাকে
বলেছিল, জঙ্গলে বিপদে পড়লে মা বনবিবিকে স্মরণ করলে তিনিই রক্ষা করেন। দুখে চিৎকার
কর কাঁদতে কাঁদতে মনপ্রাণ দিয়ে মা
বনবিবিকে একাত্মভাবে স্মরণ করে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মা বনবিবি হাজির হয়ে
তাকে আশ্বাস দেন যে, ‘ভয় নেই দুখে, আমি রক্ষা করব তোকে। তুই এগিয়ে যা’।
পরের দিন সকালে ধোনা সবাইকে বলে যে আমাদের আবার
কেঁদোখালি দ্বীপে যেতে হবে যেখানে ইতিপূর্বে গিয়ে কিছু পাওয়া যায় নি। তাই ধোনার
লোকেরাও যেতে চাইল না। তখন ধোনা আর দক্ষিণ রায়ের মধ্যে যা কথা হয়েছে সব শোনায়
ধোনা। প্রথমে রাজি না হলেও ভয়ে দুখের প্রতি ভালোবাসা উবে গেল। নৌকা এগোচ্ছে।
দক্ষিণ রায় নৌকাকে অনুসরণ করতে করতে মৌমাছিকে নির্দেশ দেয় যে কেঁদোখালি দ্বীপের
সকল গাছে মৌচাক ভরে দিতে। সেইমত ধোনা গিয়ে দেখে অবাক। মনের আনন্দে নৌকার সকল জার
মধুতে ভর্তি করে নিল। দক্ষিণ রায় তার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিল আর বলল তোমাদের এই
মধু ও চাক থেকে মোম আলাদা করলে বেশী টাকায় বিক্রি হবে। কথিত আছে এইভাবে চাক থেকে
মোমকে আলাদা করার শিক্ষা মানুষ শিখেছিল। নৌকা ছাপিয়ে মধু দ্বীপের চারদিকের জলে
পড়তে লাগলো। আজও এই দ্বীপের নিকটের জল মধুপানি বা মিষ্টি জল নামে পরিচিত। আনন্দে
ভাসতে ভাসতে লোকেরা দুখে কে পাঠাল জঙ্গল থেকে রান্নার শুকনো জ্বালানি কাঠ নিয়ে
আসতে। মন না চাইলেও দুখে গভীর বনে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ধোনা লোকজন নিয়ে নৌকা
নিয়ে স্থানত্যাগ করল।
ঠিক এমন সময়ের জন্য দক্ষিণ রায় অপেক্ষা করছিল সারাদিন।
দুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খেতে উদ্যত হতে দুখে মিনতি জানায় আর বনবিবিকে স্মরণ
করে। মাতা বনবিবি তার ক্রন্দনে এসে হাজির হয় ভাই শাহ্ জঙ্গলিকে নিয়ে। মাতা বনবিবি
দক্ষিণ রায়কে হত্যা করতে ভাইকে নির্দেশ দিয়ে তার কবল থেকে দুখে কে মুক্ত করে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়।
এমতাবস্থায়, দক্ষিণ রায় পালিয়ে তার বন্ধু গাজীর কাছে আশ্রয় নিয়ে পরামর্শ চায়। গাজী
তাকে মা বনবিবির কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইতে বলায় দক্ষিণ রায় বনবিবির কাছে জীবন ভিক্ষা
করে। সবার কাছে তিনি গাজী পীর নামেই খ্যাত। শেষ
পর্যন্ত গাজী পীর গিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বনবিবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে
তারা নিষ্ঠুর রাজার কোনো ক্ষতি করবে না। বিনিময়ে গাজী দুখেকে সাত নৌকাভর্তি
মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দেন। বনবিবির পোষা কুমির সেকোর পিঠে চড়ে গ্রামে ফিরে
যায় দুখে। মা তার অসীম করুণায়
দক্ষিণ রায়কে নিজ পুত্রগুনে ক্ষমা করে দেন এই শর্তে যে এখন থেকে জঙ্গলের মানুষসহ
সকল প্রাণীকে ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখতে হবে আর বনের সকল সম্পদে সবার সমান অধিকার থাকবে।
মায়ের ভক্তরা সবাই বিশ্বাস করেন যে, প্রয়োজনের
তুলনায় সম্পদ সংগ্রহ করে অপচয় বা সঞ্চয় করলে মা বনবিবি বিপদে তাঁদের রক্ষা করেন
না। নিজ
গ্রামে এসে বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে দুখে। তার কথায় অভিভূত হয়ে সে
গ্রাম তো বটেই, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও
শুরু হয়ে যায় বনবিবির উপাসনা। ধোনা তার ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের
বিয়ে দেয় এবং দুখেকে গ্রামের চৌধুরী বা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর
মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা
পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ ই জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে
বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা।
খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, গোসবাতে বেশ কিছু অঞ্চলে
ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত
হয়েছে।
সাধারণত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ডাকে মা
সাড়া দেন যদি বনবিবি জহুরনামা শুরু ও শেষের দিকে খানিকটা পাঠ করেন ভক্তিভরে। বাউলির
পরামর্শ ছাড়া কেউ জঙ্গলে প্রবেশ করেন না। এই বাউলি হল বাঘজাদুকর যাঁদের কথা বাঘ
নাকি শোনে। প্রকৃতপক্ষে এই বাউলি শব্দটি আরবির সুফি সাধুদের বোঝায় যারা মুলত
ষষ্ঠদশ শতকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল উদ্ধার ও ইসলাম ধর্মের প্রচারের কাজে
সহায়তা করেন। বর্তমানে বাউলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও দেখা যায়।
সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজও এই বাউলি বা ইসলামের বিভিন্ন তুকতাক বনচারী মানুষের
খুব কাজে লাগে। স্বভাবে এরা খুব বিনয়ী ও ভদ্র, জঙ্গলে যারা কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে
যায় তাঁদের প্রতি এরা খুবই দরদী। জঙ্গলের জন্ম প্রকৃতির সাথে মানুষের সাম্যতা আনার
জন্য। তাই সুন্দরবনের বনবিবির মন্দিরগুলিতে কোন দরজা প্রায় নেই বললেই চলে। তা সবার
জন্য উন্মুক্ত। বাঘেদের এলাকায় ঢোকার আগে যাতে তারা বনবিবির পূজা দিতে পারে,
সেজন্য দেবীর মন্দিরগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা আছে।
সুন্দরবন বাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে, তাহলে তাকে মা
বনবিবি তাকে শাস্তি দিয়ে থাকে, কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা তাকে
রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে, তার আড়ালে কোন
কিছুই করা যায় না। জনৈক বিধবা ফুলমাসির কথায়, এই তো বছর দশেক আগে একদল কাঠুরিয়াকে
সাপের ছোবলে মরতে হল, কারন ওরা জঙ্গলের নিয়ম লঙ্ঘন করে দূষিত করছিল। আবার
যাত্রাভিনেতা সামসুদ্দিনের কথায়, আমরা যদি জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করি তাহলে মায়ের
কৃপা থেকে সবাই বঞ্চিত হব। মায়ের কাছে সবাই সন্তান, কোন ভেদাভেদ নয়, সবাই একজাতি।
একসাথে পূজা করলে পরে মায়ের সুখ, শান্তি। আরও জানা যায় মা বনবিবি কারোর লোভকে
প্রশ্রয় দেন না। যদি কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে চাহিদার তুলনায় বেশী সম্পদ সংগ্রহ করে
চিরাচরিত নিয়মানুসারে মা তাদেরকে শাস্তি দেন।
বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের আপনার জন। তিনি আর সুন্দরবন ছেড়ে কোনকালেই যাবেন,
এমনকি তার পিতা ইব্রাহিম তার পরিত্যক্ত মাতাকে নিয়ে যেতে এলেও না। কারন জঙ্গলের এই
কঠিন জীবন ছেড়ে পিতার হাত ধরে মাতা গুলাব বিবি আগের জীবনে ফিরে গেলেও বনবিবি যান
নি এই বনবাসী মানুষের স্বার্থে। আল্লাহ্ তাকে পাঠিয়েছেন অশুভ শক্তির হাত থেকে
আর্তকে রক্ষা করার জন্য।
সামাজিক প্রেক্ষাপটঃ
সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর
মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা
পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ ই জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে
বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা।
খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, গোসবাতে বেশ কিছু অঞ্চলে
ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত
হয়েছে।
সাধারণত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ডাকে মা
সাড়া দেন যদি বনবিবি জহুরনামা শুরু ও শেষের দিকে খানিকটা পাঠ করেন ভক্তিভরে।
বাউলির পরামর্শ ছাড়া কেউ জঙ্গলে প্রবেশ করেন না। এই বাউলি হল বাঘজাদুকর যাঁদের কথা
বাঘ নাকি শোনে। প্রকৃতপক্ষে এই বাউলি শব্দটি আরবির সুফি সাধুদের বোঝায় যারা মুলত
ষষ্ঠদশ শতকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল উদ্ধার ও ইসলাম ধর্মের প্রচারের কাজে
সহায়তা করেন। বর্তমানে বাউলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও দেখা যায়।
সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজও এই বাউলি বা ইসলামের বিভিন্ন তুকতাক বনচারী মানুষের
খুব কাজে লাগে। স্বভাবে এরা খুব বিনয়ী ও ভদ্র, জঙ্গলে যারা কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে
যায় তাঁদের প্রতি এরা খুবই দরদী। জঙ্গলের জন্ম প্রকৃতির সাথে মানুষের সাম্যতা আনার
জন্য। তাই সুন্দরবনের বনবিবির মন্দিরগুলিতে কোন দরজা প্রায় নেই বললেই চলে। তা সবার
জন্য উন্মুক্ত। বাঘেদের এলাকায় ঢোকার আগে যাতে তারা বনবিবির পূজা দিতে পারে,
সেজন্য দেবীর মন্দিরগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা আছে।
সুন্দরবনবাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না
মানে তাহলে তাঁকে মা বনবিবি শাস্তি দিয়ে থাকে কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত
থেকে মা তাঁকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে।
জনৈক ব্যক্তির কথায় আমরা সবাই মায়ের সন্তান, আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, জাতপাত
নিয়ে যদি আমরা রাজনীতি করি তাহলে মায়ের কৃপা থেকে বঞ্চিত হব। মায়ের কাছে সবাই
শান্তি কামনা করে। মা বনবিবি কারুর লোভকে প্রশ্রয় দেন না। যদি কেউ লোভের বশবর্তী
হয়ে বেশী সম্পদ সংগ্রহ করে থাকে তাহলে চিরাচরিত নিয়মানুসারে মা তাঁকে শাস্তি দেন।
বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের আপনার জন। তিনি আর সুন্দরবন ছেড়ে কোনকালেই যাবেন না,
এমনকি তার পিতা ইব্রাহিম তার পরিত্যক্ত মাতাকে নিয়ে যেতে এলেও না। কারন জঙ্গলের এই
কঠিন জীবন ছেড়ে পিতার হাত ধরে মাতা গুলাব বিবি আগের জীবনে ফিরে গেলেও বনবিবি যান
নি এই বনবাসী মানুষের স্বার্থে। আল্লাহ্ তাকে পাঠিয়েছেন অশুভ শক্তির হাত থেকে
আর্তকে রক্ষা করার জন্য।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ
World Commission on Environment and Development এর কথায় "Sustainable
development is development that meets the needs of the present, without
compromising the ability of future generations to meet their own needs." সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদে
পরিপূর্ণ এই ক্ষেত্র ধীরে ধীরে মানুষের করালগ্রাসের হাতছানিকে উপেক্ষা করে যেটুকু
আজও দাঁড়িয়ে আছে তা এই বনবিবির মাহাত্ম্য ও তাঁর প্রতি স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ও
ভয় থেকে। কারন প্রকৃতির এই সম্পদ আর্তের চাহিদার জন্য, দুঃস্থের সুস্থতায়
ব্যবহারের জন্য। প্রকৃতির সেই অপার করুণা কোনভাবে যেন মানুষের লোভানলে পুড়ে না
নষ্ট হয়ে যায় তার জন্য বনবিবির এত নিষ্ঠুর অনুশাসন। সুন্দরবনবাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে তাহলে
তাঁকে মা বনবিবি শাস্তি দিয়ে থাকে কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা
তাঁকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে। প্রয়োজনের
তুলনায় কেউ যদি সম্পদ আহরণ করে থাকে বনবিবি তাঁকে শাস্তি প্রদান করে থাকে। মহাত্মা
গান্ধীর কথায়, “The
world has enough for everyone's need, but not enough for everyone's greed.”
এই তত্ত্ব যদি আমরা মনে প্রাণে মেনে চলি তাহলে এই বিশ্বচরাচরে যত সম্পদ আছে তা
মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বলে প্রকাশ পাবে।
অন্যান্য লোকদেবতাঃ
সুন্দরবনের বনবিবির
পাশাপাশি দক্ষিণ রায় বা দক্ষিণেশ্বর কে পূজা করতে সুন্দরবনের বেশ কিছু অঞ্চলে
লক্ষ্য করা গেছে। সুন্দরবনের ধপধপি অঞ্চলে এই দেবতার বিরাট এক মন্দির আছে যেখানে
প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার স্থানীয় মানুষসহ দূর থেকে ভক্তরা আসেন মানত করতে। ভর ধরে
মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানের রাস্তা খোঁজেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন আবার
অনেকেই করেন না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ এই যন্ত্রসভ্যতার সাথে থেকে থেকে যখন ক্লান্ত
হয়ে পড়েন, কিংবা সকল চেষ্টা বিফলে চলে যায়, আপনজন বিয়োগের সম্ভাবনা প্রবল হয় তখন
মানুষ সেই অন্তরালে থাকা তৃতীয় শক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ায় শ্রেয় মনে করেন। এই
সকল লোকাচারের স্থান ও কাল বিন্যাস করলে বোঝা যায় সেদিনের সুন্দরবন আজকের
সুন্দরবনের মত না। আবার আজকের সুন্দরবন কলকাতার মত এত ভালো পরিষেবাযুক্ত না। তাই
মানুষ প্রকৃতির সাথে থাকতে থাকতে প্রকৃতির নিয়মই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন।
সুন্দরবনের লোকাচার
ও লোকসংস্কৃতিতে বনবিবি অনেকটা জায়গা নিলেও সুন্দরবনের আরও অনেক দেবদেবী বা
সংস্কারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোকাচার বর্তমান যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বিস্তারিত
ব্যাখ্যা করা দুরূহ। প্রসঙ্গক্রমে এই প্রবন্ধে কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। সুন্দরবনের
পাঁচুঠাকুর বা পঞ্চানন লোকসংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ। বিশেষ করে ছোট শিশুদের মঙ্গল
কামনায় সুন্দরবনের মানুষ এই পাঁচুঠাকুর বা পঞ্চাননের পূজা করে থাকে। পঞ্চানন শিবের
অপর এক রূপ। কেউ বা বলে থাকে শিবের ছেলে পঞ্চানন জাত গোত্র বিচারে স্বর্গে স্থান
না পেয়ে মর্ত্যে অবস্থান করছেন। যেমন রাগী তেমন শান্ত প্রকৃতির। এই পাঁচু পাঁচির
মন্দিরে সন্তানের মঙ্গল কামনায় অনেকে মানত করে ঢেলা বেঁধে দেন।
বনবিবির পাশাপাশি
ওলাবিবি সুন্দরবনের অন্যতম লোকদেবী। সাতবিবিদের মধ্যে অন্যতম এই দেবীর কৃপায়
জলবাহিত রোগ তথা কলেরা, ওলাওঠা রোগের অধিনিয়ন্ত্রক হলেন এই দেবী। অনিয়ন্ত্রিত
পায়খানাকে ওলা বা নামা বলে আর মাত্রাছাড়া বমনক্রিয়া ওঠা বলে মনে করা হয়।
প্রাচীনকাল থেকে আজও সুন্দরবনের জল, জঙ্গল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি
যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রিসেবার অভাবে এই ধরণের সমস্যার মধ্যে স্থানীয় মানুষ
প্রায়শই ভুগতেন। তখন তাঁরা এই দেবীর স্মরণাপন্ন হয়ে কেউ কেউ মুক্তি পেতেন। সেই
বিশ্বাসে ওলাবিবি লোকদেবী হিসেবে পূজা পান। হিন্দু দেবী ওলাইচণ্ডীর গুণগুলো রপ্ত
করে তিনিও জনমানসে সমান গুরুত্ব পেতে থাকেন।
এছাড়াও ফুলবিবির
আরাধনা হয় গৃহশান্তি, বাধাবিঘ্ন, রোগারোগ্য ও মানসিক প্রশান্তি প্রাপ্তির আশায়।
তিনি সাতবিবির প্রধানা ওলাবিবির সহচরী বলে মনে করা হয়। ফুলবিবি মানুষ প্রকৃতির
পাশাপাশি সহাবস্থান সমর্থন করেন এবং বিশেষ এক ঐশী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে লোকদেবতার
স্থান পেয়েছেন।
ওলাবিবির আর এক সখী
ঝেটুনেবিবি। মানুষ যখন কোন কালান্তক রোগে আক্রান্ত হয়ে একেবারে সকল আশা ছেড়ে সময়ের
হাতে ছেড়ে দেন, তখন এই দেবীর কৃপায় সেই রোগী আরোগ্য লাভ করেন বলে প্রচলিত। নানা
কেরামতি, জাদুক্ষমতায় ও ওষধিবিদ্যায় পারদর্শী এই মুসলিম সুফি সাধিকা। বাত ও ধনুষ্টঙ্কার
রোগের পরিত্রাতা হিসাবে তিনি পূজিত সুন্দরবনের লোকালয়ে। দেবী শীতলা যেমন বসন্ত
রোগের আরোগ্য প্রদায়িনী হিন্দু দেবী, তিনিও তেমন অনেক গুরুতর রোগ থেকে মুক্তি
প্রদান করে লোকদেবী হিসাবে পূজিত হন।
হাম, বসন্ত, ওলাওঠার
মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিতে বাংলার প্রান্তিক অঞ্চল উজাড় হয়ে যেত। সুন্দরবনের
ঘরে ঘরে এই সমস্যা সাম্প্রতিক অতীত কাল পর্যন্ত দেখা যেত। সেই রোগের কারণে মৃত্যুর
মড়ক লেগে যেত গ্রামের পর গ্রাম। সেই সমস্যা নিরসন করতে গ্রামের মাঝে আর এক বিবির
পূজা হত। তিনি হলেন মড়িবিবি। দেবী চণ্ডী ও শীতলার মতো এই দেবীও জনমানসে বেশ প্রভাব
বিস্তার করেছিল। ইসলাম সাধিকা এই দেবী মরণাপন্ন রোগীর পরিত্রাতা হওয়ায় মড়িবিবি
নামে পরিচিত হন।
অতীত সুন্দরবনের
প্রাকৃতিক ভয়াবহতা মানুষকে প্রাকৃতিক, আদিদৈবিক, ভৌতিক কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে
অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে মানুষ আশঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে দিনযাপন করতেন। জীবনযুদ্ধে
পরাজয় স্বীকার করে কিংবা আশাহত হয়ে একটা সময়ের পর তাঁরা মনে করতেন এসকল দৈবী কোপ।
কল্পিত এই ভয় ও আতঙ্ক থেকে জন্ম নিত নানান শারীরিক ও মানসিক রোগ। এই সকল সমস্যা
নিরসন করতে সুন্দরবনের মানুষের ভরসা ছিল আজগৈবিবি।
এরপর যে বিবির কথা
বলতে হয় তা হল ঝোলাবিবি। সাধারণত কঠিন পেটের রোগ বা রক্ত আমাশয়ে ভুগতে ভুগতে রুগীর
একান্ত কাহিল অবস্থাকে বলা হয় ঝোলা। আন্ত্রিকের কারণে শরীরে জলশুন্য হয়ে কিংবা কোন
মারনরোগে শয্যাশায়ী অবস্থান থেকে যে বিবি উদ্ধার করেন তিনিই ঝোলাবিবি। তিনি অন্যান্য
বিবির মত সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলমানের কাছে স্তুপ বা মূর্তি রূপে
পূজিত হন।
সুন্দরবনের জল,
জঙ্গল, নদী-নালা অধ্যুষিত শ্বাপদসঙ্কুল বাদাবনের নৌজীবী, বাউলে, মৌলে, মাঝিমাল্লা,
জেলে, বনজীবি, কাঠুরিয়া বা কাঁকড়ামারাদের কাছে আশার আলো হল আসানবিবি। নদীপথে কিংবা
জঙ্গলে যে কোন বিপদে তাঁর ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করলে তিনি তাঁদের রক্ষা করেন বলে লোকবিশ্বাস।
এমনকি শ্রমজীবী ও গরীব চাষিদের কাছেও তিনি মুশকিল আসান। তাই তো তিনি আসানবিবি।
এছাড়াও হাড়িঝি,
চণ্ডী, শীতলা, মনসার অবস্থান সুন্দরবনের লোকবিশ্বাসে বেশ পোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন।
সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া কিংবা সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির প্রাণ ফিরে পাওয়ার
জন্যে যেমন মনসার পূজা হয় তেমন হাম, বসন্ত থেকে রক্ষা পেতে শীতলা পূজা সুন্দরবনের
লোকবিশ্বাসে আজও গেঁথে আছে। এখনও অনেক জায়গায় রাতের পর রাত জেগে চলে শীতলা, মনসা ও
বনবিবির পাঁচালি গান কিংবা দুখের বনবাস, সতী বেহুলা বা শীতলা মায়ের কৃপা যাত্রা
পালা সুন্দরবনসহ দুই চব্বিশ পরগণার লোকসংস্কৃতিতে জায়গা দখল করে আছে।
সুন্দরবনের জনজীবনে
মা ষষ্ঠীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সমাজ সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে দরকার উৎপাদন। সে
খাদ্য হোক আর সন্তান হোক। সেই উৎপাদনের দেবী হলেন এই ষষ্ঠী দেবী। তাঁর কৃপায়
সন্তানধারণ বা সন্তানের মাঙ্গলিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুন্দরবনের ঘরে ঘরে
সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে ষষ্ঠী দেবীর পূজা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
এছাড়াও নারায়ণী,
বারা ঠাকুর, মাকাল ঠাকুর, ধর্ম ঠাকুর, পঞ্চানন্দ, আটেশ্বর, পীর গোরাচাঁদ, গাজী
সাহেব, কালু রায়, সত্যপীর, বসন্তরায়, ঘণ্টাকর্ণ, মানিকপীরসহ সারাবছর নানা তিথিতে
নানান লোকদেবতার পূজা করার বিধান লক্ষ্যনীয়। আবার সুন্দরবনের বিভিন্ন উপজাতি বা
আদিবাসীগোষ্ঠীদের মধ্যে একটা নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকাচার বা বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
পর্যালোচনাঃ
আজকের আলোচিত এই সুন্দরবন, দক্ষিণ ২৪ পরগণা
জেলার দক্ষিণের বৃহত্তর অংশ। এই চব্বিশ পরগণা জেলা একদা রাজ্যের বৃহত্তম জেলা
হিসাবে পরিগণিত হত। ১৯৮৬ সালের ১ লা মার্চ এই অবিভক্ত জেলা উত্তর দক্ষিণে বিভাজন
হয়ে গেলেও জেলার সংস্কৃতির বিভাজন আজও করা যায় নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আজকের দক্ষিণ
২৪ পরগণা জেলার আয়তন পর্যালোচনা করে দেখলে সেটাও কম নয়। তার আয়তন ও বিস্তার বিচার
করে বেশ কয়েকবছর ধরে এই জেলা থেকে সুন্দরবন অঞ্চলকে পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করার
দাবী বর্তমান। আয়তন ও বিস্তার যত বেশী হয় ততই ভিন্ন জনজাতির সংস্কৃতিও ভিন্ন হয়ে
থাকে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই জেলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে
আলোচনা করতে গেলে দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি দুটো পাশাপাশি তুলে
ধরতে হয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিসরে সেটা সম্ভব নয়।
এই জেলা তথা সুন্দরবনের ভৌগলিক অবস্থান ও
বিস্তার এই জেলার সংস্কৃতিতে মিশ্র সংস্কৃতির ভাবান্তর ঘটেছে। জেলার উত্তরে রয়েছে
কলকাতা শহর যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে বাড়তে বৃহত্তর কলকাতা হিসাবে জেলার উত্তরের
অংশে প্রভাব ফেলেছে। এই সকল স্থানে নিজস্ব সংস্কৃতি (যা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত) যেমন থাকে
তেমন আধুনিকতার ছোঁয়ায় শহুরে সংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নেবার এক লড়াই থাকে এবং সেই
শহুরে সংস্কৃতি রপ্ত করতে পারলে এই স্থানের মানুষ ফেলে আসা সংস্কৃতি অর্থাৎ জেলার
নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি এক নাক সিটকানো অনুভূতি দিয়ে থাকেন। আবার জেলার দক্ষিণ
প্রান্তে ও সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের মাঝে প্রথিত রয়েছে আদি সংস্কৃতি। একটু
শিক্ষা ও আধুনিক সভ্যতার আলো পেলে এই সংস্কৃতি থেকে মানুষের মুখ ঘুরিয়ে উচ্চ কোটির
সংস্কৃতি গা ভাসিয়ে নিজেকে জাতে তোলার অসীম লড়াই চলে। দক্ষিণের মানুষের এই প্রবণতা
এক ধরণের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। নিজে জেলার মানুষ হয়েও তুলনামূলক দক্ষিণভাগের
বাসিন্দাকে হেয় করতে দোখনো বলতে অভ্যস্ত।
যাইহোক, এই সুন্দরবনের সংস্কৃতি তথা এই বৃহৎ জেলার
সংস্কৃতি অনেকটাই ধর্ম আর পূজা বা মেলার সাথে জড়িয়ে। মহাভারতের সময় থেকে এই
ভূভাগকে ম্লেচ্ছদের দেশ বলা হয়ে থাকলেও গঙ্গাসাগরের পুণ্যতীর্থ আর জেলাজুড়ে
মহাপ্রভুর চরণস্পর্শে জেলার ভাবধারা বদলে গেছে। বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণের
মতো মানুষ ও তার সামাজিক সংস্কার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান। হয়তো অনেকাংশেই তা
বাংলার অনেক জেলার সাথে মিলে যায়। যেমন বছর শুরু হয় পয়লা বৈশাখ বা গোষ্ঠমেলা দিয়ে।
সেদিন কাকভোরে উঠে চাষের জমিতে আগুন দেওয়া, পবিত্রমনে পূজা করা এবং অন্যান্য দিনের তুলনায়
একটু ভালো খাওয়ার আয়োজন করা, আত্মীয়দের মধ্যে নতুন পোশাক উপহার পাঠাবার বিধান বর্তমান।
কারণ,
জেলার মানুষের মননে
চিন্তনে একটা বিশ্বাস কাজ করে যে এই দিন যে যেমন কাজ করবে বছরের বাকিটা সময় তার
তেমনভাবে চলবে। চাষের জমিতে আগুন দেবার সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা
যাযাবর জাতির ঝুম চাষের সংস্কৃতিকে মনে করালেও কিছুটা বিজ্ঞানের অবস্থান লক্ষ্য
করা যায়। তবে সেইপ্রকার আগুন দেখা যায় না। কেবল লোকসংস্কার রক্ষার্থে চলে।
তেমনভাবে এই মাসে অক্ষয়তৃতীয়ার ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে মনে করা হয় ভগবানের কৃপায়
সব অক্ষয় থাকে।
আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার দিন থেকে
প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কলমিশাক আর পটল খাবার বিধান নেই। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য যে
ঐসময় ভগবান জগন্নাথ পটলের বালিশে মাথা দিয়ে কলমিশাকের বিছানায় শুয়ে থাকেন। এর
পিছনে অন্য কোন পরাবৈদিক কারণ থাকতেও পারে। অম্বুবাচী চলাকালীন মাঠে কোনরূপ কোদাল, লাঙ্গল চালানোর বিধান নেই যেমন তেমন বিগ্রহের
মুখ দর্শন করা যাবে না। এভাবেই অন্যান্য মাসের পূজা সংস্কার বঙ্গের অন্য জেলার মতই
চলে তবে কার্তিক পূজা নিয়ে দারুণ মাতামাতি চলে। বিবাহিত কিন্তু অপুত্রক পরিবারে
লুকিয়ে কার্তিক দেবার বিধান আছে। এতে নাকি সেই পরিবারে অতি শীঘ্রই সন্তানের আগমন
ঘটে। সময়ের সাথে সাথে এই সংস্কারে নবদম্পতিরা বিরক্ত হয়ে অশান্তি পর্যন্ত হতে দেখা
যায়।
এইসময় দশহরা পূজা বা সর্প দংশন থেকে রক্ষা
পেতে বাড়িতে বাড়িতে একটা সময় হাঁসা বলি দিয়ে মনসার পূজা করা হত। এখন জেলার এই
সংস্কৃতি বাসন্তীসহ সুন্দরবনের কয়েকটা ব্লকে সীমিত হয়ে গেছে। সর্পদংশন ও মৃতরোগীর
বাঁচানোর জন্য যে মন্ত্র সংস্কার তা দক্ষিণ বঙ্গের সংস্কৃতির বড় উপাদান, বিশেষ করে সুন্দরবনের প্রান্তিক জেলে, কাঠুরেদের মধ্যে আজও বিদ্যমান। চিকিৎসার থেকে
তাঁরা এই মন্ত্র সঞ্জীবনী ক্ষমতায় বেশী বিশ্বাসী। অনেকক্ষেত্রেই সর্পদংশনে মৃত
রোগীকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয় গঙ্গায়। তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস যে লখিন্দরের মত একদিন
তাঁদের নিকটজন বেঁচে ফিরে আসবে। এই সংস্কারে মনসা পূজার পাশাপাশি মনসার পাঁচালী
গান রাতের পর রাত অনুষ্ঠিত হতে থাকে সুন্দরবনসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে। তবে বাসন্তী
গোসাবাতে বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনবিবি পাঁচালীগান বা দুঃখের বনবাস যাত্রাপালা
অনুষ্ঠানের সংস্কার আছে।
যখন বাড়িতে বাড়িতে গুটিবসন্তের ছোঁয়া তখন
শীতলা মন্দিরে পূজা বা শীতলার পাঁচালীগানের সংস্কার বর্তমান। মা শীতলা সন্তুষ্ট
হলে বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাবে এই সংস্কারে জেলার মানুষ বিশ্বাস করেন। এই
শতসহস্র বছরের সংস্কারের পিছনে কারণ হিসাবে বিজ্ঞান বলে শীতলার বাহন গাধা আর গাধার
দুধ যদি কেউ জীবনে একবার পান করেন তাহলে বসন্তের জীবাণু তাঁকে আক্রমণ করতে পারে
না। আমাদের প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে আমরা কোন সংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কুসংস্কারের
তকমা দিতে পারি,
তবে তা সবসময় ফেলনা নাও
হতে পারে। জেলার রাজবংশী বা মালোদের মধ্যে মনসার ভাসান প্রচলিত আছে। এই সংস্কারে
জানা যায় শীতলা জাগরণ বা মনসার ভাসানে পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই, প্রয়োজনে মেয়েরা পুরুষের ন্যায় সাজেন। দক্ষিণ
২৪ পরগণার মানুষদের মধ্যে পৌণ্ড্র সমাজে ভাদ্রমাসের শেষে রান্নাপূজার চল আছে।
মনসার পূজার কারণে সারারাত্র জুড়ে রান্না করে পরেরদিন অরন্ধন ব্রত। বিশেষ বিশেষ
কারণ অবলম্বন করে কোথাও কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, কোথাও মনসা, কোথাও বনবিবি, কোথাও আবার গঙ্গাপূজার সংস্কার আছে। জেলে
সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্মীপূজা ও গঙ্গাপূজার চল দেখা যায়। মৎস্যজীবিরা যখন গভীর
সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, তখন
তাঁরা গঙ্গা ও বনবিবির পূজা দিয়ে তবে যান। সেইসময় সুন্দরবনের জেলেদের স্ত্রীগণ
নিজেদের হাতের শাঁখা ও সিঁদুর খুলে মায়ের মন্দিরে ততদিন পর্যন্ত বন্ধক রাখেন যতদিন
না তাঁর স্বামী গৃহে ফিরছেন। মাছের সিজনে যখন নৌকা বা লঞ্চ নিয়ে সমুদ্রে যান, তাঁর আগে নৌকা পূজা হয়। নৌকার মাথায় সিঁদুর ও
ফুলের মালা দেওয়া হয়। যাত্রীদের এই স্থানে পা দেওয়ার বিধান নেই।
পৌষমাসের শেষে আসে পৌষসংক্রান্তি। নবান্নের
অনুষ্ঠান খুব একটা না দেখা গেলেও বাড়িতে বাড়িতে পিঠেপুলির আয়োজনের অভাব নেই। জেলার
মানুষের সংস্কার আছে যে এই সময় তার এলাকা থেকে নিকটজন কেউ যদি গঙ্গাসাগর গমন করে
থাকে তাহলে সেই বছর আর নিয়ম মেনে পিঠেপার্বণ করা যাবে না। গঙ্গাসাগর যাত্রী বাড়িতে
নির্বিঘ্নে ফিরলে তারপরে সেই সংস্কার পালন করা হয়। পিঠে তৈরির পর প্রথম পিঠে গরু, বাড়ির ছাদে এবং পুকুরে জলদেবতাকে উৎসর্গ করার
নিয়ম দেখা যায়। যাইহোক, এই পিঠেপুলির সাথে জড়িয়ে আছে ঢেঁকি সংস্কৃতি। ঢেঁকিতে
চালগুঁড়ো করা আর ছড়া কেটে গান করার সংস্কৃতি পূর্বে লক্ষ্য করা গেলেও প্রযুক্তির
তৎপরতায় তা আজ আর দেখা যায় না।
সুন্দরবনের সংস্কৃতিতে কোন পরিবারের কেউ মারা
গেলে পূর্বে মৃত ব্যক্তির পরিবারে ৩০ দিনের অশৌচ পালনের চল থাকলেও তা এখন বারো
দিনে পরিবর্তিত হয়েছে। সংস্কার, নিয়ম, বিধান ইত্যাদি সংস্কৃতিতে পরিণত করেন মানুষ মানুষের
স্বার্থে। তেমন কোন সংস্কৃতি সময়, কাল ও পাত্রবিভেদে তার অস্তিত্ব নির্ভর করে। তেম্নভাবে আমরা
ধরেই নিতে পারি যে আগামিদিনে হয়তো এই অশৌচকর্ম তিনদিন বা মৃতের পারলৌকিক কাজের
দিনেই শেষ হয়ে যাবে। অন্য জেলার চিত্র কেমন সেটা জানি না, তবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার রীতি ছিল এবং আজও অনেক
জায়গায় বিদ্যমান আছে যে বাড়িতে কোন অতিথি বা আত্মীয় এলে বাড়িতে যতই জলের সম্ভার
থাকুক না কেন অতিথির থেকে ছোট কেউ ঘটি বা জগে করে পুকুর ঘাট থেকে জল এনে সেই
অতিথির পাদপ্রক্ষালন করে নতুন গামছা দিয়ে মার্জন করেন। সময়ের সাথে সাথে এমন অনেক
সংস্কৃতি হয়তো বিলুপ্ত হতে চলেছে, কিন্তু এসবের মধ্যে দিয়ে প্রাচীন সনাতনী শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে
অতিথি সেবার চল প্রকাশ্য। বিশেষ করে বাড়িতে ব্রাহ্মণ বা গুরুদেব এলে এই সংস্কার
নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রতি মাসের পূর্ণিমা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে
অনেকের বাড়িতে কিংবা নিকটবর্তী দেউলে সত্যনারায়ণের শিন্নী বিতরণের মধ্য দিয়ে
গৃহমঙ্গল কামনা করার রীতি প্রচলন আছে। সেইসূত্রে দক্ষিণবঙ্গের একটু সমৃদ্ধশালী
পরিবারে নিজস্ব মন্দির পরিলক্ষিত হয়। জেলায় ভক্তির সাধকের তুলনায় শক্তির উপাসক
তুলনায় কম। জেলা জুড়ে বছরের বিভিন্ন সময় অসংখ্য হরিবাসর ও নামকীর্তন হয় যে বঙ্গের
অন্যান্য জেলাকে পিছিয়ে প্রথম সারিতে অবস্থান করে। হরিবাসরে মহাপ্রভুর ভোগ হিসাবে
মালসাভোগের বিরাট আয়োজন জেলার সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। তবে এই হরিবাসর একটু
শিক্ষিত,
ব্রাহ্মণ, কলকাতার নিকটস্থ অঞ্চলে কম দেখা যায়।
ব্রাহ্মণদের মধ্যে শক্তির পূজা করতে দেখা যায় বেশী। যদিও ব্যতিক্রম দেখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে জেলা থেকে ব্রাহ্মণ বাড়ি থেকে
কীর্তনিয়া পাওয়া যায়। বর্তমানে জেলাজুড়ে শনিবারে বাবা শনিঠাকুর বা বড় ঠাকুরের পূজা
চলে। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে এই দেবের কৃপা পাওয়া গেলে অভাব মোচন হবে। এছাড়াও
জেলাজুড়ে রামায়ণ, কবিগান, তরজাগান, যাত্রা, পুতুলনাচ, গাজন মেলা অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমানে গাজন মেলা
ছাড়া তেমন কিছুর অস্তিত্ব বৃহত্তরক্ষেত্রে দেখা মেলে না। বাড়ির নবজাতকের
মঙ্গলকামনায় তার চূড়াকরণের সময় বাবা বড়কাছাড়ির মন্দির, ষষ্ঠী, পেঁচাপেঁচির মন্দিরে গিয়ে মানত করা, গণ্ডি কাটা, ধুনো পোড়ানো, হরিলুট বা ছলন (ঠাকুরের মূর্তি) প্রদান করার
চল বর্তমান।
শিকড়ের
সন্ধানেঃ
এবার আসি বাস্তবের
মাটিতে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনের মাটিতে কান রেখে তুলে আনা লোককথা। একেবারেই
ক্ষেত্রসমীক্ষার অংশবিশেষ হিসাবে পাঠকের সামনে কয়েকটি কাহিনীর সাথে লোকাচার ও
স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসের বুনন ধরা আছে।
(এক)
দেশের প্রান্তিক
মানুষের মাঝে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন তাঁদের জীবনচর্চা আমাদের সভ্যজগতের থেকে একটু
পৃথক ক্ষেত্রবিশেষে। দেশে দেশে কালে কালে প্রতিটা জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের নিয়ম, শৃঙ্খলা, সংস্কার
বা কানুন ও বিধান বর্তমান ছিল, আজও আছে। বিজ্ঞানের
উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষার আলো প্রসারের মাঝে বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে হাজার
বছরের পুরানো সংস্কৃতিকে এক লহমায় অপসংস্কৃতি বলে দিতে পিছপা হয় না, প্রাচীন
যুগ থেকে বয়ে আনা সংস্কারকে এক কথায় কুসংস্কার বলে স্বঘোষিত বিজ্ঞানী বলে গর্বে
মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ানো যায় কিন্তু এভাবে সবকিছু অস্বীকার করা যায় না।
ভণ্ডামি ব্যতিরেকে সংস্কার অনেক রয়েছে যার পিছনে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের
জনগোষ্ঠীর সমসাময়িক কালের লুক্কায়িত বিজ্ঞান। আমাদের দুর্বলতা হল আমাদের শিক্ষা
দিয়ে সেই বিজ্ঞান উদ্ধার করতে পারি না। আমি মনে করি বিজ্ঞান হল বিশেষ রূপে জ্ঞান
অর্জন করা। অর্থাৎ, যা কিছু নতুন করে জানছি আমরা তা
নতুন আবিষ্কার বলে ধরে নিলেও তার অস্তিত্ব যে ইতোপূর্বে ছিল না তা নয়, তা
ছিল প্রকৃতির নিয়মে। মানুষের কাণ্ডজ্ঞান সেই পড়ে থাকা বিজ্ঞানের অর্থ তখনও তুলে
আনতে পারে নি। তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ যা উদ্ধার করতে
পারবে না, তাই অপবিজ্ঞান বা কুসংস্কার বলে
পরিগণিত হবে। বরং কালের নিয়মে বারবার প্রমাণিত হয়েছে এসকল প্রাকৃতিক নিয়মকে
মানুষ অস্বীকার করার কুফল নেমে এসেছে মানুষের উপর। মানুষ বিজ্ঞানের কায়দা কানুন
দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেও প্রকৃতির সেই প্রলয়নাচনের কাছে নিজেকে সঁপে
দিতে বাধ্য হয়। বর্তমান প্রবন্ধ সেই সংস্কারের পিছনে লুকিয়ে থাকা শত শত বছরের
বিজ্ঞান চেতনার কয়েকটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। আমরা রাস্তায় বেরোলে
প্রতিনিয়ত একটা জিনিস সবাই কমবেশী দেখি যে বিড়াল যদি আমাদের সামনে বা গাড়ীর
সামনে দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে আমাদের কিছুক্ষন থামতে হয়। এটাকে আমরা ছোটবেলা
থেকে দেখে এসেছি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের
কাজের ধারা ও সময়ের মূল্য বাড়তে থাকায় এখন সেইসকল নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে
কুসংস্কার বলে এগিয়ে চলেছি। এখানেই পরিবেশ তথা প্রকৃতির বিধানের সাথে
সমাজবিজ্ঞানের মেলবন্ধন বিদ্যমান। লুক্কায়িত বিজ্ঞান বলে যে যখন বিড়াল বা ঐ
জাতীয় প্রাণী কোন গলি বা ঝোপঝাড় থেকে বেড়িয়ে রাস্তা অতিক্রম করে তার পিছনে আরও
বিড়াল বা তাদের ছোট ছোট বাচ্চা থাকতে পারে। তাই একটু থামুন, দেখুন
তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলুন। তাতে করে কোন প্রাণী মারা পড়বে না। এই নিয়ম শুধু
আমাদের দেশে নয়, পরিবেশপ্রেমী অধ্যাপক ড. মলয় মুখোপাধ্যায়ের
মতে, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জঙ্গলের
মধ্যে যে হাইওয়ে আছে তার পাশে রীতিমত প্রজ্ঞাপন দেওয়া থাকে। এটা একটা
নির্দেশমূলক সতর্কতা। সকল প্রাণীর সাথে উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ নামক প্রাণীর এক
পারস্পরিক সহাবস্থান। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে নিজের
বাঁচা বা দৌড় বজায় রাখতে অন্যকে শেষ করতেও পিছপা হয় না। তাই একে কুসংস্কার বলে
দেয় অবলীলাক্রমে।
(দুই)
সুন্দরবনের মানুষের
সাথে কথা বলে জানা গেল আবার এক নতুন সংস্কার। সাধারণত হিন্দু রমণী বিবাহের পর থেকে
হাতে শাঁখা আর সিথিতে সিঁদুর রাখে স্বামীর মঙ্গল কামনায়। এই শাঁখা সিঁদুরের
পিছনের তাৎপর্য অন্য কোনসময় আলোচনা করা যাবে। যদিও, বর্তমানে
আধুনিক শিক্ষিতা রমণীকুলের অনেকেই একে কুসংস্কার বলে মনে করে বিয়ের ঠিক পরে পরেই
এসব ত্যাগ করে। যাইহোক, এসব মান্য করা না করা
সবই ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশতে
মিশতে একদিন দেখা গেল বনবিবির মন্দিরে গুচ্ছ গুচ্ছ শাঁখা পলা ঝুলছে।
ক্ষেত্রসমীক্ষার মাঝে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞাসা করতে তিনিই জানালেন যে
যখন বাড়ির পুরুষ মানুষ গভীর জঙ্গলে কাঠ ভাঙ্গতে, মধু
আনতে কিংবা অনেকদিনের জন্য মাছ ধরতে যায়, তখন
সেই লােকের স্ত্রী শাঁখা সিদুর দেবীর কাছে বন্দক রাখেন। তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস যে
মায়ের কাছে তাঁদের স্বামীর জীবন জমা রইল। তিনি যদি প্রাণে বাঁচান তাহলে আবার শাঁখা
সিঁদুর অঙ্গে তুলবেন, নইলে বৈধব্য জীবন কাটাতে হবে। এটা
শুনে অনেকের মনে হবে এই সংস্কারের পিছনে বিজ্ঞান কোথায়? বিজ্ঞান
বলতে এখানেই লুকিয়ে আছে হাজার বছরের সমাজ বিজ্ঞানের সামাজিক বিধান। যুক্তিবাদী
সমাজপতিদের কথায় যখন কোন নারীর স্বামী জঙ্গলে যায়, তখন
তাঁর মনে এত সুখ থাকে না যে এয়োস্ত্রী সেজে ঘুরে বেড়াবেন বা আনন্দ করবেন। যখন
তাঁর কাছে শাঁখা সিঁদুর থাকে না, তখন তাঁর
প্রতিমুহূর্ত স্বামীর অনুপস্থিতি অনুভব হয়। তাই সে সমাজের বিধানকে অস্বীকার করে
কোনরূপ অপ্রীতিকর বা অসামাজিক কাজে যুক্ত হন না। তাঁরা এক নিয়মনিষ্ঠার মধ্যে
দিয়ে দিন গুজরান করেন। সেসময় তাঁদের দর্শন অনেকটাই বিধবাদের মত হয় বলে যুবসমাজ
তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট কম হন, বলা ভালো তাঁর সাথে
বজ্জাতি করতে গেলে তাঁদের মনেও বনবিবির রক্তচক্ষু ভেসে ওঠে। ফলে তাঁকে কেউ বিরক্ত
করতে পারেন না। স্বামী ফিরে আসা পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে একা রমণী নিশ্চিন্তে জীবন
কাটান। যদিও এখন নৈতিকবোধ বিসর্জন দিয়ে অনেকেই নিজের সুখ চরিতার্থে অনেক কিছুই
জলাঞ্জলি দেন।
(তিন)
সুন্দরবনের এমন একটি
সন্ধ্যায় গল্পের আসর বসেছে। উপস্থিত আছেন আমাদের থেকে বিভিন্ন সহায়তা পান এমন
কিছু বাড়ির বয়স্ক ভদ্রলোক। সেখানে গল্প সূত্র জানা গেল যে, একটা
নিয়ম আছে যে যখন আমাদের এই সুন্দরবনের ছেলেরা মধু ভাঙ্গতে জঙ্গলে যান, তখন
বাড়ির মেয়েদের বিশেষ করে মৌলে মানে যারা মধু ভাঙ্গতে যান তাঁদের স্ত্রীদের দিনে
রাত্রে শোবার ঘরের দরজা যদি খুলে রাখেন তাহলে মধু বেশী পাওয়া যাবে। আর যদি কেউ
দরজা বন্ধ করে কোন কারণে তাহলে মধু প্রাপ্তি তো দূরের কথা, বনবিবির
কোপে তাঁর অকাল বৈধব্য ঘটে যেতে পারে। এটাই হল প্রান্তিক সুন্দরবনের সংস্কারগুলির
মধ্যে অন্যতম একটি। কিন্তু যুক্তিবাদী সংস্থা প্রমাদ গুনলেন। পরেরদিন সকালে উঠে এক
মৌলের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে তিনি এই জনজাতির হাজার
বছরের লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞান সভ্যসমাজের কাছে উন্মোচন করে দিলেন। আপনি বিশ্বাস
করবেন কি না করবেন আপনার ব্যাপার। তাঁর কথায়, আমরা
যখন জীবনের আশা ছেড়ে গভীর জঙ্গলে দিনের পর দিন উপার্জনের তাগিদে পড়ে থাকি, তখন
ভয়ে, ক্লান্তিতে বা মানসিক অবসাদে
সবথেকে বেশী মনে পড়ে প্রিয়জনের মুখ। সুন্দরবনে একটা সময় অনেক বিরল বসতি লক্ষ্য
করা যেত। ফলে এই বিধানের কারণে যদি বাড়ির মেয়েরা ঘরের দরজা খুলে রাখতেন তাহলে
কোনরূপ ব্যাভিচারে লিপ্ত হতে গেলে প্রতিবেশী বুঝতে পারবেন ভেবে কেউ এই অপবিত্র
কর্মে লিপ্ত হন না। যাইহোক, এই দরজা খুলে রাখলে
আমাদের মধু কত বেশী প্রাপ্তি হয় জানা নেই, তবে
আমরা নিশ্চিন্তে থাকি যে আমাদের বাড়ির মেয়েরা কোন ব্যাভিচারে লিপ্ত হচ্ছেন না।
সেখানেই আমাদের শান্তি। তাই অনেকটা নিশ্চিন্তে আমরা জঙ্গলে খেয়াল রেখে মধু আহরণ
করতে পারি। ফলে বেশী বেশী করে মধু সংগ্রহ করতে পারি। এখন এই হারিয়ে যাওয়া
জনজাতির অবহেলায় পড়ে থাকা বিজ্ঞানের তাৎপর্য বর্তমান বিজ্ঞানের পূজারীদের কাছে
কুসংস্কার বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে তাঁদের সামাজিক
নিয়ম কানুন বা ধর্মীয় বিধান দিয়ে তাঁদের সমাজ এত বছর ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
সভ্য সমাজ তাঁদেরকে অসভ্য বলে মনে করতেই পারে, কিন্তু
তাঁদের সভ্যতায় আধুনিক বিজ্ঞানের সরঞ্জাম বা চিকিৎসা না থাকলেও তাঁদের মত করে
তাঁরা বাঁচতেন। অনেক সময় আমাদের সভ্যদুনিয়ার কোন মানুষ সেখানে গিয়ে সমস্যায়
পড়লে সেই সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি দেখলে বর্তমান বিজ্ঞান হোঁচট খেতে পারে। আমরা
নিশ্চয়ই বিজ্ঞান মানবো, ধর্মীয় অনুশাসনে
আটকে থাকা ভণ্ডামি সরিয়ে দেব। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সবকিছু তুড়ি মেরে
উড়িয়ে দেব। আর এটা করছি বলেই আমরা নিজেরাই নিজেদের উপর নামিয়ে আনছি মহামারী, প্রাকৃতিক
বিপর্যয়। সেখানেও ব্যাখ্যা অন্যমাত্রায় নিয়ে যাবে আপনাকে। একটা কথা মাথায়
রাখবেন কোন কিছু নস্যাৎ করতে গেলে আপনাকে সেটা আত্মস্থ করতে হবে প্রথমে। নইলে তার
অস্তিত্ব নিয়ে ব্যাখ্যা করা সমালোচনার নামান্তর মাত্র।
শেষ কথনঃ
শত সহস্র বছর ধরে চলে
আসা কোন জনজাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কার বা ধারা সেই জনজাতির সংস্কৃতিতে পরিগণিত হয়। লোকসংস্কৃতি
এমন একটা সত্ত্বা যা স্থান কাল ভেদে পৃথক হয়ে থাকে। কোন এক কালে যে সংস্কৃতি মানুষের
মননে চিন্তনে জায়গা করে নিয়েছিল সেটা আজকের পাশ্চাত্য প্রভাবে বিলুপ্তপ্রায়, আবার যা
কোনকালেই গ্রহণযোগ্য ছিল না তা আধুনিকতার ছোঁয়ায় সময়ের সাথে সাথে গৃহীত হয়েছে। তবে
প্রত্যেক জনজাতির একটা নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেখানেই সেই জাতির মৌলিকতা। সাধারণত
জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাথে সাথে সংস্কৃতির ঘরানার পরিবর্তন ঘটলেও পরিবারের বয়স্কদের
মধ্যে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম
সংস্কৃতির ধারকবাহক হিসাবে রুচি আর পছন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই
লোকাচার বা লোকসংস্কৃতি দেশ ও কালের নিরিখে ছিল, আছে ও থাকবে। শুধু রুচি আর যুক্তিতে
তার ধরণ বদলাবে। আমরা লোকসংস্কৃতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে যেন নিজের রুচিকে প্রতিষ্ঠা
করতে গিয়ে সবকিছু সমূলে উৎপাটিত করে না ফেলি সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ সুন্দরবনের
মানুষের এই লোকাচার বা লোকবিশ্বাস ছিল বলেই হয়তো আজকের সুন্দরবনের যেটুকু আমরা দেখতে
পাই, সেই কারনেই পাই। প্রকৃতির পূজা করতে করতে কখন যে তাঁরা প্রকৃতির সন্তান হয়ে গেছে
তা আমরা সভ্যতার নিয়ন আলোর তলায় বসে অনুধাবন করতে পারিনি। হয়তো সেই অনুভূতি আমাদের
নেই।
গ্রন্থসূত্রঃ
ü গুড়িয়া, মহাদেব (২০১৩), দক্ষিণ চব্বিশ
পরগণা সমগ্র, পাণ্ডুলিপি, কলকাতা
ü ঘোষ, সঞ্জয় (২০১২),
সুন্দরবনের পূর্বপুরুষ পূজা (আদিবাসী সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি), সুচেতনা, কলকাতা
ü ঘোষাল, ইন্দ্রাণী (২০০৬), সুন্দরবনের
মৎস্যজীবিদের জীবন, তাঁদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্য, গ্রথন, কলকাতা
ü দাস, গোকুল চন্দ্র (২০০৯), দক্ষিণ ২৪
পরগণার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা
ü দাস, নির্মলেন্দু (২০১৮), সুন্দরবনের
লোকসংস্কৃতি, স্বস্তিক প্রকাশন, কলকাতা
ü নস্কর, দেবব্রত (২০১৮), সুন্দরবন সভ্যতা
ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
ü নস্কর, দেবব্রত (১৯৯৯), চব্বিশ পরগণার
লৌকিক দেবদেবীঃ পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
ü নস্কর, ধূর্জটি (২০০০), দক্ষিণ ২৪
পরগণার গাজন ও গাজন মেলা, আশুরালি গ্রাম উন্নয়ন পরিষৎ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা
ü পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর
(২০১৯), প্রসঙ্গ
সুন্দরবন (১ম খণ্ড), ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা
ü পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর
(২০২০), প্রসঙ্গ
সুন্দরবন (২য় খণ্ড),
ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা
ü পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর
(২০২১), প্রসঙ্গ সুন্দরবন
(৩য় খণ্ড),
ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা
ü পুরকাইত, সনৎকুমার (২০২১), জেলা
সংস্কৃতিঃ দক্ষিণ ২৪ পরগণা, অপ্রকাশিত
ü বিশ্বাস, মন্টু (২০১২), সুন্দরবনের লোককথা,
অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা
ü বসু, গোপেন্দ্র কৃষ্ণ (২০১৮), বাংলার
লৌকিক দেবতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
ü মণ্ডল, অনুকূল (২০১৪), সুন্দরবনের ঐতিহ্য
ও সংস্কৃতি, দি সি বুক এজেন্সী, কলকাতা
ü মণ্ডল, কৃষ্ণকালী (২০০১),
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেবদেবী ও মূর্তিভাবনা, নব চলন্তিকা, কলকাতা
ü মণ্ডল, কৃষ্ণকালী (২০১০),
সুন্দরবনের সংস্কৃতি ও প্রত্নভাবনা, নব চলন্তিকা, কলকাতা
ü মিস্ত্রী, সুভাষ (২০১৮), লোকায়ত
সুন্দরবন (১, ২ ও ৩য় খণ্ড), দিয়া পাবলিকেশন, কলকাতা
ü রায়চৌধুরী, প্রসিত (২০২০), আদিগঙ্গার
তীরে, বর্ণব্যঞ্জন, কলকাতা
ü রায়চৌধুরী, শক্তি ও পুরকাইত, মনোরঞ্জন
(২০১৪), বারুইপুরের ইতিহাস, বারুইপুর পৌরসভা, বারুইপুর, কলকাতা
ü সরকার, প্রণব (২০১৮), বাংলার লোকসমাজঃ
ইতিহাস ও সংস্কৃতি, লোক, কলকাতা
ü সিং, সুকুমার (১৯৯৬), দক্ষিণ ২৪ পরগণার
ইতিহাস, মাস এন্টারটেইনমেন্ট প্রাঃ লিঃ, কলকাতা
ü সুর, সুরজিত (২০১৪), মাটিতে পা রেখে,
পাঠশালা প্রোডাকশন, হাওড়া
ü হালদার, বিমলেন্দু (২০১১), দক্ষিণ
চব্বিশ পরগণার যাত্রাগানঃ ইতিহাস ও আলোচনা, প্রিয়নাথ প্রকাশনী, কলকাতা
ü হালদার, বিমলেন্দু (২০১৯), দক্ষিণ
চব্বিশ পরগণার কথ্যভাষা ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), প্রিয়নাথ
প্রকাশনী, কলকাতা
ü হালদার, বিমলেন্দু (২০১৯), দক্ষিণ বঙ্গ
জনসংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাস বিচিত্রা, প্রিয়নাথ প্রকাশনী, কলকাতা