Saturday 4 November 2023

জগতের ধর্মগুরু লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র

 লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র


 

গল্পের নায়ক যেখানে কৃষ্ণ সেখানে বলে রাখা ভালো আধ্যাত্মিক নয়ন না থাকলেও যদি কেউ তাঁর বিবেক ও দর্শন দিয়ে তাঁর চেতনাকে জাগ্রত করতে পারে তবেই এই নায়ক শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করতে পারবেন। তাঁকে জানলে পরে হিন্দু সনাতনধর্ম গ্রহণ না করেও সঠিক জীবনধারায় নিজেকে মেলে ধরা যাবে। ‘কৃষ্ণঃ’ – এই নামের ‘ক’ হল ব্রহ্মবাচক, ‘ঋ’ কার হল অনন্তবাচক, ‘ষ’ কারে শিববাচক, ‘ণ’ কারে ধর্মবাচক এবং ‘অ’ কারে শ্বেতদ্বীপনিবাসী বিষ্ণু বোঝায় ও বিসর্গে নরনারায়ণ বোঝায়। ইনি সকল তেজের রাশি সর্বমূর্তিস্বরূপ, সর্বাধার ও সকল বীজস্বরূপ। তাই তো তিনি কৃষ্ণ। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন বিচক্ষন রাজনীতিবিদ্‌, প্রেমিক পুরুষ, দায়িত্ব ও কর্তব্যে নিষ্ঠাবান। তিনি অনেক গুণের অধিকারী। তাঁকে জানতে গেলে আপনাকে কর্ষণ করতে হবে জ্ঞানকে। সমালোচনা বা মূল্যায়ন করতে গেলে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে হয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানতে হয় নিবিড়ভাবে। আজকের বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ শ্রীকৃষ্ণকে কাল্পনিক পুরুষ বলে মনে করেন। অনেকেই তাঁর দর্শনকে না জেনেই পরিত্যাগ করেছেন। এটা সেই মানবজাতির মুর্খামি ছাড়া আর কিছুই না। আজকের দিনে আধুনিক সভ্যতার মানুষ হয়েও শ্রীকৃষ্ণতত্ত্ব সমানভাবে সমাদৃত। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের ঠিকুজী কুষ্ঠী বিচার না করেই বলা যেতে পারে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে যে ধ্যান ধারণার জন্ম দিয়ে তিনি সারা বিশ্বের চেতনায় এক অলৌকিক জায়গা করে নিয়ে আজও স্বমহিমায় ভাস্বর তা কিন্তু ভাববার বিষয়। তাই তাঁকে নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার পূর্বে তাঁকে অনুভব করার মতো শক্তি, ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, চেতনা আর নির্মল চিত্ত প্রয়োজন।

হিন্দুধর্মে চার যুগ অর্থাৎ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগের কথা বলা হয় আর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হলেন এই দ্বাপরের অবতার। এই দ্বাপর যুগে তিনি আসেন লীলাবিলাসী বৃন্দাবনচন্দ্র ভগবান পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হয়ে। জন্মগ্রহণ করেন অত্যাচারী কংসের কারাগারে, সম্পর্কে মামা হলেও জন্ম থেকে শত্রু থাকায় জন্মের পর মুহূর্তেই জন্মদাতা বসুদেব ও মা দেবকী থেকে দূরে সরে যেতে হয় তাঁকে। আবার শিশুকাল থেকে পূতনা, বকাসুরসহ একগুচ্ছ অশুভশক্তিকে দমন করতে হয় সে কথা পাঠকের জানা। তাঁর কালীয়দমন বা গিরিগোবর্ধন পর্বত ধারণের মধ্যে যে মাহাত্ম্য তা ছেড়ে যারা তাঁর সখীসনে লীলা নিয়ে ব্যঙ্গ করেন, তাঁদের জেনে রাখা উচিত কৃষ্ণের যতেক খেলা সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু তাঁহার প্রকাশ। তিনি শিশুকাল থেকে অপ্রকট হবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জীবশিক্ষা দেবার জন্য বিভিন্ন লীলা করেছেন। কিন্তু মূর্খের দল তাঁর অর্থ না জেনে ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন। তাঁর বৃন্দাবনলীলা, মথুরালীলা আর দ্বারকাশাসনের মধ্যে শ্রীমতী রাধিকা বা গোপীলীলা করেন বৃন্দাবন ও মথুরায় যেটা তাঁর শৈশবকালের ঘটনা। যখন দেহে মনে কামের বাসনা জাগ্রত হয় না, সেসময় তাঁর এই লীলার মধ্যে জ্ঞানান্ধ জীব কামের খোঁজ করেন। তিনি বৃন্দাবন ত্যাগ করেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। তারপর থেকে তিনি ১২৫ বছর বেঁচে থাকলেও তিনি আর বৃন্দাবনে প্রত্যাবর্তন করেন নি অর্থাৎ তাঁর রাধারানী বা গোপীদর্শন পূর্ণ যৌবনের ঘটনা একেবারেই নয়।

তাছাড়া তিনি কামনা, বাসনার উর্ধে উঠে তিনি হয়েছেন পুরুষোত্তম। কাম কে জয় করে হয়েছেন মদনমোহন। তাঁর অগণিত গুণাবলীর জন্য রমণীগণ তাঁর সাথে মিলতে চাইত। বিশ্বপ্রপঞ্চের সকল প্রকৃতি সেই পুরুষের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণের সন্ধান করে আসছেন আজ পাঁচ হাজার বছর ধরে। অদ্ভুত এক সন্মোহিনী ক্ষমতা তাঁর মাঝে বিরাজমান। তাই তো তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর ৬৪ গুণ বর্তমান ছিল যা আর কোন দেবতা বা কোন অবতারের মধ্যে পাওয়া যায় নি, যথা- (১) তাঁর সমস্ত শরীর অপূর্ব মাধুর্য মণ্ডিত (২) সমস্ত শুভ লক্ষন যুক্ত (৩) অত্যন্ত মনোরম (৪)জ্যোতির্ময় (৫)বলবান। (৬) নিত্য নব-যৌবন সম্পন্ন (৭) সমস্ত-ভাষায় পারদর্শী (৮) সত্যবাদি (৯) প্রিয়ভাষী (১০) বাকপটু (১১) পরম পণ্ডিত (১২) পরম বুদ্ধিমান (১৩) অপূর্ব প্রতিভাশালী (১৪) বিদগ্ধ শিল্পকলায় পারদর্শী (১৫)অত্যন্ত চতুর (১৬) পরম দক্ষ (১৭) কৃতজ্ঞ (১৮) দৃঢ় প্রতিজ্ঞ (১৯) স্থান ,কাল ও পাত্র বিচারে সুদক্ষ (২০) বৈদিক তত্ত্বজ্ঞানে পারদর্শী (২১) পবিত্র (২২) সংযত (২৩) অবিচলিত (২৪) জিতেন্দ্রিয় (২৫) ক্ষমাশীল (২৬) গম্ভীর (২৭) আত্ম-তৃপ্ত (২৮) সমদৃষ্টি সম্পন্ন (২৯) উদার (৩০) ধার্মিক (৩১) বীর (৩২) কৃপাময় (৩৩ )শ্রদ্ধাবান (৩৪) বিনীত (৩৫) বদান্য (৩৬) লজ্জাশীল (৩৭) শরণাগত জীব-এর রক্ষক (৩৮) সুখী (৩৯) ভক্তদের হিতৈষী (৪০) প্রেমের বশীভূত (৪১) সর্বমঙ্গলময় (৪২) সর্বশক্তিমান (৪৩) পরম যশস্বী (৪৪) ভক্তবৎসল (৪৫) সমস্ত স্ত্রী জনের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় (৪৬) সকলের আরাধ্য (৪৭) জনপ্রিয় (৪৮)সমস্ত ঐশ্বর্য-এর অধিকারী (৪৯) সকলের মাননীয় (৫০) পরম নিয়ন্তা। উল্লেখিত ৫০ টি গুন ছাড়া ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরও ৫ টি অতিরিক্ত গুন আছে যা কিছুটা ব্রহ্মা ও শিবেরও আছে ৫১) অপরিবর্তনশীল ৫২) সর্বজ্ঞ ৫৩) চির নবীন ৫৪) সৎ, চিৎ ও আনন্দময় ৫৫) সব রকম যোগ সিদ্ধির অধিকারী। শ্রীকৃষ্ণের আরও ৫ টি গুন আছে যা নারায়ণ বিগ্রহে প্রকাশিত হয়ঃ- ৫৬) অচিন্ত্য শক্তিসম্পন্ন ৫৭) তার দেহে অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের প্রকাশ ৫৮) তিনি সমস্ত অবতারের আদি উৎস ৫৯) তাঁর দ্বারা হত শত্রুদের তিনি মুক্তিদান করেন ৬০) মুক্ত আত্মাদের তিনি আকর্ষন করেন। এই গুন গুলি ছাড়া কৃষ্ণের আরও ৪ টি গুণ আছে যা আর কারো নেই এমন কি নারায়ণেরও নেই সেই গুন গুলি হল :- ৬১) লীলা মাধুর্য্য, ৬২) প্রেম মাধুর্য্য ৬৩) বেনু মাধুর্য্য ৬৪) রুপ মাধুর্য্য।

উপরের ৬৪ গুণের মধ্যে ৫০ গুনাধিপতি নর, ৫৫ গুণের অধিকারী হলে দেবতা আর ৬০ গুণের অধিকারী কেবলমাত্র স্বতন্ত্র দেবতাগণ। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ হলেন ৬৪ গুণের অধিকারী পূর্ণসত্ত্বা। তাঁর গুণের অন্ত নেই। তিনি অনাদি অনন্ত। যে গুণের অধিকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তা ৩৩ কোটি দেবতার নেই। এই ৩৩ কোটি নিয়ে আমাদের নানান মতান্তর ঘটলেও এখানে কোটি শব্দের অর্থ প্রকার, এই কোটি সংখ্যাবাচক নয়। অর্থাৎ ৩৩ প্রকার দেবদেবী বর্তমান তা হল ১২ প্রকার হল আদিত্য-ধাতা, মিত, আযমা, শুক্রা, বরুন, অংশ, ভাগ, বিবস্বান, পুষ, সবিত্রা, তবাস্থা এবং বিষ্ণু। ৮ প্রকার হল বসু- ধর, ধ্রুব, সোম, অহ, অনিল, অনল, প্রত্যুষ এবং প্রভাষ। ১১ প্রকার হল রুদ্র- হর, বহুরুপ, ত্রয়ম্বক, অপরাজিতা, বৃষাকাপি, শমভু, কপার্দী, রেবাত, মৃগব্যাধ, শর্বা এবং কপালী। ২ প্রকার হল অশ্বিনী এবং কুমার। মোট ১২+৮+১১+২=৩৩ এবার দাঁড়ালো ৩৩ কোটি দেবদেবী। এর মধ্যে স্বতন্ত্র দেবতা হলেন পাঁচজন অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ পাঁচজন দেবতা হলেন গণেশ, রমেশ, উমেশ, দীনেশ আর তারা। তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কারণ শেষের যে চারটি গুণ তা সবগুলো মাধুর্যমণ্ডিত। সেটা আর কারুর মাঝে পাওয়া যায় না। ব্রহ্মসংহিতা মতে “ঈশ্বর পরম কৃষ্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ অনাদির আদি গোবিন্দ সর্বকারণ কারণাম্”। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন পরম ঈশ্বর, সর্বকরণে মূল কারণ। চৈতন্যচরিতামৃতে বলা আছে- একলা ঈশ্বর কৃষ্ণ আর সব ভৃত্য। আবার ভাগবতম্ এ বলা আছে- এতেচাংশ কলাপুংস কৃষ্ণেস্তু ভগবান স্বয়ম্। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছে ভগবান। ব্যাসদেবের পিতা পরাশরমুনি ভগবানের সংজ্ঞায় বলেছেন- ষড়ৈশ্বর্য পূর্ণ বাণ, তাঁকেই বলে ভগবান অর্থাৎ সমগ্র ঐশ্বর্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র সৌন্দর্য, সমগ্র জ্ঞান ও সমগ্র বৈরাগ্য যার মধ্যে বিদ্যমান তিনিই ভগবান। "একমাত্র কৃষ্ণের মাঝেই সব কিছু বিদ্যমান।"

তিনি প্রেমের অবতার হয়ে এসেছেন জীবশিক্ষা দেবার জন্য। তাই সত্যযুগের অবতার নারায়ণের চারহস্তে বিভিন্ন অস্ত্র বা ত্রেতাযুগের অবতার শ্রীরামচন্দ্রের হাতে তীরধনুক থাকলেও তিনি এলেন একেবারে অস্ত্র ত্যাগ করে, নিয়ে এলেন সপ্তসুরের বাঁশি হাতে। তিনি প্রেমের পথের পথিক যেমন হয়েছেন, তেমন অশুভ শক্তিকে দমন করেছেন আবার ধর্মকে রক্ষা করতে কুরুক্ষেত্রের মহারণে ধর্মের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধের কৌশল নির্মাণ করে অধর্মের বিনাশ সাধন করে একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিজ্ঞের পরিচয় দিয়ে গেছেন। তাঁর ক্ষুরধার বিদ্যা ও বুদ্ধির কাছে হার মেনেছিল বীরসেনা ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কুরুপক্ষ। তাঁর দর্শন, তাঁর আদর্শ ও কর্মধারা না বুঝলে তাঁকে চেনা যাবে না। শুধু বাইরে থেকে নারকেল বা বেলের মতো ঠুকরে দেখলে তা কঠিন এবং অসার বলে মনে হতে পারে, কিন্তু যদি ভক্তি ও নৈতিক চেতনা জাগ্রত করে সেই কঠিন খোলক ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করলে যেমন সারবস্তু পাওয়া যায়, তেমন কৃষ্ণতত্ত্ব বুঝতে গেলে ভক্তির ঠোঁট দিয়ে অবিশ্বাসের খোলক ভেদ করে তাঁর দর্শন অনুধাবন করে নিজেকে সেই মার্গে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শাস্ত্র ঘাঁটলে বুঝবেন তথ্য আর তত্ত্ব পৃথক সত্ত্বা বর্তমান। সেখানে দেখতে পাবেন ‘স্বয়ং কৃষ্ণের নাই কোন গোচারণ লীলা, শ্রীমতী রাধিকার নাই কোন বিরহ জ্বালা’। এই রাধারানী কোন রমণী নয়, কোথাও বলা হল শ্রীকৃষ্ণের লীলামাধুর্য পুষ্ট করার জন্য তাঁর বাম অঙ্গ থেকে সৃষ্ট হ্লাদিনী শক্তির প্রকাশ এই রাধারানী। আবার অপর জায়গায় বলা হয় যে ব্রহ্মচর্য রক্ষার মধ্যে দিয়ে নিম্নগামী ধারা যখন উল্টোদিকে প্রবাহিত হয় ঈড়া, পিঙ্গলা ও সুষম্নার মাধ্যমে শ্বাসকে নিয়ন্ত্রন করার মধ্যে দিয়ে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তখন তাঁকে রাধা (ধারার বিপরীত) বলা হয়, সেই রাধা পুরুষও হতে পারেন। গোপী বলতে কোন নারীকে নির্দেশ করা হয় নি, গোপী কথার অর্থ হল গোপনে ভজন করেন যিনি। সেই নিগুঢ় তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে এই পরিসর অত্যন্ত স্বল্প।

কৃষ্ণের লীলাচরিত্র অপব্যাখ্যা করে বর্তমান যুবসমাজ যে তাঁকে অনুসরণ করতে চান, তাঁদেরকে বলি যে কৃষ্ণের অনেক সংহারলীলা ছিল সে বিষয় প্রথমেই অনুসরণ করে দেখান। গিরি ধারণ করতে হবে না, একটা ছোট্ট পাথর দুঘণ্টা আঙ্গুলের মাথায় রাখুন তবে বুঝতে পারবেন যে নরের ৫০ গুণ নিয়ে ৬৪ গুনাধিপতি শ্রীকৃষ্ণের সাথে নিজেকে তুলনা করা কত মূর্খের পরিচয় প্রদান করে। আরও মজার বিষয় হল, উপরোক্ত ৫০ গুণের মধ্যে সব মানুষ আবার ৫০ গুণের অধিকারী হতে পারেন না। তাই মানুষ কুলে জন্ম নিলেও মানুষ বলা যায় না। সাধুগুরু বৈষ্ণবের আশীর্বাদ নিতে গিয়ে বাবা মা বলেন বাবা ওকে আশীর্বাদ করুন যেন আমার ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হয়। এখানেই কৃষ্ণতত্ত্বের মাধুর্য। অহমিকা আর ঐশ্বর্যের আতিশয্যে ভেসে না গিয়ে জ্ঞানকে বিকশিত করে তাঁকে জানা, তাঁর আদর্শ বা নৈতিক জ্ঞানকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে হবে। তিনি জগতপতি হয়ে আছেন হাজার হাজার বছর ধরে। তিনিই পুরুষোত্তম, তিনিই মনীষীশ্রেষ্ঠ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁকে আমার প্রণিপাত।

জগতের ধর্মগুরু ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু

 ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু


চেতো-দর্পণ-মার্জনং ভব-মহা-দাবাগ্নি-নির্বাপণং শ্রেয়ঃ-কৈরব-চংদ্রিকা-বিতরণং বিদ্যা-বধূ-জীবনম্ অর্থাৎ চিত্ত দর্পণ মার্জন করলে এই বিশ্বসংসারের যত কষ্টের আগুন নির্বাপিত হয়ে যায়। আর একটু ভালো করে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে দর্পণ বা আয়নার উপর নোংরা জমা হলে যেমন সেই দর্পণে প্রতিবিম্ব পাওয়া যায় না, যেমন সরোবরের জল পরিষ্কার না থাকলে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে ঝলমল করলেও তা জলে দেখা যায় না, তেমনি আমাদের হৃদয়রূপ সরোবরে অজ্ঞানতার মলিনতা গ্রাস করে রাখলে সেখানে জ্ঞানরূপ সূর্যের প্রতিফলন হয় না। আর চাঁদের আলো প্রতিফলিত না হলে যেমন কচুরিপানা পূর্ণ সরোবরে কেউ স্নান করতে যান না, তেমন জ্ঞানসূর্য না প্রদীপ্তমান হলে সে হৃদয়ে মহত্ত্ব ফুটে ওঠে না, সেখানে কেউ বিরাজও করেন না। এত কথা লেখার একটাই কারণ, বর্তমান প্রজন্ম অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে অনেক সময় অনেক কিছুই অমান্য করেন। যিনি এই শ্লোক লিখে গেছেন তিনি আজ থেকে ৫৩৪ বছর পূর্বে নবদ্বীপের মাটি আলো করে এই বাংলা তথা সারা ভারতের অন্ধকার দূর করতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন প্রেমের শীতল বারিধারা নিয়ে। তিনি সবার প্রেমের ঠাকুর যুগাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু। তাঁর সেই অমিয় প্রেমের বন্যায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিলেন জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তামাম নবদ্বীপের আবালবৃদ্ধবণিতা। তাঁর জন্ম, বংশ পরিচয় ও কর্ম আর সর্বোপরি তাঁর রহস্যময় অন্তর্ধানের কথা আপনারা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে পড়েছেন বা পাবেন। তাই আজকের এই ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনার কেন্দ্রে তাঁর কথা বলব, বলব তাঁর দর্শন, তাঁর ভাব আর তাঁর প্রভাব নিয়ে।

        ২৪ বছরের আজানুলম্বিতভুজৌ কাঁচা সোনার মত শরীর ও পদ্মফুলের মত চোখ, যার দিকে তাকালে নবদ্বীপের নারী পুরুষ কেউ মুখ ফেরাতে পারেন না, সেই প্রেমের ঠাকুর আমাদের মাঝে এসেছিলেন ব্রাহ্মণ পরিবারে। পরিচয় পেয়েছেন শচীনন্দন হিসাবে, জগন্নাথনন্দন হিসাবে নয়। মায়ের স্থান তাঁর দর্শনে যে কত বড় জায়গা নিয়েছিল তা এখানে ভীষণভাবে প্রকট হয়েছিল। সেই শচীর নন্দন গৌরহরি অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়ে যৌবনে একের পর এক তর্কালঙ্কার, বিদ্যারত্নের ন্যায় পণ্ডিতদের শাস্ত্র আলোচনায় পরাজয় করলেও তিনি তাঁর জীবদ্দশায় একটাও গ্রন্থ রচনা করে গেলেন না। শুধুমাত্র জীবশিক্ষার লাগি রেখে গেলেন মাত্র আটটি শ্লোক যা শিক্ষাষ্টকম্‌ নামে পরিচিত এবং আজকের প্রবন্ধের শুরুতেই তাঁর প্রথম শ্লোকের অংশ নিয়ে শুরু করা হয়েছে। তাঁর জ্ঞানের এই প্রভাব অঙ্গ, বঙ্গ কলিঙ্গের সকল স্থানে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়লেও পরবর্তীকালে তা সারা ভারত ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে কালের নিয়মে। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম/সর্বত্র প্রচার হবে মধুর কৃষ্ণনাম’। সেই ধারা মেনে আজকের গৌড়ীয় মঠ কিংবা নিত্যানন্দ আশ্রম আর ইস্কনের আন্তর্জাতিক শাখা সেই কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছে নিরলসভাবে।

        ভগবান কৃষ্ণের অংশ বলে মানা হয় নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতকে। তিনি ভক্তের প্রেম আস্বাদিতে এই অবতারে এলেন একেবারে ভক্ত হয়ে। তাই তো সত্যের নারায়ণের ন্যায় চারহস্তে অস্ত্র নিয়ে এলেন না, ত্রেতার রামচন্দ্রের ন্যায় তীরধনুক নিয়ে রাজা হলেন না, আবার দ্বাপরের কৃষ্ণের ন্যায় সুদর্শন চক্রের ব্যবস্থা রাখলেন না। এলেন শুধু প্রেমকে সাথী করে। অন্তরে কৃষ্ণ আর বাহিরে রাধাভাব নিয়ে কলির জ্ঞানান্ধ জীবকে মুক্তি দিতে নিয়ে এলেন মধুর কৃষ্ণ নাম। ভক্তের পদধুলি মেখে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর এক ভাবান্তর ঘটে। দ্বাপরে বৃন্দাবনে ছিলেন কালো কৃষ্ণ, ত্রিভঙ্গ মুরারী, রাখাল বালক। ভক্তের ভালোবাসায় সেই বঙ্কিম কৃষ্ণ আজ আজানুলম্বিতভুজৌ গৌরাঙ্গ, কালো কৃষ্ণ হয়ে গেল কাঁচা সোনার মত বর্ণ গোরা আর রাখাল গোপবালক কৃষ্ণ হয়ে গেল নবদ্বীপের সেরা পণ্ডিত। এখানে বাস্তবতা হল ভগবান দ্বাপরের রাজপরিবার ছেড়ে একেবারে নবদ্বীপের সাধারণ জনগণের মাঝে এসে যে মাধুর্য পেলেন তা হয়ে গেল এক জীবশিক্ষা। আমরা ধর্মের কথা যতই মুখে বলি না কেন, যার জন্য ধর্ম পালন, তাঁদের থেকে দূরে থেকে কোনদিন সেই ধর্ম পালন বা নির্দেশে কিছুই প্রতিপন্ন হয় না। তিনি পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন যে আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। নিজে এক গরীব ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়ে যে জ্ঞান, যে প্রেম, যে সৌম্যকান্তি দেহে নবযৌবনের উদ্ভাসিত ডাককে উপেক্ষা করার ক্ষমতা আর মানুষকে আপন করে নেবার দক্ষতা তা জগতকে শিক্ষা দেবার জন্য যথেষ্ট। তাঁর মানবপ্রেমের বহ্নিশিখায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক বিভেদের বেড়াজাল। তিনি সবার কাছে হয়ে গেছিলেন পরম প্রেমময়। যবন হয়েও হরিদাস (হারেশ) বা চাঁদকাজী পেয়েছিলেন তাঁর সান্নিধ্য। অস্ত্র নয়, রাজনীতি নয় শুধু তাঁর প্রেমের বন্যায় ভেসে উত্তরণ ঘটেছিল সেসময়কার ত্রাস সমাজবিরোধী মাতাল দুই ভাই জগাই ও মাধাই আর চাপল গোপাল। এখানেই ফুটে ওঠে এক দর্শন। জীবের কাছে রক্তচক্ষু প্রদর্শনের থেকে বেশী দরকার প্রেম আর আগলে রাখার সহবৎ শিক্ষা, তাতেই ঘটবে রূপান্তর। কিন্তু আমরা সেই গৌরাঙ্গকে হাতের কাছে পেয়ে অনেকেই চিনতে পারি নি, আর অনেকেই চিনতে চাই নি। তাই তো লোচন দাস বড় আক্ষেপ করে বলেছিলেন-

অবতারের সার                   গোরা অবতার

কেননা ভজিলি তাঁরে।

করি নীরে বাস,          গেল না পিয়াস

আপন করম ফেরে।।

কণ্টকের তরু            সদাই সেবিলি (মন)

অমৃত ফলের আশে।

প্রেম কল্পতরু            শ্রী গৌরাঙ্গ আমার

তাহারে ভাবিলি বিষে।।

-----------------------------

সংসার ভজিলি           শ্রী গৌরাঙ্গ ভুলিলি

না শুনিলি সাধুর কথা।

তোর ইহ পরকাল        দু’কাল খোয়ালি (মন)

খাইলি আপন মাথা।।

 

        শ্রীচৈতন্যের শিক্ষা আর দর্শনের অপর একটি উল্লেখযোগ্য শ্লোক হল, ‘তৃণাদপি সুনিচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা, অমানিনেন মানদেন কীর্তনীয় সদাহরি’। অর্থাৎ ঘাসের থেকেও নম্র হতে হবে, গাছের থেকেও সহনশীল হতে হবে আর গ্রামে যাকে কেউ মানেন না, তাঁকে সম্মান দিয়ে চলতে হবে তবেই হবে প্রকৃত বৈষ্ণব, তবেই হবে কীর্তনের অধিকারী। ঘাসের উপর দিয়ে যেমন কেউ হেঁটে চলে গেলে ঘাস প্রতিবাদ করে না, সময়ের সাথে সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়, বৃক্ষরাজির উপর কুঠারাঘাত করলে যেমন বৃক্ষ প্রতিবাদ করে না, তেমন আমাদের সবাইকে হতে হবে। তবেই প্রবাহিত হবে অমিয় প্রেমের ধারা, তবেই দূর হবে এই ঘন অন্ধকার। জাতপাতের বেড়াজাল আর ব্রাহ্মন্যবাদের উপরে উঠে তিনি সাম্যের গান গাইতেন। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে সকল ধর্মের এবং সকল বর্ণের মানুষের ভিড় ছিল। মানুষকে দেবতা জ্ঞান করতে হবে, সেই কারণে কোন ব্যক্তির নাম রুচিসম্মত না হলে তিনি পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করে দিতেন।

        যিনি আসেন অনেকের জন্য তাঁকে মনে হয় কোনভাবেই একজনের কাছে আবদ্ধ রাখা যায় না কোনভাবেই। এত পাণ্ডিত্য নিয়ে নিমাই পণ্ডিত জগতের কাছে এক মনীষায় পরিণত হলেন সেই নিমাইয়ের কারণে সারাজীবন তিনজন নারী বেঁচে থেকেও মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা হলেন মাতা শচী দেবী, প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া ও দ্বিতীয় স্ত্রী অভাগিনী বিষ্ণুপ্রিয়া। তিনি স্বীকার করেছিলেন সংসার ছেড়ে তিনি যে সন্ন্যাস নিয়ে সারা ভারতের সংস্কৃতি জগতে এক অনন্য বিপ্লবের কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন তা শচী দেবী ও স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর অসীম ত্যাগের ফসল। তপ্ত যৌবনের আগুনে উড়ন্ত পতঙ্গের ন্যায় ঝাঁপ না দিয়ে উদাসীন ছিলেন। লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্পাঘাতে মারা গেলেও তাঁর সাধনজীবনের অন্যতম সঙ্গী হতে পারতেন প্রেমময়ী রাজকন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া। তাঁকে বঞ্চিত করে রাতের অন্ধকারে সন্ন্যাসের পথে পা বাড়িয়ে কাঁদিয়েছেন মা ও প্রিয়া কে। সেজন্য তিনি পরে আক্ষেপ করেছিলেন, যে কৃষ্ণপ্রেম তাঁর এই দায়িত্ব থেকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তা ঠিক হয় নি। তিনি সেই আক্ষেপের কারণে নীলাচল থেকে নিত্যানন্দকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সংসার করার জন্য। তিনি এটাও বলেছিলেন, নিতাই তুমি যাও সংসার করো, নইলে ভবিষ্যৎ অনুগামী বিবাহ, সংসার বা পরিবার থেকে সদা উদাসীন থাকবেন। সেটা কৃষ্ণ পথের পথিকদের জন্য শোভনীয় হবে না। ধর্মপালন বা কোন দর্শনের অনুগামী হওয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষের জীবনচর্চায় নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। এর বাইরে ধর্মাচরণ কে ধর্মান্ধ বলাই শ্রেয়। চৈতন্যদেব তাঁর চেতনা ও দর্শনে সেটাই উপস্থাপন করেছেন বারেবারে। আজ প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও তাঁর ভাবনা আর দর্শনের ক্রমবিকাশ ঘটেছে, একটুও ভাটা পড়ে নি। দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে সেই প্রেমের মন্ত্র। তাই শাস্ত্র আলোচনা বা মহাজন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গেলে জলে নামতে হবে। তীরে দাঁড়িয়ে জলের গভীরতা পরিমাপ করা যায় না। আমরা জানি, ‘দুধেতে নবনী আছে মন্থন কর যেয়ে/মোক্ষ অর্থ ঢাকা আছে গৌণ অর্থ দিয়ে’। বাইরে থেকে আমরা যা দেখতে পাই সেটা হল তথ্য কিন্তু অন্তর দিয়ে যা অনুভব করে প্রকাশ করতে হয় তা হল তত্ত্ব।

        তাঁর মত জ্ঞানী, পণ্ডিত, ত্যাগী, সন্ন্যাসী মানুষেরও যেমন খ্যাতি ছিল, তেমন ছিল খ্যাতির বিড়ম্বনা। জীবনের প্রথমভাগ থেকে তাঁর পাণ্ডিত্য আর সমাজের কুসংস্কার বা অপসংস্কার মুক্ত করতে ব্রাহ্মণসমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে সবাইকে পরাজয় করেও একে একে শত্রু বেড়েছে। ‘পণ্ডিত যে জনা, আজন্ম কানা/ শাস্ত্র ঘেঁটে মরে, শাস্ত্রের মর্ম বোঝে না’। এমন অনেক স্বঘোষিত পণ্ডিতের মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। নবদ্বীপ ছেড়ে নীলাচলে গিয়ে থাকলেন জীবনের শেষ ২৪ বছর। সেখানে রাজা প্রতাপাদিত্যের মত মানুষ তাঁর শিস্য হলেও সেখানে বঙ্গসংস্কৃতির এই উত্থান মেনে নিতে পারেন নি স্থানীয় ধর্মের ধ্বজাধারীরা। তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে এক গভীর রহস্য আজও বিরাজ করে বাঙ্গালীর মনে প্রাণে। বিখ্যাত চৈতন্য গবেষক তথা ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায় তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমন করুন পরিণতি প্রেমের পথযাত্রী চৈতন্যদেবের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল যে তাঁর অন্তর্ধানের পরে প্রায় এক’শ বছর প্রকাশ্যে বাংলায় কীর্তন গান করার সাহস কেউ দেখাত না। আজ সময়ের সাথে সাথে তাঁর দর্শন বা তাঁর প্রভাব ভারতীয় সংস্কৃতি ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীর মানচিত্রে কিভাবে জায়গা করে নিয়েছে সেটা সবার কাছে উন্মোচিত হয়েছে।

আজও নীলাচলবাসী অন্তর দিয়ে মানেন পুরীধামের সমুদ্রসৈকত কে কেন্দ্র করে তাঁদের যে পর্যটনশিল্প সারাবছর ধরে, তাঁর প্রকৃত কেন্দ্র কিন্তু পুরীর জগন্নাথ মন্দির। আর সেই জগন্নাথধামে মানুষের ভিড়, বাঙ্গালীর ভিড় হয় কিন্তু আমাদের মহাপ্রভুর প্রতি বাঙ্গালীর আবেগমথিত হৃদয়ের কারণে। যদিও তাঁরা স্বীকার করেন না প্রকাশ্যে। মানুষ আসেন মানুষ যায়, তবুও তিনি বেঁচে থাকেন তাঁর কর্মে, তাঁর ফেলে রাখা ভাবধারায়। আমাদের মহাপ্রভু বেঁচে আছেন আজও, থাকবেন আগামীতে শুধুমাত্র তাঁর দর্শন আর তাঁর কর্মে। বিশ্বাস বা অবিশ্বাস তো সময়ের দাস। গভীর সমুদ্রে ঝড় উঠলে নৌকার কোন যাত্রী নাস্তিক থাকেন না। পরিস্থিতি মানুষকে দেবতা বানায়, আবার পরিস্থিতি মানুষ মানুষকে মানুষ বলে মনে করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এভাবেই মানুষের মাঝে মানুষ এসে দেবতা হয়ে চিরকাল রয়ে যায় আবার কেউ মানুষ হয়েও শয়তানের কারিগর বলে পরিচয় পায়। এভাবেই গড়ে ওঠে স্বর্গ, এভাবেই চোখের সামনে ফুটে ওঠে নরক। কল্পনার দরকার কি যদি বাস্তবের চেতনায় নিজের ভাবার ক্ষমতা থাকে। আজও আমরা যেভাবে উপহাস করি মায়াপুরের ইস্কনে বিদেশীদের মাটিতে লুটিয়ে কৃষ্ণনাম জপ করতে দেখে, ঠিক তেমনি যেদিন নবদ্বীপে মহাপ্রভু এসেছিলেন সেদিনও আমরা উপেক্ষা করেছি। প্রকৃত জ্ঞানচক্ষু না থাকলে দর্শন মেলে না ঘরের বাইরের পরিবেশের। তাই আমরা সাগর থেকে উত্তরে ছুটে যাই পাহাড় দেখতে আর তাঁরা দক্ষিণে আসেন সাগর দেখতে। নিজের কাছে যেটা সুপ্রাপ্য তা আর গুরুত্ব পায় না। এটাই দুর্ভাগ্য হয়ে রয়ে যায় চিরকাল। প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুকে আমার প্রণাম।

       

 

ত্যাগের প্রতীক গৌরপ্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া

 ত্যাগের প্রতীক গৌরপ্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া


কাঁদে দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া,             নিজ অঙ্গ আছাড়িয়া

লোটায়ে লোটায়ে ভূমিতলে।

ওহে নাথ কি করিলে,           পাথারে ভাসায়ে গেলে

একা মুই এ ভুবনমণ্ডলে।

আজও যেন সেই কান্নায় নবদ্বীপের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে জানতে চাইছে, গৌরহরি তুমি কোথায়? মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহের মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে যখন তাঁর স্বামী সমাজ সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসের পথে যাত্রা করে তখন সেই কিশোরী, যুবতীর দশা কি যে হতে পারে তা বোধ করি আমাদের পাঠকদের অজানা নয়। আজ থেকে পাঁচশত বছরের অধিক পূর্বে সেই সমাজ ব্যবস্থা আর বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এক নয়। আমাদের দর্শন, ভাব বা বিজ্ঞান বা চিন্তা যাই বলুন না কেন সবকিছু সময় আর স্থানের নিরিখে আপেক্ষিকভাবে গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। তাই সনাতন হিন্দু ধর্মের ভাবধারা বর্তমান প্রজন্ম কেমনভাবে গ্রহণ করবেন তা অতীতের সাথে না মেলানোই শ্রেয়। আজকের দিনে তো অনেকেই অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ধর্মের নামে কুৎসা রটিয়ে নিজের ধর্মের কাছে নিজেই বিধর্মী হয়ে ওঠেন শুধুমাত্র আধুনিক তকমা পাবার নেশায়। আজকের নারী যখন নিজের অধিকার বুঝে নিতে স্বামী বা তাঁর সংসারকে ছুঁড়ে ফেলতে পারেন, সেই সময় বিষ্ণুপ্রিয়া রাজপরিবার থেকে এসে একের পর এক ত্যাগ আর উদারতা দেখিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের তথা বিশ্বের নারীজাতির মধ্যে ত্যাগের মূর্ত দেবী। তাঁর স্বামীর গৃহত্যাগের সংবাদে আছাড় খেয়ে পড়ে কাঁদছেন এবং বড় আক্ষেপ করে বলছেন, যে ওহে নাথ এ কেমন ধারার কাজ তোমার? এই বিশ্বভুবনে তুমি আমাকে একা করে দিয়ে চলে গেলে? পতিব্রতা বিষ্ণুপ্রিয়ার বয়স এত কম ছিল  যে পুনরায় বিবাহ করে সোনার সংসার সাজিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তা করলেন না তিনি, কারণ তাঁর সংসার যে বিশ্বভুবন জুড়ে। তিনি কি করে একটা চার দেওয়ালের মাঝে সংসারে আবদ্ধ রাখেন নিজেকে।

সাধক বা মহাপুরুষের জীবন ও কর্মে নারীশক্তির প্রভাব অনস্বীকার্য। জননীর শিক্ষাদীক্ষা মানবের চরিত্র নির্মাণ করেন তাই তিনি দীক্ষাগুরু। নারীর এক হৃদয়ে কত রস যেমন একই অঙ্গে কত রূপ। তাঁর প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ, অভিমান, সহানুভূতি ইত্যাদি সাধকজীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। মাসীপিসির পরিণত দরদ, ভগিনীর উচ্ছল প্রীতি, প্রতিবেশিনীর হাস্যকৌতুক এত রস শুধু নারীহৃদয় থেকে উৎসারিত হয় বিচিত্রধারায়। সেই রসে পুষ্ট হয়ে বালক যখন যৌবনলাভ করে জীবনে আসে জায়া। জননীর স্নেহে কিংবা জায়ার প্রেমে কিবা বুদ্ধ কিবা চৈতন্য কিংবা রামকৃষ্ণ সবাই অভিষিক্ত। আবার গৌতমবুদ্ধ গোপাকে ত্যাগ করে বুদ্ধত্ব লাভ করতে গেলেন, শ্রীচৈতন্য বিষ্ণুপ্রিয়াকে ছেড়ে প্রেমধর্ম প্রচার করতে বেরোলেন আর শ্রীরামকৃষ্ণ সারদাকে জগন্মাতারূপে পূজা করে বারংবার বললেন কামিনীকাঞ্চন ত্যাগ করো। মহাপ্রভুর জীবনে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়া নন, আরও অনেক নারীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন শচীমাতা, যোগমায়া, সীতাঠাকুরানী, মালিনী, মাধবী আর প্রথম স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া। তিনপ্রকার নারী তথা জননী, জায়া ও অনুরাগিণীর প্রভাব ছাড়াও যথা বারমুখী, শ্রীমতী, লক্ষহীরা, সত্যবাঈ, লক্ষ্মীবাঈ প্রমুখ চৈতন্য সান্নিধ্যে এসে জীবনের মূল স্রোত পেয়েছিল। কিন্তু সবার থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছেন দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনেক বড় বড় লেখক বহু গ্রন্থ রচনা করে বাংলার বৈষ্ণব ঘরানা সমৃদ্ধ করলেও বিষ্ণুপ্রিয়া চিরকাল কেমন যেন থেকে গেছেন উপেক্ষিতা হয়ে। কিন্তু সারা বিশ্বের ইতিহাসে যতজন মহীয়সী নারী ছিলেন, তাঁদের থেকে কোন অংশে আমাদের গৌরপ্রিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া পিছিয়ে ছিলেন না। শাক্ত আর বৈষ্ণব বা শক্তি আর ভক্তির লড়াইয়ে প্রেমের প্রতিষ্ঠা দিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবদানের পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়ার অবদান ভোলার নয়। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের প্রেমধর্মে বিপ্লবের জোয়ার এসেছিল দেবী বিষ্ণুপ্রিয়ার ত্যাগ আর নিষ্ঠার কারণে। আমরা দেখেছি, যারা বিশ্ব সংসারের কাজে আসেন, যার দর্শন সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে জগতজীবকে উদ্ধার করে তমসা থেকে নিয়ে আসেন আলোকের জগতে, তাঁরা সাধারণত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। আবার যদিও বা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাঁরা নিঃসন্তান থাকেন। কারণ সংসারের মায়াজালে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে এই ভুবনে তিনি যেন সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে আটকে না পড়েন। তাঁর বৃহত্তর কর্মকাণ্ড যেন এক ছোট্ট পরিসরে আটকে না যায়। তাই তো তাঁরা সংসার বিমুখ হয়ে যান। ত্যাগের পর ত্যাগ করতে করতে হয়ে ওঠেন মহান। আর আজকের আলোচনার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল ভারতীয় নারীর কাছে এক উজ্জ্বল মার্গ প্রদর্শন।

সব থেকেও যিনি সমাজ ও সংসারের জন্য ভিখারির ন্যায় জীবন কাটালেন তিনিই তো পূজ্য। প্রখ্যাত গীতিকার হীরেন বসুর গানে আমরা দেখেছি বিষ্ণুপ্রিয়া চিরবিরহী ভগবান ঘরণী। যুগে যুগে বিভিন্ন রূপে তাঁরই লীলা হয় প্রকাশিত। তিনি লক্ষ্মীর অংশ, রাধাভাবদ্যুতি সম্বলিত ও জনমদুঃখী সীতার উত্তরসুরী বিষ্ণুপ্রিয়া। কলিযুগে অবতার প্রেমের ঠাকুর পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক সময়ে নবদ্বীপের রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের নয়নের মণি কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া। যার মাতার নাম যোগমায়া দেবী। দ্বাপরযুগে সনাতন মিশ্র রাজা সত্রাজিৎ ও তাঁর কন্যা কৃষ্ণপ্রেয়সী সত্যভামা এযুগের বিষ্ণুপ্রিয়া। এই বিষ্ণুপ্রিয়া কেবল নারী নন, তিনি ভারতবর্ষের বহু সুশীলা আদর্শ নারীর প্রতীক যার রূপের ছ’টায় নবদ্বীপকে করেছে আলোকমণ্ডিত। তিনি সুশ্রী, নম্র ও ভক্তিমতী, থির বিজুরী গৌরবরনী। তাঁকে বিশেষিত করতে পদকর্তা বলেন চাঁদবদনী ধ্বনী, প্রিয়া, মৃগনয়নী, গৌরপ্রেমে গরবিনী, গৌরবক্ষবিলাসিনী। যার দেহে নবীন যৌবন, গলিত কাঞ্চন, মধুভাষিণী, শাস্ত্রজ্ঞের কন্যাহেতু প্রখর শাস্ত্রজ্ঞান। তিনি নবদ্বীপচন্দ্র গৌরহরির প্রেমপ্রদায়িনী, সাধারণী, সমঞ্জসা, সমর্থা, সরোবরের রাজহংসিনী, যিনি মরালিনী, রমণী রতনমণি, গৌরপ্রেমে পাগলিনী, কুলবধূ যোগিনী, বৈষ্ণবকুল শিরোমণি যিনি ভগবৎপ্রেমে ঐশ্বর্যত্যাগী, লাস্যময়ী, সদাহাস্যময়ী, লাজবতী বিষ্ণুর প্রিয়াই তো অভাগিনী, চিরদুঃখিনী বিষ্ণুপ্রিয়া।

ভারতই জ্ঞানবিজ্ঞানের আদি জননী ত্যাগ ও সাধনার পীঠভূমি। ভারতের বিদ্যা, ভারতের সাধনা, ভারতের ধর্ম, ভারতের শিক্ষা-দীক্ষা, ভারতের সতীধর্মের কীর্তিসক্তি সর্বত্র বিঘোষিত জয়শ্রীমণ্ডিত। ভারতের রমণী “অজ্ঞানতমঃ খণ্ডনী সুক্ত জননী, ব্রহ্মবাদিনী, ঋঙ্‌মণ্ডল মণ্ডনী”। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন, ধর্মরক্ষা প্রভৃতি কর্তব্য সাধনের কাহিনী জগতের ইতিহাসে দ্বিতীয় নেই। সীতা, বেহুলা বা সাবিত্রীর ন্যায় বিষ্ণুপ্রিয়ার ত্যাগ ইতিহাসে জায়গা তেমনভাবে পেল কই। চৈতন্য সাহিত্য চর্চায় বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্র বা তাঁর অবদান নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে। তাঁর ত্যাগ, সংযম, প্রেম, নিষ্ঠা ও ভক্তিকে পাথেয় করে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য বিশ্বের প্রেমধর্ম প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিলেন। বালিকাবধু বিষ্ণুপ্রিয়া যখন নারীজীবনের পুতুল খেলার বয়স, তখন তাঁর কাঁধে গুরুভার হয়ে চাপে শচীমাতার সংসার। রাজপণ্ডিত সনাতন মিশ্রের কন্যা রাজবৈভবে যখন ভাসার কথা, ঠিক তখন তাঁর বিবাহ হয় পাণ্ডিত্যসর্বস্ব শচীতনয় গৌরহরির সাথে, যার ঘরে কোন বিত্তবৈভবের লেশমাত্র নেই। কিন্তু তাঁর পতিনিষ্ঠা তাঁকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল।

একজন নারী সাবালিকা হবার পূর্বে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল একজন বিপত্নীক মানুষের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পর স্বামীর গৃহত্যাগ। সন্ন্যাসগ্রহণের পর স্ত্রীর মুখদর্শন নিষেধ। সকল রাজসুখ ত্যাগ করে যার কাছে এসেছিলেন তিনি সকল মোহ ত্যাগ করে কৃষ্ণপ্রেমে বেড়িয়ে পড়লেন। মহাপ্রভুর ভগবান সত্ত্বা বাদ দিলে এই কীর্তি মেনে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকা শুধু তাঁর স্বামীর মঙ্গল কামনায় সে তো বিষ্ণুপ্রিয়া করে দেখিয়েছেন। সন্ন্যাসের পর তিনি যখন এসেছিলেন, নদীয়ার সবাই দল বেঁধে তাঁকে দেখতে গেছিলেন, শুধু তিনি ছাড়া। অনেকেই রসিকতা করে বলেছিলেন যে বিষ্ণুপ্রিয়া আমাদের সবাইকে যেতে বলেছেন, কিন্তু তোকে না। সেখানে বিষ্ণুপ্রিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, “তোমরা যে মানুষের উদ্দেশ্যে দৌড়ে চলেছ, সেই মানুষটা যে আমার নিজের। এ কি কম গৌরবের গো!” এখানেই বিষ্ণুপ্রিয়া নামের সার্থকতা। আজকালকার দিনে কোন ছেলে বা মেয়ে তাঁর প্রেমিকের কোন পোষ্ট বা কথায় যদি কেউ প্রীতিজনক প্রতিক্রিয়া জানায় সেখানেই বিচ্ছেদের পেরেক প্রথিত হয়ে যায়, সেখানে এতবড় আত্মত্যাগ না হলে নদীয়ার নিমাই কি আর ভগবান হতে পারতেন? যার এত রূপ, এত গুণ, এত ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও মানুষের সেবায় ভিখিরিনী হয়ে জীবন কাটালেন। ২৪ বছর বয়সে স্বামী চলে গেলেন, মহাপ্রভু আরও ২৪ বছর পরে অন্তর্ধান হয়েছিলেন। সেই সময়কার কথা জানলে আমাদের দেহে মনে শিহরণ জাগবে।

সন্ন্যাসের আগে বিষ্ণুপ্রিয়া তাঁর প্রাণবল্লভের চরণ দুখানি ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘প্রাণেশ্বর হৃদয়বল্লভ, আমাকে লয়ে তোমার সংসার, এই হতভাগিনীই তোমার জঞ্জাল, আমার জন্য তুমি সংসার ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছ, আমার জন্য তুমি বৃদ্ধা জননীকে ছেড়ে গৃহত্যাগী হচ্ছো, আমিই তোমার ধর্মজীবনের পরমশত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছি, আমার জন্য তুমি নিশ্চিন্তে প্রেমধর্ম প্রচার করতে পারছ না, তাই আমি আত্মত্যাগ করব। তবু তোমার কোন কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াব না। নিমাই সন্ন্যাস নিয়ে চলে গেলেও আর দেখা করেন নি বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে। বাকি জীবন খুব দুর্বিষহ অবস্থায় কাটে। ইচ্ছে করেই আর পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন নি জগত কে শিক্ষা দেবার জন্য। পরে তাঁর কথা ভেবে মহাপ্রভু খুব দুঃখ পেয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। স্বামী চলে যাবার কয়েকবছরের মধ্যেই শচীমাতা দেহত্যাগ করেন। তিনি সংসারে থেকেও যোগিনীর মত জীবনযাপন করতে থাকেন। প্রতিদিন ভোরবেলা ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে গঙ্গায় স্নান করে কৃষ্ণনাম জপ করেন। একবার জপ সমাপনান্তে, একটা করে আতপচাল গণনার সুবিধার্থে সরিয়ে রাখতেন। এইভাবে সারাদিন জপের শেষে যেকটা দানা জমা হত, সেই পরিমাণ শস্য ফুটিয়ে নিয়ে শাশুড়িকে নিয়ে ভাগ করে খেতেন। শাশুড়ি চলে যাবার পর তিনি একাই জীবন নির্বাহ করতেন সাত্ত্বিকভাবে কৃষ্ণপ্রেমে। এই জীবন দর্শন আজকের জগতজীবকে ত্যাগের শিক্ষা প্রদান করে প্রেম কে করে প্রতিষ্ঠা। সেখানেই এই জীবনের সার্থকতা। মহাপ্রভু আজ প্রেমের বাণী নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে জগতের মাঝে এক ধারা তৈরি করে মহাপুরুষ হয়ে আজও পূজিত হলেও আড়ালে থেকে গেলেন তাঁর অন্যতম শক্তি দেবী বিষ্ণুপ্রিয়া। তাঁকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

 

জগতের ধর্মগুরু ভগবান শঙ্করাচার্য

 বাল্যগুরু ভগবান শঙ্করাচার্য

যার গন্তব্য বহুদূর তাঁর প্রাথমিক গতি ধীর প্রকৃতির হয়ে থাকে, কিন্তু যার গন্তব্য নিকটে তাঁর গতি শুরু থেকেই তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন মনে করুন লোকাল ট্রেনের যাত্রাপথ কম তাই তার তাড়া বেশী, কিন্তু এক্সপ্রেস ট্রেনগুলি অনেক দূরে যাবে তাই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যেতে অনেক সময় লাগে। জীবের জীবদ্দশায় এমন ভাব লক্ষ্য করা যায়। যে জীবের আয়ু কম, তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি কর্ম সম্পাদন করেন যেমন মানুষ গড়ে একশত বছর বাঁচে বলেই জন্মের পর একবছর শুয়ে কাটিয়ে দেয়, কিন্তু গরু বা ছাগলের সেই সুযোগ থাকে না বলেই জন্মের পরে পরেই চারপায়ে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা শুরু করে আবার অনেক পক্ষী বা পতঙ্গ জাতীয় প্রাণীর আয়ু এতই কম যে জন্মের সাথে সাথে ওড়ার চেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু মানবজীবনে এটাও দেখা গেছে যারা জগতের কল্যাণের জন্য এসেছেন, যারা মহামানব হয়ে এসেছেন, যারা মানুষের সমাজ, সংস্কৃতি ও চিরাচরিত চিন্তাধারার অবসান ঘটিয়ে নতুন দর্শনের প্রতিস্থাপন করে নবজাগরণ ঘটিয়েছেন তাঁদের আয়ুষ্কাল কম হয়ে থাকে। এমন উদাহরণ বহু আছে। স্বামী বিবেকানন্দ বা চৈতন্য মহাপ্রভু কেউ পঞ্চাশে পা দেন নি। তেমনি একজন মহান সন্তানের কথা তুলে ধরব এই প্রবন্ধের মাঝে। তিনি আর কেউ না জগতের ধর্মগুরু ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য। দক্ষিণ ভারতের কেরলের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর ভাবধারা, তাঁর বেদান্তবাদ, তাঁর অদ্বৈতবাদ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে সময়ের সাথে সাথে। আজ থেকে ১৯৩২ বছর আগে কেরলের কালাডি গ্রামে শিবগুরু পিতা ও সতীমাতার ঘর আলো করে জন্ম নিলেন এই দিব্য পুরুষ। সৌম্যকান্তি, অপূর্ব তেজরাশি প্রবহমান শিরায় শিরায়।

সনাতন হিন্দুধর্মের গুরু, অবতার আর ভগবানের অভাব নেই। ভিন্ন ধারায় ভিন্ন অনুগামীদের কাছে ভিন্ন মানুষ দেবতা বা গুরু সত্ত্বা পেয়ে এসেছেন বা আজও পেয়ে চলেছেন অনেকেই। কিন্তু আমাদের জানতে হবে ভারতীয় দর্শন ও কৃষ্টি বা চিরাচরিত ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কারের পথ ধরে কুসংস্কার ছেঁটে দিয়ে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন এক নতুন সমাজ। তাঁরাই প্রকৃত ধর্মগুরু, তাঁরাই মহাজন মনীষী। ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি এসেছিলেন বুদ্ধের মহানির্বাণের অনেক পরে। প্রায় বারো’শ বছর পরে, যখন প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের ন্যায় নীতি সরিয়ে এক বিকৃত বৌদ্ধধর্মের আধিপত্যে সংকটে পড়েছিল সনাতন হিন্দু ধর্ম। ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য ভারতবাসীর মনে প্রাণে প্রকৃত জ্ঞানের সঞ্চার করে তাঁদের একান্ত নিজস্ব বৈদিক কৃষ্টিধারায় করেছেন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত এবং জ্বেলে দিয়ে গেছেন জগতের অধ্যাত্মিক মন্দিরে এক অভিনব আলোকবর্তিকা। অপূর্ব জ্ঞান নিয়ে জন্ম নিয়েছিলেন শ্রুতিধর এই ব্যাক্তি, যিনি যা শুনতেন একবার তা মনের মণিকোঠায় জায়গা পেয়ে যেত। সেই কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সকল শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে গেছিলেন।

ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য দিব্যদ্যুতি নিয়ে এসেছিলেন। তাই মাত্র তিন বৎসর বয়সে চূড়াকরণ হবার পর তাঁর পিতৃবিয়োগ হলেও তিনি নির্বিকার ছিলেন। পাঠকের মনে হতে পারে ওই বয়সে অনুভূতি আসে না যে এই সংবাদে তিনি বিকারগ্রস্থ হবেন। কিন্তু তিনি তো আর পাঁচজনের মত না। জন্ম থেকেই তিনি এতটাই পরিপক্ক বোধবুদ্ধিতে যে মাত্র পাঁচবছর বয়সে উপনয়ন হয়। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার চিত্র আমরা কেউ জানি না। তবে তথ্য বলছে তাঁর মাত্র আট বছর বয়সে বিবাহের প্রস্তাব আসে এবং যা প্রত্যাখ্যান করে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা হল, ‘আমার আয়ু মাত্র ষোল বৎসর, আমি জন্মসন্ন্যাসী’। এখানেই তাঁর দিব্যজ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়। তিনি নিজের ভবিষ্যৎ জানতেন। আমরা যারা মানব তাঁদের ভবিষ্যৎ জানার অধিকার ঈশ্বর দেন নি। সেই কারণ জানতে চেয়েছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাঞ্চাল কুমারী। কৃষ্ণ বলেছিলেন জীবের ভবিষ্যৎ জানার অধিকার দেওয়া হয় নি কারণ ভবিষ্যৎ জানলে জীব নিজেই দুর্নীতিগ্রস্থ হবেন, কারণ জীবের সংযমের অভাব আছে। তাছাড়া জীব ভবিষ্যতে কোন পীড়াদায়ক ঘটনার কথা জানলে তিনি তাঁর বর্তমানের আনন্দ বিসর্জন দেন সেই ভবিষ্যতের কঠিন অধ্যায়ের কথা ভেবে ভেবে, কিন্তু ভবিষ্যতের সুখবার্তায় কোনকালে বর্তমানের দুঃখকে উপেক্ষা করতে পারেন না। এটাই সবথেকে এর কাঠিন্যতা। কিন্তু যে সকল জীবের সমান্তরাল ভাবধারার বাইরে তিনি তাঁর আয়ু মাত্র ১৬ বছর জেনেও নির্বিকার থাকেন। তিনি ঘোষণা করতে পারেন তিনি জন্মসন্ন্যাসী। তিনি অচিরেই বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান  করে দিয়ে সংসারের মায়াজাল ছিন্ন করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন সমাজের পথপ্রদর্শক হিসাবে।

সাধক শিশু শঙ্করাচার্য একদিন মায়ের কাছে সন্ন্যাস নেবার কথা জানালে মা সম্মতি না দেওয়ায় সংসারের এই মায়াময় টান কাটাতে ছলনার আশ্রয় নিলেন। নিকটস্থ পূর্ণা নদীতে স্নানকালে কুমীরের কবলে পড়লে মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন শঙ্করাচার্য বলেন মা তুমি যদি আমাকে সন্ন্যাসের অনুমতি দাও তাহলে ওই কুমীর আমাকে মুক্তি দেবে। মজার বিষয় মায়ের সম্মতি প্রদানের সাথে সাথেই কুমীর তাঁকে ছেড়ে দিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যায়। এভাবেই সন্ন্যাসের পথে গিয়ে বেদান্ত আর অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য গুরু গোবিন্দপাদের কাছে গিয়ে বলেন, ‘প্রভু আমাকে ব্রহ্মজ্ঞান ও সন্ন্যাস দিয়ে চরিতার্থ করুন’। গুরুদেব সেই অপরিচিত বালককে পরিচয় জিজ্ঞেস করাতে তিনি যা বলেছিলেন তা সাধকজীবনের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রভু, আমি পার্থিব কিছু নই, আমি জল নই, আমি আকাশ নই, তেজ নই, বায়ু নই, কোন ইন্দ্রিয় নই বা ইন্দ্রিয় সমষ্টিগত দেহও নই। আমি এসবের অতীত নির্লিপ্ত শিবস্বরূপ পরমাত্মার একটি অংশ মাত্র’। তাঁর উত্তরে গুরুদেব মুগ্ধ হয়ে সন্ন্যাস প্রদান করে ব্রহ্মজ্ঞানী করে তোলেন। শুরু হয় আটবছরের বালকের এক গভীর তপস্যা। তপস্যায় সিদ্ধিলাভের পর শুরু হল পরিব্রাজন। এক এক করে প্রচুর শিস্য তৈরি হল। অদ্বৈততত্ত্বের প্রচার ও ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য প্রণয়ন করলেন।

কাশী, বারানসি হয়ে তিনি এসে পৌঁছলেন হিমালয়স্থিত ব্যাসদেবের পুণ্যাশ্রম বদরিকা আশ্রমে। হিমালয়ের সেই নির্জন প্রান্তরে ও স্বর্গীয় পরিবেশে বসেই রচনা করেছিলেন তাঁর ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্রহ্মসূত্রভাষ্য, উপনিষদভাষ্য, গীতাভাষ্য, সর্ববেদান্তসিদ্ধান্ত ও অন্যান্য অসংখ্য গ্রন্থাদি। মাত্র আট বছর বয়সে সন্ন্যাস এবং তারপর তাঁর হাতে ছিল মাত্র আট বছর, কারণ ষোল বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু ঘটবে। এই কারণে তিনি অতি দ্রুত একের পর এক গ্রন্থ রচনা করে চলেছেন। কিন্তু কথিত আছে তাঁর ব্রহ্মসূত্রভাষ্য স্বয়ং ব্যাসদেব ছদ্মবেশে এসে পাঠ করে পরম পরিতৃপ্ত হয়ে ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্যকে বর দিয়ে যান, ‘বৎস, তোমার এখনও অনেক কাজ বাকি। তোমার পরমায়ু ষোল বৎসরের স্থলে বত্রিশ বৎসর হউক’। তিনি বত্রিশ বৎসর বেঁচে ছিলেন। জীবনের শেষ ষোল বছর শাস্ত্র বিচার ও তর্কযুদ্ধে অংশ নিয়ে একের পর এক পণ্ডিতকে পরাজয় করে বেদান্ত ও অদ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর এই পরিব্রাজনকালে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। মহীশুরের অন্তর্গত তুঙ্গভদ্রা নদীতীরে শৃঙ্গেরীমঠ, দ্বারকায় গোমতী নদীতীরে সারদামঠ, পুরীতে সমুদ্রকুলে গোবর্ধনমঠ ও বদরিনাথে অলকানন্দা নদীতীরে যোশীমঠ বা জ্যোতিমঠ স্থাপন করেন। ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্যই প্রথম মঠনিয়ন্ত্রনবিধি ও বিভিন্ন সম্প্রদায় গঠন করেন। যার মধ্যে দশনামী সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য। তীর্থ, বন, অরণ্য, গিরি, পুরী, ভারতী, পর্বত, সাগর, সরস্বতী ও আশ্রম এই দশটি দশনামী সম্প্রদায়ের পদবী বলে আজও প্রচলিত আছে।

তিনি জ্ঞানের পথযাত্রী। ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত জ্ঞান ও দর্শন অদ্বৈতবাদ নামে খ্যাত যার প্রধান উপজীব্য বেদান্ত ও উপনিষদ। বেদের জ্ঞানকাণ্ডকেই বেদান্ত বলে মানা হয়। তাঁর মতে, ‘ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা। জীব ব্রহ্মই, ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন নয়’। তাঁর রচনা থেকে জানা যায় যে ‘যাহা বড়, যাহা মহান, যাহা বাধারহিত, যাহা মহত ও মহীয়ান তাহাই ব্রহ্ম’। এই ব্রহ্মজ্ঞান না হলে ঝিনুকের অন্তর দেখে রৌপ্য, দড়ি দেখে সাপ বা রৌদ্রকরোজ্জ্বল স্থানকে দূর থেকে মরীচিকা মনে হতে পারে। ব্রহ্মজ্ঞান হলে জগতের সকল অলীকত্ব দূর হয়ে সর্বভুতে এক অখণ্ড সত্তা, অখণ্ড চৈতন্য ও অখণ্ড আনন্দস্বভাবের দিব্যানুভুতির স্ফুরণ হয়। প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ ঘটলে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো দেখতে থাকে জীব, নইলে সবকিছু গুলিয়ে এক অদ্ভুত সমাহারে ফেলে জীব মায়াজালে আটকে পড়ে।

রামকৃষ্ণ মিশন লোকশিক্ষা পরিষদ প্রকাশিত জগতের ধর্মগুরু গ্রন্থ অনুসারে তাঁর নিত্যানিত্যভেদজ্ঞান থেকে জানা যায় পুষ্পমাল্য, চন্দন ও স্ত্রী প্রভৃতিতে জ্ঞানী পুরুষের বিরক্তি জন্মে। আপনারা স্বয়ং বিচার করুন আপনি কতটা জ্ঞানী। যৌবনমদমত্ত, গুরুজন অবমাননা ও মর্যাদালঙ্ঘন পাপ। ব্রহ্মচর্য, অহিংসা, জীবে দয়া, সরলতা, বিষয় বৈরাগ্য, শৌচ ও অভিমান বর্জনই চিত্তপ্রসাদের কারণ। পূর্বজন্মের পাপের জন্য যেসব আধ্যাত্মিক ও আধিদৈবিক দুঃখ পাওয়া যায় তা ধীরভাবে সহ্য করতে হয়। এই সহ্য করাকেই তিতিক্ষা বলে।

পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে রাখি যে প্রবন্ধের শেষ দিকে আমি বেশ কয়েকটি গ্রন্থের একেবারে অনুলিখন করছি শুধুমাত্র তাঁর অভেদ দর্শনের প্রকাশ করার জন্য। তা যতজন লিখুন না কেন, পৃথক হবার নয়। সে তো তাঁর জীবশিক্ষা। এমন একটি গ্রন্থ মণিমালা যেখানে গুরু শিস্যের আলাপ প্রশ্নোত্তরে উঠে এসেছে যা আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। সেখানে তিনি বলছেন যে ঈশ্বরের পাদপদ্মস্বরূপ নৌকাকে স্মরণ করলে তবেই গুরুচরণ পাওয়া যায় আর গুরু কৃপা পেলেই ঈশ্বরপ্রাপ্তি। যিনি বিষয়াসক্ত তিনিই আবদ্ধ জীব। তাঁর মুক্তি আটকে রেখেছে বিষয়ের প্রতি মায়ার বন্ধন আর অন্তহীন লালসা। এজন্যই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু বলেছিলেন, বিষয় ছাড়িয়া কবে শুদ্ধ হবে মন/কবে হাম হেরিব মধুর বৃন্দাবন। বিষয় না ত্যজিলে তাঁরে পাওয়ার মত ভজনের দেহ তৈরি হয় না যে! আর এই সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হলে দরকার আত্মজ্ঞান, বেদবিহিত আত্মজ্ঞান। যার বিষয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা যত প্রবল সে ততই দরিদ্র। যিনি মঙ্গল চান, সদুপদেশ দেন তিনিই গুরু। যিনি বিবেকহীন তিনিই মূর্খ। আর এই মূর্খতা হল দুঃখ। নিজের মনকে শুদ্ধ করতে পারলে আর তীর্থভ্রমণের দরকার পড়ে না। যিনি পরের উপকার করেন তিনিই ধন্য আর সকলের নিকট বিনয়ভাব হল দিব্যব্রত। গুরু, দেবতা আর বয়োবৃদ্ধগণ হলেন উপাস্য। মা যেমন সুখ প্রদান করেন তেমন সুখ আর কেউ না দিতে পারলেও সুবিদ্যা সেই সুখ প্রদান করতে পারে। তাই ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য সুবিদ্যা অর্জন করতে বলেন আর ঈশ্বরের প্রীতি হয় তেমন কর্ম করতে বলেন কারণ সত্য হল এই জগতজীবের কল্যাণসাধন। এইসকল মার্গ হল জীবের দেবত্বে উন্নীত হবার মার্গ।

ভগবান শ্রীশ্রী শঙ্করাচার্য তাঁর প্রসিদ্ধ দার্শনিক কাব্যগ্রন্থ ‘মোহমুদগর’ এ বলছেন, ‘হে মুঢ় ধনাগমের লোভ ত্যাগ করো। হে স্বল্পবুদ্ধে, বিষয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা আনো। স্বকীয় কর্মের দ্বারা উপার্জনে চিত্তকে সন্তুষ্ট রাখো। শত্রু, মিত্র, পুত্র, বন্ধু, বিগ্রহ, সন্ধি – সকল কিছুতেই সমান যত্নশীল হও। তোমাতে, আমাতে ও অন্য সকল বস্তুতে সেই এক বিষ্ণু বর্তমান। অতএব ভেদাভেদজ্ঞান বর্জন করে সমান করে নাও। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ত্যাগ করে নিজেকে চেন, আমার আমিত্বকে টেনে বের করে আত্মোপলব্ধি করতে হবে। আত্মজ্ঞান ব্যাতিরেকে মুক্তি কোনকালেই আসে না।‘ স্বকীয় কর্মের দ্বারা উপার্জনে চিত্তকে সন্তুষ্ট রাখো – তাঁর এই বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে লালসা ত্যাগ করে এবং দুর্নীতি ত্যাগ করে নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতা অনুসারে কাজ করে অর্জন করো। কারণ কৃপা পেতে গেলে তো করে পেতে হয়।

এমন মহান ধর্মগুরু যিনি জগতে এলেন মাত্র ক্ষনিকের জন্য কিন্তু জগতকে পরিচালন করে চলেছেন অনন্তকাল ধরে অন্তরালে থেকে, শুধুমাত্র তাঁর দর্শন ও ভাবধারাকে অবলম্বন দিয়ে। তাঁর জ্ঞানের অপরিসীম সীমা দেখে ব্যাসদেব যে আশীর্বাদ করেছিলেন তাতেই আমরা তাঁকে ষোল বছরের থেকে বত্রিশ বছর পেয়েছি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত তথা হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে বেড়ান শাস্ত্রযুদ্ধে। কাশ্মীর থেকে বেরিয়ে যখন তিনি আবার কেদারনাথে আসেন আর এই কেদারনাথেই শেষ হয়ে যায় সেই মহান ত্যাগী জন্মসন্ন্যাসীর ইহধামের লীলা। তাঁকে আমাদের প্রণাম।

 

 

Friday 3 November 2023

লোকসংস্কৃতি ও লোকাচারের প্রেক্ষাপটে সুন্দরবন

লোকসংস্কৃতি ও লোকাচারের প্রেক্ষাপটে সুন্দরবন

ভূমিকাঃ

সুন্দরবনের ইতিহাস, ভূগোল বা তার অবস্থানগত বৈচিত্র্য বর্তমানে বহু মানুষের কাছে জ্ঞাত। কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের মাঝে হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে থাকা লোকাচার, লোকসংস্কৃতি বা বিশ্বাস আজও অনেক মানুষের কাছে অজানা। আর যাঁদের কাছে তা জ্ঞাত, তাঁদের অনেকেই আবার এঁদের এই লোকাচারকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধকার মনে করেন যে প্রান্তিক অঞ্চলের আদি বাসিন্দার মাঝে যে সংস্কার বিদ্যমান তা দেশ ও কালের নিরিখে সমকালীন সময়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব অবশ্যই বহন করে থাকে। অনুসন্ধান করলে সেইসকল সংস্কার একসাথে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রচ্ছন্ন আছে সেই শত সহস্র বছরের পুরানো সংস্কৃতির পিছনে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি যা বর্তমান উন্নত সভ্যতার আধুনিক ল্যাবরেটরিতে বসে গবেষকরা অনুধাবন করতে পারেন না। সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতির বিরাট অংশ জুড়ে অবস্থান করে বনবিবি। এই বনবিবি ছাড়াও আরও অনেক দেবদেবীর পূজা ও লোকাচার লক্ষ্য করা যায় স্থান ও অধিবাসীভেদে। লোকসংস্কৃতির এক আঁতুড়ঘর বলা যেতে পারে এই সুন্দরবনকে। আমরা এই প্রবন্ধে দেখে নেব সেই লোকাচার বা সংস্কৃতি।

চব্বিশ পরগণা জেলাদ্বয়ের সুন্দরবনে তথা সমগ্র ভারতীয় সুন্দরবনের সাথে এই বনবিবি দেবীর নাম যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এখানকার লোকায়ত সংস্কৃতিতে এই দেবীর আধিপত্য একচ্ছত্র। শোনা যায় সুদুর আরব থেকে এই দেবীর আগমন। সেই কারনে সুন্দরবনকে ‘আঠারো ভাটির দেশ’ বলা হয়। এরূপ নামকরণের কারন আরব থেকে সুন্দরবনে আসতে গেলে তখন আঠারোটি জোয়ারি নদী পেরিয়ে আসতে হত। বনচারী মানুষের কাছে একমাত্র দেবী হিসাবে আজও পূজিত হন বনবিবি বা বনদুর্গা। বনবিবি জঙ্গলের দেবী। জঙ্গলে আসা দরিদ্র মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আমরা বনবিবির মন্দিরে চোখ রাখলে দেখতে পাই, একদিকে দক্ষিণ রায়, মাঝে বনবিবিসহ শাহ্‌জঙ্গলি ও কোন কোন স্থানে দুখের মূর্তি থাকে।  আমরা আজকের আলোচনায় একে একে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা। দক্ষিণ রায় বা দুখে বা কে? যখন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ বিদ্যমান, সেখানে আঠারো ভাটির দেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই বনবিবির পূজা করতে ব্যস্ত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে যেখানে মূর্তি পূজায় বিশ্বাস নেই, তারাও কেন এই দেবীর পূজায় নিমগ্ন থাকে। কেন মুসলিমের বিবিমাতা হিন্দুর পুজার বিগ্রহ হয়ে উঠল?

প্রাচীন কাল থেকে আমরা দেখে আসছি প্রকৃতির কাছে মানুষ কত অসহায়! ইতিহাসের পাতা ওলটালে মিশরে, রোমে, গ্রিসে, পারস্যে সর্বোপরি আমাদের ভারতবর্ষে জলের দেবতা, বায়ুর দেবতা, আগুনের দেবতা ইত্যাদির অস্তিত্ব বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানুষের কাছে প্রকৃতির অসীম ক্ষমতার কাছে মানুষের মাথানত করার সবথেকে বড় প্রমান। প্রাচীন সভ্যতা বিশারদ সি ই এম জোয়াড বলেন, ‘Early religious ideas might be described as a mixture of fear and cupboard love.’ আদিম মানব মানবী মনে করত প্রকৃতির বিস্ময়কর ও ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশের পিছনে কোন এক অদৃশ্য শক্তি সতত সক্রিয় এবং সময়ের সাথে সাথে সেই একক শক্তি বহু ও বিচিত্র হয়ে ওঠে নিজেদের বিশ্বাস ও রুচির উপর ভর করে। শুধু মিশর, গ্রিস নয় আমাদের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায়ও এই ধরনের দেবদেবীর সন্ধান মেলে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাচীন সভ্যতার ভগ্নাবশেষ এই সত্যের প্রতি বাস্তব ইঙ্গিত করে। গরু, বিড়াল ভারত তথা বাংলার লোকায়ত ধ্যান ধারনায় বিশেষ আসন অধিকার করে আছে। যেমন পঞ্চানন বা শিবের বাহন ষাঁড়, ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল, শীতলার বাহন গাধা, বনবিবির বাহন বাঘ ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালে এই জীবজন্তুগুলিকে মানুষ একদিকে যেমন ভয় পেত, তেমনি বিশ্বাসও করত। শ্রদ্ধা বা ভক্তি এল অনেক পরে। সেই কারনে জোয়াড বলেছেন, ‘Fear, in fact, was still the main spring of religion.’। এইভাবে মানুষ প্রকৃতির সম্পর্ক মহাকাব্য থেকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলিতে দেখে এসেছি।

 

নিয়ন্ত্রণবাদ ও সম্ভাবনাবাদঃ 

ফ্রেডরিক র‍্যাটজেল, এলেন সেম্পেল ও পল ভিদাল দ্য লা ব্লাশ কর্তৃক প্রচারিত যথাক্রমে নিয়ন্ত্রনবাদ বা সম্ভাবনাবাদ কিংবা গ্রিফিথ টেলরের নবনিয়ন্ত্রনবাদ তত্ত্ব বিশ্বের ভূগোল চর্চায় মানুষ প্রকৃতির সম্পর্কের উত্থান পতন লক্ষ্য করা যায়। কেউ পরিবেশগত কঠোর নিয়ন্ত্রবাদের কথা বললেও কেউ আবার মানুষের শিক্ষা, রুচি ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষকে প্রকৃতির থেকে অনেক বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারন সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানের উন্নতির হাত ধরে সভ্যতার বিকাশ ও মানুষের দুর্গম গিরি কান্তার মরু পারাবারের গল্প দিয়ে পরিবেশের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রন তুলে ধরা হলেও প্রকৃতির ক্ষনিকের খামখেয়ালিপনায় দীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের সভ্যতার বিনাশ কিভাবে হয়ে গেছে তা এই মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষী আছে বলেই তাই চরমপন্থা ত্যাগ করে গ্রিফিথ টেলরের নবনিয়ন্ত্রনবাদ মতবাদকে বিজ্ঞানভিত্তিক বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যখন মঙ্গল গ্রহে কিংবা চাঁদে পাড়ি দিয়েছে তখনও পর্যন্ত মানুষের এই অসাধ্য সাধনের পিছনে যে কোন এক অজ্ঞাত শক্তির নিয়ন্ত্রন যে বর্তমান তা সবাই স্বীকার করে। অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার দুরারোগ্য ব্যাধির মুক্তি দিতে প্রবেশ করাটা বিজ্ঞানের অবদান, কিন্তু ছুরি চালনার আগে কোন এক অজানা শক্তির কাছে প্রণাম জানিয়ে নেওয়াটাই হল প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়তার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

মানুষের যতদিন অভাব আছে বা থাকবে ততদিন এই প্রকৃতিকে বিশ্বাস করে কারন তার রুটি রুজি সবই এই প্রকৃতিকে রোমন্থন করে পেয়ে থাকে। সভ্যতার বিকাশের একেবারে প্রাকলগ্নে মানুষ প্রকৃতির সন্তান হিসাবে খেলা করেছে, প্রকৃতির বুকে খেলা করেছে, বিপদে পড়ে প্রকৃতির বুকে নিজের দেবতা তৈরি করে নিয়েছে আবার কালের ক্রমবিবর্তনে এই প্রকৃতির বুকে মানুষ লুটিয়ে পড়েছে। এবিষয়ে এলেন সেম্পেলের কথায়, ‘Man is the product of the earth’s surface. This means not merely that he is a child of the earth,- dust of her dust; but the earth has mothered him, fed him, set to task, directed his thoughts….’ ঠিক তেমনিভাবে পিছনের দিকে তাকালে দেখতে পাই, বৃক্ষপূজা বা বনদেবতা পূজা সারা পৃথিবীতেই কমবেশি প্রচলিত আছে। বিশেষ করে জল জঙ্গলে যাঁদের লড়াই করে জীবনের স্বাদ পেতে হয় অর্থাৎ যে সকল উপজাতি গোষ্ঠী এখনও সভ্যতার উজ্জ্বল আলো থেকে এখনও অনেকটাই দূরে থাকে তাঁরা এই উপাসনার বিশ্বাস আচার বিচারের মধ্যে দিয়ে তাঁদের জীবনচর্চা চলে। মানুষের এই ধরনের আচরণকে ভিদালের ভাষায় জেনরে-ডে-ভি (Genre-de-Vie) বলে।

আদিম মানুষের কাছে দৃশ্যমান প্রকৃতিই প্রানবন্ত। বৃক্ষজীবনে প্রাণ আছেই বলে আদিম মানুষ বৃক্ষকে কেন্দ্র করে রচনা করল দেবপ্রতিমা। এর পূর্বে অবশ্যই বিভিন্ন আচার সংস্কারই ধর্মের ভিত্তি দৃঢ় করেছে। সম্ভবত প্রাকৃতিক বস্তুপুঞ্জের গণ ও ক্রমানুসারে আদিম মানুষ তাঁদের প্রতিরূপ পরিকল্পনা করেছে। শিল্পমাত্রেই প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। জীবজন্তুগুলি আবার প্রাকৃতিক, ভৌতিক শক্তির সঙ্গে আপন ভাবে সমগোত্রীয়তা লাভ করেছে। ঠিক তেমনিভাবেই আজকের এই আলোচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরবে যে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস আর চিরাচরিত সংস্কার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুস্থ ব্যবহারের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমরা দেখতে পাব, বর্তমান রাজনৈতিক জটিলতায় পরিপূর্ণ এই পৃথিবীর সব থেকে বড় অস্ত্র ধর্ম আর সেই ধর্মকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা রাজনীতিতে যখন প্রধান রসদ, তখন প্রত্যন্ত সুন্দরবন বাসীর কাছে এই বনবিবির পূজা বা বিশ্বাস তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম ভুলিয়ে করে তুলেছে এক, সবাই বুঝে নিয়েছে তাঁরা সবাই প্রকৃতি মায়ের সন্তান। তাঁদের ধর্ম এই প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করা। আমরা পাঠকের সামনে সেইসাথে তুলে ধরব সুন্দরবনের এই লোকায়ত সংস্কৃতির কথা। 

চব্বিশ পরগণা জেলাদ্বয়ের সুন্দরবনে তথা সমগ্র বাংলার সুন্দরবনের সাথে এই বনবিবি দেবীর নামে যুগে যুগে আলোচিত হয়ে আসছে। এখানকার লোকায়ত সংস্কৃতিতে এই দেবীর আধিপত্য একচ্ছত্র। শোনা যায় সুদুর আরব থেকে এই দেবীর আগমন। সেই কারনে সুন্দরবনকে ‘আঠারো ভাটির দেশ’ বলা হয়। এরূপ নামকরণের কারন আরব থেকে সুন্দরবনে আসতে গেলে তখন আঠারোটি জোয়ারি নদী পেরিয়ে আসতে হত। বনচারী মানুষের কাছে একমাত্র দেবী হিসাবে আজও পূজিত হন বনবিবি বা বনদুর্গা। বনবিবি জঙ্গলের দেবী। জঙ্গলে আসা দরিদ্র মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। আমরা বনবিবির মন্দিরে চোখ রাখলে দেখতে পাই, একদিকে দক্ষিণ রায়, মাঝে বনবিবিসহ শাহ্‌জঙ্গলি ও কোন কোন স্থানে দুখের মূর্তি থাকে।  আমরা আজকের আলোচনায় একে একে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা। দক্ষিণ রায় বা দুখে বা কে? যখন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ বিদ্যমান, সেখানে আঠারো ভাটির দেশে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই বনবিবির পূজা করতে ব্যস্ত। তাছাড়া ইসলাম ধর্মে যেখানে মূর্তি পূজায় বিশ্বাস নেই, তারাও কেন এই দেবীর পূজায় নিমগ্ন থাকে। কেন মুসলিমের বিবিমাতা হিন্দুর পুজার বিগ্রহ হয়ে উঠল?

 

বনবিবির কাহিনীঃ

প্রথমে জেনে নেব কে এই বনবিবি বা বনদুর্গা? কি তার মহিমা? বনদেবী, বনবিবি, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী আরও অসংখ্য নামে পরিচিত তিনি। হিন্দুদের কাছে তিনি দেবী, মুসলমানদের কাছে পিরানী। তাকে বলা হয় সুন্দরবনের গার্ডিয়ান স্পিরিটবা রক্ষাকারী শক্তি। মৌয়াল বা মধু সংগ্রাহক, কাঠুরে, বাওয়াল, জেলে সম্প্রদায়ের কাছে তিনি পরম আস্থার প্রতীক। সুন্দরবনের ৬০-৪০ ভাগ অংশ যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত, দুই অঞ্চলের মানুষের কাছেই সমান জনপ্রিয় বনবিবি। দক্ষিণবঙ্গের আবহমান সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা বনবিবিকে স্মরণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় মা বনবিবির পূজা

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আরব এক ফকির পরিবারে জন্ম নেন বনবিবি। তার বাবার নাম ইব্রাহীম, মতান্তরে বেরাহিম, মায়ের নাম গুলান বিবি। কথিত আছে, ইব্রাহীমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবির কোনো সন্তান না হওয়ায় চিন্তিত ছিলেন তারা। পরবর্তীতে ফুলবিবির অনুমতি নিয়ে গুলানবিবি মতান্তরে গোলালবিবিকে বিয়ে করেন ইব্রাহীম। তবে শর্ত ছিল, ভবিষ্যতে ফুলবিবির একটি মনোবাসনা অবশ্যই তাকে পূরণ করতে হবে।

গুলানবিবি গর্ভধারণ করলে ফুলবিবি হিংসায় কাতর হয়ে পড়ে। তার সেই জমিয়ে রাখা ইচ্ছে পূরণের শর্ত এবার সে আদায় করে নেয় গুলানবিবিকে সুন্দরবনের জঙ্গলে নির্বাসনে পাঠিয়ে। তার কিছুদিনের মধ্যে সেই জঙ্গলেই গুলানবিবির ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই সন্তান বনবিবি ও শাহ্‌ জঙ্গলি। শাহ জঙ্গলি বনবিবির ছোটভাই নাকি যমজ ভাই, তা নিশ্চিত করে জানা যায় না। তাদের দেখাশোনার জন্য নাকি স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল চার দাসীকে। বনবিবি সেখানে বড় হয় এক মাদী হরিণের কাছে। সাত বছর পর নিজের ভুল বুঝতে পেরে গুলানবিবিকে দুই শিশু সন্তানসহ মক্কাতে ফিরিয়ে নিতে আসেন ইব্রাহীম। কিন্তু বাবার সাথে সুন্দরবন ছেড়ে মক্কায় যেতে অস্বীকৃতি জানায় বনবিবি। সুন্দরবনের মানুষ ও পশুদের সাথে তার এমন হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল যে, তাদের ছেড়ে বাবার হাত থেকে চলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। বোনের টানে বনবিবির সাথেই জঙ্গলে রয়ে যায় শাহ জঙ্গলি।

অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ফুলবিবির যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মক্কা থেকে সুন্দরবনে চলে আসেন ইব্রাহীম-গুলানবিবি দম্পতি। এখানেই জন্ম হয় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দুই ভাইবোনের। এই দুই সন্তানের জন্মের পরে সুন্দরবন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে ইব্রাহীম পরিবার। বনবিবির কেরামতিবা বনবিবির জহুরনামানামক গ্রন্থে বনবিবির এমনি আরও অসংখ্য গল্পের কথা বর্ণিত আছে। বলা হয়, একবার মসজিদে খেলতে গিয়ে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলি খুঁজে পায় দুটি জাদুর টুপিএই জাদুর টুপিতে চেপে তারা ঘুরে বেড়ায় হিন্দুস্তানের আঠারো ভাটির দেশে। অন্য একটি মতানুসারে হযরত জিব্রাঈল (আ.) তাদের আঠারোটি দেশ ঘুরিয়ে দেখান। হিন্দুস্তানে পৌঁছে আযান দেন শাহ জঙ্গলি।

প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী দেবী বনবিবির একমাত্র চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ রায় নামে এক ব্রাহ্মন মুনি যিনি এই গভীর জঙ্গলে বসবাস করেন এবং ক্রোধবশতঃ তিনি মানুষ খেতে ইচ্ছা করেন। সেইসুত্রে তিনি বাঘের ছদ্মবেশ ধারন করে বনে ঘুরে বেড়ান যাতে জঙ্গলের কোন সম্পদ মানুষ না নিয়ে যেতে পারে। আর কেউ যদি লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তাকে দক্ষিণ রায় তার জীবনকে কর হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। মতান্তরে, এই দক্ষিণ রায় ছিলেন একজন বিখ্যাত জমিদার যিনি এই আঠারো ভাটির দেশের সমগ্র ম্যানগ্রোভ সাম্রাজ্যসহ সকল সম্পত্তির মালিক আর এই বনের সকল বাঘ তার প্রজা। অহংকারে জমিদার মানুষখেকো রাক্ষসে পরিণত হয় এবং বাঘের আক্রমণে মানুষের মাঝে দক্ষিণ রায় এক সন্ত্রাস হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে।

অসহায় মানুষের আর্তনাদে আল্লাহ্‌ এই নৈরাজ্য ঠেকাতে এক বনবাসী তরুণী কন্যাকে বনের কর্তৃত্ব প্রদান করে তাকে বনবিবি করেন। প্রকৃতপক্ষে এই বনবিবি এবং তার যমজ ভাই শাহ জঙ্গলি শিশুকালে তার পিতামাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয় বনের মধ্যে এবং এক হরিণ তাকে লালন পালন করছিল। একটা বিষয় লক্ষণীয়, দুজনের নামের সাথে প্রকৃতি (বন ও জঙ্গল) জড়িয়ে আছে। আল্লাহ্‌ এর স্বপ্নাদেশে দুই ভাইবোন মা ফতিমার আশীর্বাদ নিতে মদিনায় গমন করে। সেখান থেকে মক্কায় গিয়ে এই সুন্দরবনের জন্য পবিত্র মাটি নিয়ে ফিরে আসে।    
       
বনবিবি ও শাহাজঙ্গুলি যখন সুন্দরবন সংলগ্ন আঠারো ভাটির দেশে পৌঁছান, তখন সেখানকার রাজা ছিল নিষ্ঠুরতার প্রতীক দক্ষিণ রায় বা রায়মণি। শাহ জঙ্গলির সেই আযানের ধ্বনি কানে যায় দক্ষিণ রায়ের। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বন্ধু সনাতন রায়কে পাঠায় রাজা। সনাতন এসে দুই ভাইবোনের কথা জানালে দক্ষিণ রায় আল্লাহ্‌ র উপর খেপে গিয়ে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলিকে তাড়িয়ে দেবে বলে ঠিক করল। থামালেন তার মা নারায়নী দেবী। তিনি বললেন, একজন মহিলার সাথে একজন পুরুষের যুদ্ধ করা শোভা পায় না নারায়নীর সাথে বনবিবি আর শাহ্‌ জঙ্গলির সাথে দক্ষিণ রায়ের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। দক্ষিণ রায় নিজে যুদ্ধের ময়দানে যেতে চাইলে তার মা নারায়ণী তাকে থামিয়ে দেয়। নারায়ণী নিজের সৈন্যসামন্ত নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। বনবিবি আর শাহ জঙ্গলির সাথে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা, কাজেই দীর্ঘযুদ্ধের পরে হার মানতে বাধ্য হয় নারায়ণী ও তার বাহিনী। তবে দয়াপরবশ হয়ে বনবিবি তার অর্জিত সাম্রাজ্যের অর্ধেকটা দান করে নারায়ণী ও তার পুত্রকে। নারায়ণীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে সুন্দরবন অঞ্চলের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয় বনবিবি, দক্ষিণ রায় রাজত্ব করে জঙ্গলের গহীন কোণে। মাতা বনবিবি জঙ্গলের নৈরাজ্য বিনাশ করে তৃপ্ত হন। কোন কোন স্থানে এই বনবিবির পাশাপাশি তার সই নারায়ণী দেবীর পুজাও হয়ে থাকে।  

এদিকে দক্ষিণ রায়ের শান্তি নেই মনে। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে মরে। এমতাবস্থায়, গ্রামের দরিদ্র দুখে তার বাবা মায়ের সাথে বসবাস করত। তার বাবা একদিন মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। সেই থেকে দুখের মা আর তাকে কোথাও যেতে দেয় না। সবসময় যেন চোখে হারায়, কিন্তু দুখে মনখারাপ করে ঘুরে বেড়ায়। তার বাসনা জাগে, সেও নৌকায় চড়ে ঐ দূরে মাছ ধরতে যাবে, কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যাবে। কিন্তু তার মা তাকে ছাড়তে চায় না। তাই দুখে বায়না করলেও তার মায়ের ভয়ে তাকে কেউ নিয়েও যায় না। মা বনবিবির কথার মাঝে ‘দুখে’র কথা এসে যায়। এই ‘দুখে’ আর কেউ না, তিনি দুঃখের প্রতীক মাত্র। বাঘ যখন দক্ষিণ রায় এর মতো অহংকারী জমিদার এর প্রতিরূপ, দুখে সেখানে সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি। দুখের পালা শুনলে আমরা এ বিষয়ে বিশদ জানতে পারি। যাইহোক, এই দুখে এক কিশোর ছেলে, সুন্দরবনের প্রান্তিক গ্রামে তার বিধবা মাতার সঙ্গে কষ্ট করে দিনযাপন করছিল।

একদিন তার দূর সম্পর্কের কাকা ধোনা (এখানে ‘ধোনা’ কে ধনসম্পদের প্রতীক হিসাবে মানা হয়) তাকে জঙ্গলে গিয়ে মধুসংগ্রহের লোভ দেখায়। তখন মায়ের কান্না ও নিষেধ উপেক্ষা করে দুখে তাদের সাথে চলে। কিন্তু দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। একদিন রাত্রে ধোনা যখন নিদ্রার কারনে একটি দ্বীপে নামে তখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা দক্ষিণ রায় তার সাথে দেখা করে বলে যদি সে প্রচুর মধু পেতে চায় তাহলে দুখে কে তার হাতে সমর্পণ করে। তাহলে সে এক নৌকা ভর্তি মধুর ঠিকানা পেয়ে যাবে। প্রথম দিকে রাজি না হলেও পরে ভয়ে ও লোভে পড়ে তাতেই রাজী হয়ে যায়। দক্ষিণ রায় আরও হুমকি দেয় যদি সে তার কথা না রাখে নৌকাসহ সবাইকে জলে ডুবিয়ে মারবে। এই কথা দুখে সব শুনতে পেয়ে তার মায়ের জন্য কাঁদতে থাকে। কথামত, মধু সংগ্রহ করে ধোনা দুখে কে নিয়ে গিয়ে সুন্দরবনের গভীরে কেঁদোখালি দ্বীপে ছেড়ে আসবে, যেখানে দক্ষিণ রায়ের প্রবল অত্যাচার থেকে কেউ রক্ষা পায় না। দুখে গভীর জঙ্গলে যখন বাঘের আক্রমণের কথা ভেবে উপায়ান্তর না দেখে মায়ের কথা ভাবতে থাকে। মনে পড়ে যায় মা তাকে বলেছিল, জঙ্গলে বিপদে পড়লে মা বনবিবিকে স্মরণ করলে তিনিই রক্ষা করেন। দুখে চিৎকার কর কাঁদতে কাঁদতে মনপ্রাণ দিয়ে মা বনবিবিকে একাত্মভাবে স্মরণ করে। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মা বনবিবি হাজির হয়ে তাকে আশ্বাস দেন যে, ভয় নেই দুখে, আমি রক্ষা করব তোকে। তুই এগিয়ে যা

পরের দিন সকালে ধোনা সবাইকে বলে যে আমাদের আবার কেঁদোখালি দ্বীপে যেতে হবে যেখানে ইতিপূর্বে গিয়ে কিছু পাওয়া যায় নি। তাই ধোনার লোকেরাও যেতে চাইল না। তখন ধোনা আর দক্ষিণ রায়ের মধ্যে যা কথা হয়েছে সব শোনায় ধোনা। প্রথমে রাজি না হলেও ভয়ে দুখের প্রতি ভালোবাসা উবে গেল। নৌকা এগোচ্ছে। দক্ষিণ রায় নৌকাকে অনুসরণ করতে করতে মৌমাছিকে নির্দেশ দেয় যে কেঁদোখালি দ্বীপের সকল গাছে মৌচাক ভরে দিতে। সেইমত ধোনা গিয়ে দেখে অবাক। মনের আনন্দে নৌকার সকল জার মধুতে ভর্তি করে নিল। দক্ষিণ রায় তার প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দিল আর বলল তোমাদের এই মধু ও চাক থেকে মোম আলাদা করলে বেশী টাকায় বিক্রি হবে। কথিত আছে এইভাবে চাক থেকে মোমকে আলাদা করার শিক্ষা মানুষ শিখেছিল। নৌকা ছাপিয়ে মধু দ্বীপের চারদিকের জলে পড়তে লাগলো। আজও এই দ্বীপের নিকটের জল মধুপানি বা মিষ্টি জল নামে পরিচিত। আনন্দে ভাসতে ভাসতে লোকেরা দুখে কে পাঠাল জঙ্গল থেকে রান্নার শুকনো জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসতে। মন না চাইলেও দুখে গভীর বনে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ধোনা লোকজন নিয়ে নৌকা নিয়ে স্থানত্যাগ করল।

ঠিক এমন সময়ের জন্য দক্ষিণ রায় অপেক্ষা করছিল সারাদিন। দুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খেতে উদ্যত হতে দুখে মিনতি জানায় আর বনবিবিকে স্মরণ করে। মাতা বনবিবি তার ক্রন্দনে এসে হাজির হয় ভাই শাহ্‌ জঙ্গলিকে নিয়ে। মাতা বনবিবি দক্ষিণ রায়কে হত্যা করতে ভাইকে নির্দেশ দিয়ে তার কবল থেকে দুখে কে মুক্ত করে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়। এমতাবস্থায়, দক্ষিণ রায় পালিয়ে তার বন্ধু গাজীর কাছে আশ্রয় নিয়ে পরামর্শ চায়। গাজী তাকে মা বনবিবির কাছে ক্ষমাভিক্ষা চাইতে বলায় দক্ষিণ রায় বনবিবির কাছে জীবন ভিক্ষা করে। সবার কাছে তিনি গাজী পীর নামেই খ্যাত। শেষ পর্যন্ত গাজী পীর গিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বনবিবির কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে তারা নিষ্ঠুর রাজার কোনো ক্ষতি করবে না। বিনিময়ে গাজী দুখেকে সাত নৌকাভর্তি মূল্যবান সব ধন-রত্ন উপহার দেন। বনবিবির পোষা কুমির সেকোর পিঠে চড়ে গ্রামে ফিরে যায় দুখে। মা তার অসীম করুণায় দক্ষিণ রায়কে নিজ পুত্রগুনে ক্ষমা করে দেন এই শর্তে যে এখন থেকে জঙ্গলের মানুষসহ সকল প্রাণীকে ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখতে হবে আর বনের সকল সম্পদে সবার সমান অধিকার থাকবে।

মায়ের ভক্তরা সবাই বিশ্বাস করেন যে, প্রয়োজনের তুলনায় সম্পদ সংগ্রহ করে অপচয় বা সঞ্চয় করলে মা বনবিবি বিপদে তাঁদের রক্ষা করেন না। নিজ গ্রামে এসে বনবিবির এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করে দুখে। তার কথায় অভিভূত হয়ে সে গ্রাম তো বটেই, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতেও শুরু হয়ে যায় বনবিবির উপাসনা। ধোনা তার ভুল বুঝতে পেরে মেয়ে চম্পার সাথে দুখের বিয়ে দেয় এবং দুখেকে গ্রামের চৌধুরী বা প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ ই জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা। খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, গোসবাতে বেশ কিছু অঞ্চলে ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

সাধারণত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ডাকে মা সাড়া দেন যদি বনবিবি জহুরনামা শুরু ও শেষের দিকে খানিকটা পাঠ করেন ভক্তিভরে। বাউলির পরামর্শ ছাড়া কেউ জঙ্গলে প্রবেশ করেন না। এই বাউলি হল বাঘজাদুকর যাঁদের কথা বাঘ নাকি শোনে। প্রকৃতপক্ষে এই বাউলি শব্দটি আরবির সুফি সাধুদের বোঝায় যারা মুলত ষষ্ঠদশ শতকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল উদ্ধার ও ইসলাম ধর্মের প্রচারের কাজে সহায়তা করেন। বর্তমানে বাউলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও দেখা যায়। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজও এই বাউলি বা ইসলামের বিভিন্ন তুকতাক বনচারী মানুষের খুব কাজে লাগে। স্বভাবে এরা খুব বিনয়ী ও ভদ্র, জঙ্গলে যারা কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যায় তাঁদের প্রতি এরা খুবই দরদী। জঙ্গলের জন্ম প্রকৃতির সাথে মানুষের সাম্যতা আনার জন্য। তাই সুন্দরবনের বনবিবির মন্দিরগুলিতে কোন দরজা প্রায় নেই বললেই চলে। তা সবার জন্য উন্মুক্ত। বাঘেদের এলাকায় ঢোকার আগে যাতে তারা বনবিবির পূজা দিতে পারে, সেজন্য দেবীর মন্দিরগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা আছে।

সুন্দরবন বাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে, তাহলে তাকে মা বনবিবি তাকে শাস্তি দিয়ে থাকে, কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা তাকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে, তার আড়ালে কোন কিছুই করা যায় না। জনৈক বিধবা ফুলমাসির কথায়, এই তো বছর দশেক আগে একদল কাঠুরিয়াকে সাপের ছোবলে মরতে হল, কারন ওরা জঙ্গলের নিয়ম লঙ্ঘন করে দূষিত করছিল। আবার যাত্রাভিনেতা সামসুদ্দিনের কথায়, আমরা যদি জাতপাত নিয়ে রাজনীতি করি তাহলে মায়ের কৃপা থেকে সবাই বঞ্চিত হব। মায়ের কাছে সবাই সন্তান, কোন ভেদাভেদ নয়, সবাই একজাতি। একসাথে পূজা করলে পরে মায়ের সুখ, শান্তি। আরও জানা যায় মা বনবিবি কারোর লোভকে প্রশ্রয় দেন না। যদি কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে চাহিদার তুলনায় বেশী সম্পদ সংগ্রহ করে চিরাচরিত নিয়মানুসারে মা তাদেরকে শাস্তি দেন।

বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের আপনার জন। তিনি আর সুন্দরবন ছেড়ে কোনকালেই যাবেন, এমনকি তার পিতা ইব্রাহিম তার পরিত্যক্ত মাতাকে নিয়ে যেতে এলেও না। কারন জঙ্গলের এই কঠিন জীবন ছেড়ে পিতার হাত ধরে মাতা গুলাব বিবি আগের জীবনে ফিরে গেলেও বনবিবি যান নি এই বনবাসী মানুষের স্বার্থে। আল্লাহ্‌ তাকে পাঠিয়েছেন অশুভ শক্তির হাত থেকে আর্তকে রক্ষা করার জন্য।

সামাজিক প্রেক্ষাপটঃ

সেই থেকে অদ্যাবধি দেবীর মর্যাদায় সুন্দরবনের মানুষের কাছে সমাদৃত হয়ে আসছেন বনবিবি। প্রতিবছর বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা মাঘ, ইংরেজি ১৬ ই জানুয়ারি সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বসে বনবিবির মেলা, পালিত হয় বনবিবির পূজা। খ্রিস্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ পশ্চিমবঙ্গের বাসন্তী, গোসবাতে বেশ কিছু অঞ্চলে ঘটা করে বনবিবির পূজা করা হয়। এটি আমাদের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশে পরিণত হয়েছে।

সাধারণত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ডাকে মা সাড়া দেন যদি বনবিবি জহুরনামা শুরু ও শেষের দিকে খানিকটা পাঠ করেন ভক্তিভরে। বাউলির পরামর্শ ছাড়া কেউ জঙ্গলে প্রবেশ করেন না। এই বাউলি হল বাঘজাদুকর যাঁদের কথা বাঘ নাকি শোনে। প্রকৃতপক্ষে এই বাউলি শব্দটি আরবির সুফি সাধুদের বোঝায় যারা মুলত ষষ্ঠদশ শতকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল উদ্ধার ও ইসলাম ধর্মের প্রচারের কাজে সহায়তা করেন। বর্তমানে বাউলি হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যেও দেখা যায়। সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে আজও এই বাউলি বা ইসলামের বিভিন্ন তুকতাক বনচারী মানুষের খুব কাজে লাগে। স্বভাবে এরা খুব বিনয়ী ও ভদ্র, জঙ্গলে যারা কাঠ ও মধু সংগ্রহ করতে যায় তাঁদের প্রতি এরা খুবই দরদী। জঙ্গলের জন্ম প্রকৃতির সাথে মানুষের সাম্যতা আনার জন্য। তাই সুন্দরবনের বনবিবির মন্দিরগুলিতে কোন দরজা প্রায় নেই বললেই চলে। তা সবার জন্য উন্মুক্ত। বাঘেদের এলাকায় ঢোকার আগে যাতে তারা বনবিবির পূজা দিতে পারে, সেজন্য দেবীর মন্দিরগুলি বিশেষ বিশেষ জায়গায় স্থাপন করা আছে।

সুন্দরবনবাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে তাহলে তাঁকে মা বনবিবি শাস্তি দিয়ে থাকে কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা তাঁকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে। জনৈক ব্যক্তির কথায় আমরা সবাই মায়ের সন্তান, আমাদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই, জাতপাত নিয়ে যদি আমরা রাজনীতি করি তাহলে মায়ের কৃপা থেকে বঞ্চিত হব। মায়ের কাছে সবাই শান্তি কামনা করে। মা বনবিবি কারুর লোভকে প্রশ্রয় দেন না। যদি কেউ লোভের বশবর্তী হয়ে বেশী সম্পদ সংগ্রহ করে থাকে তাহলে চিরাচরিত নিয়মানুসারে মা তাঁকে শাস্তি দেন। বনবিবি সুন্দরবনের মানুষের আপনার জন। তিনি আর সুন্দরবন ছেড়ে কোনকালেই যাবেন না, এমনকি তার পিতা ইব্রাহিম তার পরিত্যক্ত মাতাকে নিয়ে যেতে এলেও না। কারন জঙ্গলের এই কঠিন জীবন ছেড়ে পিতার হাত ধরে মাতা গুলাব বিবি আগের জীবনে ফিরে গেলেও বনবিবি যান নি এই বনবাসী মানুষের স্বার্থে। আল্লাহ্‌ তাকে পাঠিয়েছেন অশুভ শক্তির হাত থেকে আর্তকে রক্ষা করার জন্য।

 

অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটঃ

World Commission on Environment and Development এর কথায় "Sustainable development is development that meets the needs of the present, without compromising the ability of future generations to meet their own needs." সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ এই ক্ষেত্র ধীরে ধীরে মানুষের করালগ্রাসের হাতছানিকে উপেক্ষা করে যেটুকু আজও দাঁড়িয়ে আছে তা এই বনবিবির মাহাত্ম্য ও তাঁর প্রতি স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ও ভয় থেকে। কারন প্রকৃতির এই সম্পদ আর্তের চাহিদার জন্য, দুঃস্থের সুস্থতায় ব্যবহারের জন্য। প্রকৃতির সেই অপার করুণা কোনভাবে যেন মানুষের লোভানলে পুড়ে না নষ্ট হয়ে যায় তার জন্য বনবিবির এত নিষ্ঠুর অনুশাসন। সুন্দরবনবাসীর বিশ্বাস যদি কেউ জঙ্গলের আইন না মানে তাহলে তাঁকে মা বনবিবি শাস্তি দিয়ে থাকে কিংবা বনের মাঝে সাপ কিংবা বাঘের হাত থেকে মা তাঁকে রক্ষা করেন না। কারন জঙ্গলে যা কিছু হয়ে থাকে সবই তার গোচরে থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় কেউ যদি সম্পদ আহরণ করে থাকে বনবিবি তাঁকে শাস্তি প্রদান করে থাকে। মহাত্মা গান্ধীর কথায়, “The world has enough for everyone's need, but not enough for everyone's greed.” এই তত্ত্ব যদি আমরা মনে প্রাণে মেনে চলি তাহলে এই বিশ্বচরাচরে যত সম্পদ আছে তা মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বলে প্রকাশ পাবে

অন্যান্য লোকদেবতাঃ

সুন্দরবনের বনবিবির পাশাপাশি দক্ষিণ রায় বা দক্ষিণেশ্বর কে পূজা করতে সুন্দরবনের বেশ কিছু অঞ্চলে লক্ষ্য করা গেছে। সুন্দরবনের ধপধপি অঞ্চলে এই দেবতার বিরাট এক মন্দির আছে যেখানে প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার স্থানীয় মানুষসহ দূর থেকে ভক্তরা আসেন মানত করতে। ভর ধরে মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানের রাস্তা খোঁজেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন আবার অনেকেই করেন না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ এই যন্ত্রসভ্যতার সাথে থেকে থেকে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েন, কিংবা সকল চেষ্টা বিফলে চলে যায়, আপনজন বিয়োগের সম্ভাবনা প্রবল হয় তখন মানুষ সেই অন্তরালে থাকা তৃতীয় শক্তির কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ায় শ্রেয় মনে করেন। এই সকল লোকাচারের স্থান ও কাল বিন্যাস করলে বোঝা যায় সেদিনের সুন্দরবন আজকের সুন্দরবনের মত না। আবার আজকের সুন্দরবন কলকাতার মত এত ভালো পরিষেবাযুক্ত না। তাই মানুষ প্রকৃতির সাথে থাকতে থাকতে প্রকৃতির নিয়মই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছেন।

সুন্দরবনের লোকাচার ও লোকসংস্কৃতিতে বনবিবি অনেকটা জায়গা নিলেও সুন্দরবনের আরও অনেক দেবদেবী বা সংস্কারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোকাচার বর্তমান যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা দুরূহ। প্রসঙ্গক্রমে এই প্রবন্ধে কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। সুন্দরবনের পাঁচুঠাকুর বা পঞ্চানন লোকসংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ। বিশেষ করে ছোট শিশুদের মঙ্গল কামনায় সুন্দরবনের মানুষ এই পাঁচুঠাকুর বা পঞ্চাননের পূজা করে থাকে। পঞ্চানন শিবের অপর এক রূপ। কেউ বা বলে থাকে শিবের ছেলে পঞ্চানন জাত গোত্র বিচারে স্বর্গে স্থান না পেয়ে মর্ত্যে অবস্থান করছেন। যেমন রাগী তেমন শান্ত প্রকৃতির। এই পাঁচু পাঁচির মন্দিরে সন্তানের মঙ্গল কামনায় অনেকে মানত করে ঢেলা বেঁধে দেন।

বনবিবির পাশাপাশি ওলাবিবি সুন্দরবনের অন্যতম লোকদেবী। সাতবিবিদের মধ্যে অন্যতম এই দেবীর কৃপায় জলবাহিত রোগ তথা কলেরা, ওলাওঠা রোগের অধিনিয়ন্ত্রক হলেন এই দেবী। অনিয়ন্ত্রিত পায়খানাকে ওলা বা নামা বলে আর মাত্রাছাড়া বমনক্রিয়া ওঠা বলে মনে করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে আজও সুন্দরবনের জল, জঙ্গল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রিসেবার অভাবে এই ধরণের সমস্যার মধ্যে স্থানীয় মানুষ প্রায়শই ভুগতেন। তখন তাঁরা এই দেবীর স্মরণাপন্ন হয়ে কেউ কেউ মুক্তি পেতেন। সেই বিশ্বাসে ওলাবিবি লোকদেবী হিসেবে পূজা পান। হিন্দু দেবী ওলাইচণ্ডীর গুণগুলো রপ্ত করে তিনিও জনমানসে সমান গুরুত্ব পেতে থাকেন।

এছাড়াও ফুলবিবির আরাধনা হয় গৃহশান্তি, বাধাবিঘ্ন, রোগারোগ্য ও মানসিক প্রশান্তি প্রাপ্তির আশায়। তিনি সাতবিবির প্রধানা ওলাবিবির সহচরী বলে মনে করা হয়। ফুলবিবি মানুষ প্রকৃতির পাশাপাশি সহাবস্থান সমর্থন করেন এবং বিশেষ এক ঐশী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে লোকদেবতার স্থান পেয়েছেন।

ওলাবিবির আর এক সখী ঝেটুনেবিবি। মানুষ যখন কোন কালান্তক রোগে আক্রান্ত হয়ে একেবারে সকল আশা ছেড়ে সময়ের হাতে ছেড়ে দেন, তখন এই দেবীর কৃপায় সেই রোগী আরোগ্য লাভ করেন বলে প্রচলিত। নানা কেরামতি, জাদুক্ষমতায় ও ওষধিবিদ্যায় পারদর্শী এই মুসলিম সুফি সাধিকা। বাত ও ধনুষ্টঙ্কার রোগের পরিত্রাতা হিসাবে তিনি পূজিত সুন্দরবনের লোকালয়ে। দেবী শীতলা যেমন বসন্ত রোগের আরোগ্য প্রদায়িনী হিন্দু দেবী, তিনিও তেমন অনেক গুরুতর রোগ থেকে মুক্তি প্রদান করে লোকদেবী হিসাবে পূজিত হন।

হাম, বসন্ত, ওলাওঠার মতো বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিতে বাংলার প্রান্তিক অঞ্চল উজাড় হয়ে যেত। সুন্দরবনের ঘরে ঘরে এই সমস্যা সাম্প্রতিক অতীত কাল পর্যন্ত দেখা যেত। সেই রোগের কারণে মৃত্যুর মড়ক লেগে যেত গ্রামের পর গ্রাম। সেই সমস্যা নিরসন করতে গ্রামের মাঝে আর এক বিবির পূজা হত। তিনি হলেন মড়িবিবি। দেবী চণ্ডী ও শীতলার মতো এই দেবীও জনমানসে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইসলাম সাধিকা এই দেবী মরণাপন্ন রোগীর পরিত্রাতা হওয়ায় মড়িবিবি নামে পরিচিত হন।

অতীত সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভয়াবহতা মানুষকে প্রাকৃতিক, আদিদৈবিক, ভৌতিক কিংবা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে মানুষ আশঙ্কা ও আতঙ্ক নিয়ে দিনযাপন করতেন। জীবনযুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করে কিংবা আশাহত হয়ে একটা সময়ের পর তাঁরা মনে করতেন এসকল দৈবী কোপ। কল্পিত এই ভয় ও আতঙ্ক থেকে জন্ম নিত নানান শারীরিক ও মানসিক রোগ। এই সকল সমস্যা নিরসন করতে সুন্দরবনের মানুষের ভরসা ছিল আজগৈবিবি।

এরপর যে বিবির কথা বলতে হয় তা হল ঝোলাবিবি। সাধারণত কঠিন পেটের রোগ বা রক্ত আমাশয়ে ভুগতে ভুগতে রুগীর একান্ত কাহিল অবস্থাকে বলা হয় ঝোলা। আন্ত্রিকের কারণে শরীরে জলশুন্য হয়ে কিংবা কোন মারনরোগে শয্যাশায়ী অবস্থান থেকে যে বিবি উদ্ধার করেন তিনিই ঝোলাবিবি। তিনি অন্যান্য বিবির মত সুন্দরবনের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলমানের কাছে স্তুপ বা মূর্তি রূপে পূজিত হন।

সুন্দরবনের জল, জঙ্গল, নদী-নালা অধ্যুষিত শ্বাপদসঙ্কুল বাদাবনের নৌজীবী, বাউলে, মৌলে, মাঝিমাল্লা, জেলে, বনজীবি, কাঠুরিয়া বা কাঁকড়ামারাদের কাছে আশার আলো হল আসানবিবি। নদীপথে কিংবা জঙ্গলে যে কোন বিপদে তাঁর ভক্তরা তাঁকে স্মরণ করলে তিনি তাঁদের রক্ষা করেন বলে লোকবিশ্বাস। এমনকি শ্রমজীবী ও গরীব চাষিদের কাছেও তিনি মুশকিল আসান। তাই তো তিনি আসানবিবি।

এছাড়াও হাড়িঝি, চণ্ডী, শীতলা, মনসার অবস্থান সুন্দরবনের লোকবিশ্বাসে বেশ পোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন। সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়া কিংবা সাপের কামড়ে মৃত ব্যক্তির প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্যে যেমন মনসার পূজা হয় তেমন হাম, বসন্ত থেকে রক্ষা পেতে শীতলা পূজা সুন্দরবনের লোকবিশ্বাসে আজও গেঁথে আছে। এখনও অনেক জায়গায় রাতের পর রাত জেগে চলে শীতলা, মনসা ও বনবিবির পাঁচালি গান কিংবা দুখের বনবাস, সতী বেহুলা বা শীতলা মায়ের কৃপা যাত্রা পালা সুন্দরবনসহ দুই চব্বিশ পরগণার লোকসংস্কৃতিতে জায়গা দখল করে আছে।

সুন্দরবনের জনজীবনে মা ষষ্ঠীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সমাজ সভ্যতা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে দরকার উৎপাদন। সে খাদ্য হোক আর সন্তান হোক। সেই উৎপাদনের দেবী হলেন এই ষষ্ঠী দেবী। তাঁর কৃপায় সন্তানধারণ বা সন্তানের মাঙ্গলিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুন্দরবনের ঘরে ঘরে সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে ষষ্ঠী দেবীর পূজা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

এছাড়াও নারায়ণী, বারা ঠাকুর, মাকাল ঠাকুর, ধর্ম ঠাকুর, পঞ্চানন্দ, আটেশ্বর, পীর গোরাচাঁদ, গাজী সাহেব, কালু রায়, সত্যপীর, বসন্তরায়, ঘণ্টাকর্ণ, মানিকপীরসহ সারাবছর নানা তিথিতে নানান লোকদেবতার পূজা করার বিধান লক্ষ্যনীয়। আবার সুন্দরবনের বিভিন্ন উপজাতি বা আদিবাসীগোষ্ঠীদের মধ্যে একটা নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকাচার বা বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।  

পর্যালোচনাঃ

আজকের আলোচিত এই সুন্দরবন, দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার দক্ষিণের বৃহত্তর অংশ। এই চব্বিশ পরগণা জেলা একদা রাজ্যের বৃহত্তম জেলা হিসাবে পরিগণিত হত। ১৯৮৬ সালের ১ লা মার্চ এই অবিভক্ত জেলা উত্তর দক্ষিণে বিভাজন হয়ে গেলেও জেলার সংস্কৃতির বিভাজন আজও করা যায় নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আজকের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার আয়তন পর্যালোচনা করে দেখলে সেটাও কম নয়। তার আয়তন ও বিস্তার বিচার করে বেশ কয়েকবছর ধরে এই জেলা থেকে সুন্দরবন অঞ্চলকে পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করার দাবী বর্তমান। আয়তন ও বিস্তার যত বেশী হয় ততই ভিন্ন জনজাতির সংস্কৃতিও ভিন্ন হয়ে থাকে। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এই জেলার লোকসংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি দুটো পাশাপাশি তুলে ধরতে হয়। কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিসরে সেটা সম্ভব নয়।

এই জেলা তথা সুন্দরবনের ভৌগলিক অবস্থান ও বিস্তার এই জেলার সংস্কৃতিতে মিশ্র সংস্কৃতির ভাবান্তর ঘটেছে। জেলার উত্তরে রয়েছে কলকাতা শহর যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে বাড়তে বৃহত্তর কলকাতা হিসাবে জেলার উত্তরের অংশে প্রভাব ফেলেছে। এই সকল স্থানে নিজস্ব সংস্কৃতি (যা জন্মসূত্রে প্রাপ্ত) যেমন থাকে তেমন আধুনিকতার ছোঁয়ায় শহুরে সংস্কৃতিতে খাপ খাইয়ে নেবার এক লড়াই থাকে এবং সেই শহুরে সংস্কৃতি রপ্ত করতে পারলে এই স্থানের মানুষ ফেলে আসা সংস্কৃতি অর্থাৎ জেলার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি এক নাক সিটকানো অনুভূতি দিয়ে থাকেন। আবার জেলার দক্ষিণ প্রান্তে ও সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের মাঝে প্রথিত রয়েছে আদি সংস্কৃতি। একটু শিক্ষা ও আধুনিক সভ্যতার আলো পেলে এই সংস্কৃতি থেকে মানুষের মুখ ঘুরিয়ে উচ্চ কোটির সংস্কৃতি গা ভাসিয়ে নিজেকে জাতে তোলার অসীম লড়াই চলে। দক্ষিণের মানুষের এই প্রবণতা এক ধরণের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। নিজে জেলার মানুষ হয়েও তুলনামূলক দক্ষিণভাগের বাসিন্দাকে হেয় করতে দোখনো বলতে অভ্যস্ত।

যাইহোক, এই সুন্দরবনের সংস্কৃতি তথা এই বৃহৎ জেলার সংস্কৃতি অনেকটাই ধর্ম আর পূজা বা মেলার সাথে জড়িয়ে। মহাভারতের সময় থেকে এই ভূভাগকে ম্লেচ্ছদের দেশ বলা হয়ে থাকলেও গঙ্গাসাগরের পুণ্যতীর্থ আর জেলাজুড়ে মহাপ্রভুর চরণস্পর্শে জেলার ভাবধারা বদলে গেছে। বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণের মতো মানুষ ও তার সামাজিক সংস্কার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদ্যমান। হয়তো অনেকাংশেই তা বাংলার অনেক জেলার সাথে মিলে যায়। যেমন বছর শুরু হয় পয়লা বৈশাখ বা গোষ্ঠমেলা দিয়ে। সেদিন কাকভোরে উঠে চাষের জমিতে আগুন দেওয়া, পবিত্রমনে পূজা করা এবং অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু ভালো খাওয়ার আয়োজন করা, আত্মীয়দের মধ্যে নতুন পোশাক উপহার পাঠাবার বিধান বর্তমান। কারণ, জেলার মানুষের মননে চিন্তনে একটা বিশ্বাস কাজ করে যে এই দিন যে যেমন কাজ করবে বছরের বাকিটা সময় তার তেমনভাবে চলবে। চাষের জমিতে আগুন দেবার সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা যাযাবর জাতির ঝুম চাষের সংস্কৃতিকে মনে করালেও কিছুটা বিজ্ঞানের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। তবে সেইপ্রকার আগুন দেখা যায় না। কেবল লোকসংস্কার রক্ষার্থে চলে। তেমনভাবে এই মাসে অক্ষয়তৃতীয়ার ব্রত পালনের মধ্যে দিয়ে মনে করা হয় ভগবানের কৃপায় সব অক্ষয় থাকে।

আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার দিন থেকে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কলমিশাক আর পটল খাবার বিধান নেই। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য যে ঐসময় ভগবান জগন্নাথ পটলের বালিশে মাথা দিয়ে কলমিশাকের বিছানায় শুয়ে থাকেন। এর পিছনে অন্য কোন পরাবৈদিক কারণ থাকতেও পারে। অম্বুবাচী চলাকালীন মাঠে কোনরূপ কোদাল, লাঙ্গল চালানোর বিধান নেই যেমন তেমন বিগ্রহের মুখ দর্শন করা যাবে না। এভাবেই অন্যান্য মাসের পূজা সংস্কার বঙ্গের অন্য জেলার মতই চলে তবে কার্তিক পূজা নিয়ে দারুণ মাতামাতি চলে। বিবাহিত কিন্তু অপুত্রক পরিবারে লুকিয়ে কার্তিক দেবার বিধান আছে। এতে নাকি সেই পরিবারে অতি শীঘ্রই সন্তানের আগমন ঘটে। সময়ের সাথে সাথে এই সংস্কারে নবদম্পতিরা বিরক্ত হয়ে অশান্তি পর্যন্ত হতে দেখা যায়।

এইসময় দশহরা পূজা বা সর্প দংশন থেকে রক্ষা পেতে বাড়িতে বাড়িতে একটা সময় হাঁসা বলি দিয়ে মনসার পূজা করা হত। এখন জেলার এই সংস্কৃতি বাসন্তীসহ সুন্দরবনের কয়েকটা ব্লকে সীমিত হয়ে গেছে। সর্পদংশন ও মৃতরোগীর বাঁচানোর জন্য যে মন্ত্র সংস্কার তা দক্ষিণ বঙ্গের সংস্কৃতির বড় উপাদান, বিশেষ করে সুন্দরবনের প্রান্তিক জেলে, কাঠুরেদের মধ্যে আজও বিদ্যমান। চিকিৎসার থেকে তাঁরা এই মন্ত্র সঞ্জীবনী ক্ষমতায় বেশী বিশ্বাসী। অনেকক্ষেত্রেই সর্পদংশনে মৃত রোগীকে কলার ভেলায় ভাসিয়ে দেয় গঙ্গায়। তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস যে লখিন্দরের মত একদিন তাঁদের নিকটজন বেঁচে ফিরে আসবে। এই সংস্কারে মনসা পূজার পাশাপাশি মনসার পাঁচালী গান রাতের পর রাত অনুষ্ঠিত হতে থাকে সুন্দরবনসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে। তবে বাসন্তী গোসাবাতে বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বনবিবি পাঁচালীগান বা দুঃখের বনবাস যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের সংস্কার আছে।

যখন বাড়িতে বাড়িতে গুটিবসন্তের ছোঁয়া তখন শীতলা মন্দিরে পূজা বা শীতলার পাঁচালীগানের সংস্কার বর্তমান। মা শীতলা সন্তুষ্ট হলে বসন্তের হাত থেকে রক্ষা পাবে এই সংস্কারে জেলার মানুষ বিশ্বাস করেন। এই শতসহস্র বছরের সংস্কারের পিছনে কারণ হিসাবে বিজ্ঞান বলে শীতলার বাহন গাধা আর গাধার দুধ যদি কেউ জীবনে একবার পান করেন তাহলে বসন্তের জীবাণু তাঁকে আক্রমণ করতে পারে না। আমাদের প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে আমরা কোন সংস্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে কুসংস্কারের তকমা দিতে পারি, তবে তা সবসময় ফেলনা নাও হতে পারে। জেলার রাজবংশী বা মালোদের মধ্যে মনসার ভাসান প্রচলিত আছে। এই সংস্কারে জানা যায় শীতলা জাগরণ বা মনসার ভাসানে পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই, প্রয়োজনে মেয়েরা পুরুষের ন্যায় সাজেন। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মানুষদের মধ্যে পৌণ্ড্র সমাজে ভাদ্রমাসের শেষে রান্নাপূজার চল আছে। মনসার পূজার কারণে সারারাত্র জুড়ে রান্না করে পরেরদিন অরন্ধন ব্রত। বিশেষ বিশেষ কারণ অবলম্বন করে কোথাও কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, কোথাও মনসা, কোথাও বনবিবি, কোথাও আবার গঙ্গাপূজার সংস্কার আছে। জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে লক্ষ্মীপূজা ও গঙ্গাপূজার চল দেখা যায়। মৎস্যজীবিরা যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়, তখন তাঁরা গঙ্গা ও বনবিবির পূজা দিয়ে তবে যান। সেইসময় সুন্দরবনের জেলেদের স্ত্রীগণ নিজেদের হাতের শাঁখা ও সিঁদুর খুলে মায়ের মন্দিরে ততদিন পর্যন্ত বন্ধক রাখেন যতদিন না তাঁর স্বামী গৃহে ফিরছেন। মাছের সিজনে যখন নৌকা বা লঞ্চ নিয়ে সমুদ্রে যান, তাঁর আগে নৌকা পূজা হয়। নৌকার মাথায় সিঁদুর ও ফুলের মালা দেওয়া হয়। যাত্রীদের এই স্থানে পা দেওয়ার বিধান নেই।

পৌষমাসের শেষে আসে পৌষসংক্রান্তি। নবান্নের অনুষ্ঠান খুব একটা না দেখা গেলেও বাড়িতে বাড়িতে পিঠেপুলির আয়োজনের অভাব নেই। জেলার মানুষের সংস্কার আছে যে এই সময় তার এলাকা থেকে নিকটজন কেউ যদি গঙ্গাসাগর গমন করে থাকে তাহলে সেই বছর আর নিয়ম মেনে পিঠেপার্বণ করা যাবে না। গঙ্গাসাগর যাত্রী বাড়িতে নির্বিঘ্নে ফিরলে তারপরে সেই সংস্কার পালন করা হয়। পিঠে তৈরির পর প্রথম পিঠে গরু, বাড়ির ছাদে এবং পুকুরে জলদেবতাকে উৎসর্গ করার নিয়ম দেখা যায়। যাইহোক, এই পিঠেপুলির সাথে জড়িয়ে আছে ঢেঁকি সংস্কৃতি। ঢেঁকিতে চালগুঁড়ো করা আর ছড়া কেটে গান করার সংস্কৃতি পূর্বে লক্ষ্য করা গেলেও প্রযুক্তির তৎপরতায় তা আজ আর দেখা যায় না।

সুন্দরবনের সংস্কৃতিতে কোন পরিবারের কেউ মারা গেলে পূর্বে মৃত ব্যক্তির পরিবারে ৩০ দিনের অশৌচ পালনের চল থাকলেও তা এখন বারো দিনে পরিবর্তিত হয়েছে। সংস্কার, নিয়ম, বিধান ইত্যাদি সংস্কৃতিতে পরিণত করেন মানুষ মানুষের স্বার্থে। তেমন কোন সংস্কৃতি সময়, কাল ও পাত্রবিভেদে তার অস্তিত্ব নির্ভর করে। তেম্নভাবে আমরা ধরেই নিতে পারি যে আগামিদিনে হয়তো এই অশৌচকর্ম তিনদিন বা মৃতের পারলৌকিক কাজের দিনেই শেষ হয়ে যাবে। অন্য জেলার চিত্র কেমন সেটা জানি না, তবে দক্ষিণ ২৪ পরগণার রীতি ছিল এবং আজও অনেক জায়গায় বিদ্যমান আছে যে বাড়িতে কোন অতিথি বা আত্মীয় এলে বাড়িতে যতই জলের সম্ভার থাকুক না কেন অতিথির থেকে ছোট কেউ ঘটি বা জগে করে পুকুর ঘাট থেকে জল এনে সেই অতিথির পাদপ্রক্ষালন করে নতুন গামছা দিয়ে মার্জন করেন। সময়ের সাথে সাথে এমন অনেক সংস্কৃতি হয়তো বিলুপ্ত হতে চলেছে, কিন্তু এসবের মধ্যে দিয়ে প্রাচীন সনাতনী শ্রদ্ধা ভক্তি দিয়ে অতিথি সেবার চল প্রকাশ্য। বিশেষ করে বাড়িতে ব্রাহ্মণ বা গুরুদেব এলে এই সংস্কার নিয়মে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়।

প্রতি মাসের পূর্ণিমা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে অনেকের বাড়িতে কিংবা নিকটবর্তী দেউলে সত্যনারায়ণের শিন্নী বিতরণের মধ্য দিয়ে গৃহমঙ্গল কামনা করার রীতি প্রচলন আছে। সেইসূত্রে দক্ষিণবঙ্গের একটু সমৃদ্ধশালী পরিবারে নিজস্ব মন্দির পরিলক্ষিত হয়। জেলায় ভক্তির সাধকের তুলনায় শক্তির উপাসক তুলনায় কম। জেলা জুড়ে বছরের বিভিন্ন সময় অসংখ্য হরিবাসর ও নামকীর্তন হয় যে বঙ্গের অন্যান্য জেলাকে পিছিয়ে প্রথম সারিতে অবস্থান করে। হরিবাসরে মহাপ্রভুর ভোগ হিসাবে মালসাভোগের বিরাট আয়োজন জেলার সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। তবে এই হরিবাসর একটু শিক্ষিত, ব্রাহ্মণ, কলকাতার নিকটস্থ অঞ্চলে কম দেখা যায়। ব্রাহ্মণদের মধ্যে শক্তির পূজা করতে দেখা যায় বেশী। যদিও ব্যতিক্রম দেখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে জেলা থেকে ব্রাহ্মণ বাড়ি থেকে কীর্তনিয়া পাওয়া যায়। বর্তমানে জেলাজুড়ে শনিবারে বাবা শনিঠাকুর বা বড় ঠাকুরের পূজা চলে। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে এই দেবের কৃপা পাওয়া গেলে অভাব মোচন হবে। এছাড়াও জেলাজুড়ে রামায়ণ, কবিগান, তরজাগান, যাত্রা, পুতুলনাচ, গাজন মেলা অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমানে গাজন মেলা ছাড়া তেমন কিছুর অস্তিত্ব বৃহত্তরক্ষেত্রে দেখা মেলে না। বাড়ির নবজাতকের মঙ্গলকামনায় তার চূড়াকরণের সময় বাবা বড়কাছাড়ির মন্দির, ষষ্ঠী, পেঁচাপেঁচির মন্দিরে গিয়ে মানত করা, গণ্ডি কাটা, ধুনো পোড়ানো, হরিলুট বা ছলন (ঠাকুরের মূর্তি) প্রদান করার চল বর্তমান।

শিকড়ের সন্ধানেঃ

এবার আসি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সুন্দরবনের মাটিতে কান রেখে তুলে আনা লোককথা। একেবারেই ক্ষেত্রসমীক্ষার অংশবিশেষ হিসাবে পাঠকের সামনে কয়েকটি কাহিনীর সাথে লোকাচার ও স্থানীয় মানুষের বিশ্বাসের বুনন ধরা আছে।

(এক)

দেশের প্রান্তিক মানুষের মাঝে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন তাঁদের জীবনচর্চা আমাদের সভ্যজগতের থেকে একটু পৃথক ক্ষেত্রবিশেষে। দেশে দেশে কালে কালে প্রতিটা জাতির মধ্যে বিভিন্ন ধরণের নিয়ম, শৃঙ্খলা, সংস্কার বা কানুন ও বিধান বর্তমান ছিল, আজও আছে। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে শিক্ষার আলো প্রসারের মাঝে বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে হাজার বছরের পুরানো সংস্কৃতিকে এক লহমায় অপসংস্কৃতি বলে দিতে পিছপা হয় না, প্রাচীন যুগ থেকে বয়ে আনা সংস্কারকে এক কথায় কুসংস্কার বলে স্বঘোষিত বিজ্ঞানী বলে গর্বে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়ানো যায় কিন্তু এভাবে সবকিছু অস্বীকার করা যায় না। ভণ্ডামি ব্যতিরেকে সংস্কার অনেক রয়েছে যার পিছনে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের জনগোষ্ঠীর সমসাময়িক কালের লুক্কায়িত বিজ্ঞান। আমাদের দুর্বলতা হল আমাদের শিক্ষা দিয়ে সেই বিজ্ঞান উদ্ধার করতে পারি না। আমি মনে করি বিজ্ঞান হল বিশেষ রূপে জ্ঞান অর্জন করা। অর্থাৎ, যা কিছু নতুন করে জানছি আমরা তা নতুন আবিষ্কার বলে ধরে নিলেও তার অস্তিত্ব যে ইতোপূর্বে ছিল না তা নয়, তা ছিল প্রকৃতির নিয়মে। মানুষের কাণ্ডজ্ঞান সেই পড়ে থাকা বিজ্ঞানের অর্থ তখনও তুলে আনতে পারে নি। তার অর্থ এই নয় যে, মানুষ যা উদ্ধার করতে পারবে না, তাই অপবিজ্ঞান বা কুসংস্কার বলে পরিগণিত হবে। বরং কালের নিয়মে বারবার প্রমাণিত হয়েছে এসকল প্রাকৃতিক নিয়মকে মানুষ অস্বীকার করার কুফল নেমে এসেছে মানুষের উপর। মানুষ বিজ্ঞানের কায়দা কানুন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেও প্রকৃতির সেই প্রলয়নাচনের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হয়। বর্তমান প্রবন্ধ সেই সংস্কারের পিছনে লুকিয়ে থাকা শত শত বছরের বিজ্ঞান চেতনার কয়েকটি দিক তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। আমরা রাস্তায় বেরোলে প্রতিনিয়ত একটা জিনিস সবাই কমবেশী দেখি যে বিড়াল যদি আমাদের সামনে বা গাড়ীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করে তাহলে আমাদের কিছুক্ষন থামতে হয়। এটাকে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের কাজের ধারা ও সময়ের মূল্য বাড়তে থাকায় এখন সেইসকল নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কুসংস্কার বলে এগিয়ে চলেছি। এখানেই পরিবেশ তথা প্রকৃতির বিধানের সাথে সমাজবিজ্ঞানের মেলবন্ধন বিদ্যমান। লুক্কায়িত বিজ্ঞান বলে যে যখন বিড়াল বা ঐ জাতীয় প্রাণী কোন গলি বা ঝোপঝাড় থেকে বেড়িয়ে রাস্তা অতিক্রম করে তার পিছনে আরও বিড়াল বা তাদের ছোট ছোট বাচ্চা থাকতে পারে। তাই একটু থামুন, দেখুন তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে চলুন। তাতে করে কোন প্রাণী মারা পড়বে না। এই নিয়ম শুধু আমাদের দেশে নয়, পরিবেশপ্রেমী অধ্যাপক ড. মলয় মুখোপাধ্যায়ের মতে, আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জঙ্গলের মধ্যে যে হাইওয়ে আছে তার পাশে রীতিমত প্রজ্ঞাপন দেওয়া থাকে। এটা একটা নির্দেশমূলক সতর্কতা। সকল প্রাণীর সাথে উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ নামক প্রাণীর এক পারস্পরিক সহাবস্থান। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান হয়ে নিজের বাঁচা বা দৌড় বজায় রাখতে অন্যকে শেষ করতেও পিছপা হয় না। তাই একে কুসংস্কার বলে দেয় অবলীলাক্রমে

(দুই)

সুন্দরবনের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল আবার এক নতুন সংস্কার। সাধারণত হিন্দু রমণী বিবাহের পর থেকে হাতে শাঁখা আর সিথিতে সিঁদুর রাখে স্বামীর মঙ্গল কামনায়। এই শাঁখা সিঁদুরের পিছনের তাৎপর্য অন্য কোনসময় আলোচনা করা যাবে। যদিও, বর্তমানে আধুনিক শিক্ষিতা রমণীকুলের অনেকেই একে কুসংস্কার বলে মনে করে বিয়ের ঠিক পরে পরেই এসব ত্যাগ করে। যাইহোক, এসব মান্য করা না করা সবই ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে একদিন দেখা গেল বনবিবির মন্দিরে গুচ্ছ গুচ্ছ শাঁখা পলা ঝুলছে। ক্ষেত্রসমীক্ষার মাঝে এক বয়স্ক ভদ্রলোকের কাছে জিজ্ঞাসা করতে তিনিই জানালেন যে যখন বাড়ির পুরুষ মানুষ গভীর জঙ্গলে কাঠ ভাঙ্গতে, মধু আনতে কিংবা অনেকদিনের জন্য মাছ ধরতে যায়, তখন সেই লােকের স্ত্রী শাঁখা সিদুর দেবীর কাছে বন্দক রাখেন। তাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস যে মায়ের কাছে তাঁদের স্বামীর জীবন জমা রইল। তিনি যদি প্রাণে বাঁচান তাহলে আবার শাঁখা সিঁদুর অঙ্গে তুলবেন, নইলে বৈধব্য জীবন কাটাতে হবে। এটা শুনে অনেকের মনে হবে এই সংস্কারের পিছনে বিজ্ঞান কোথায়? বিজ্ঞান বলতে এখানেই লুকিয়ে আছে হাজার বছরের সমাজ বিজ্ঞানের সামাজিক বিধান। যুক্তিবাদী সমাজপতিদের কথায় যখন কোন নারীর স্বামী জঙ্গলে যায়, তখন তাঁর মনে এত সুখ থাকে না যে এয়োস্ত্রী সেজে ঘুরে বেড়াবেন বা আনন্দ করবেন। যখন তাঁর কাছে শাঁখা সিঁদুর থাকে না, তখন তাঁর প্রতিমুহূর্ত স্বামীর অনুপস্থিতি অনুভব হয়। তাই সে সমাজের বিধানকে অস্বীকার করে কোনরূপ অপ্রীতিকর বা অসামাজিক কাজে যুক্ত হন না। তাঁরা এক নিয়মনিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে দিন গুজরান করেন। সেসময় তাঁদের দর্শন অনেকটাই বিধবাদের মত হয় বলে যুবসমাজ তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট কম হন, বলা ভালো তাঁর সাথে বজ্জাতি করতে গেলে তাঁদের মনেও বনবিবির রক্তচক্ষু ভেসে ওঠে। ফলে তাঁকে কেউ বিরক্ত করতে পারেন না। স্বামী ফিরে আসা পর্যন্ত সন্তানদের নিয়ে একা রমণী নিশ্চিন্তে জীবন কাটান। যদিও এখন নৈতিকবোধ বিসর্জন দিয়ে অনেকেই নিজের সুখ চরিতার্থে অনেক কিছুই জলাঞ্জলি দেন

(তিন)

সুন্দরবনের এমন একটি সন্ধ্যায় গল্পের আসর বসেছে। উপস্থিত আছেন আমাদের থেকে বিভিন্ন সহায়তা পান এমন কিছু বাড়ির বয়স্ক ভদ্রলোক। সেখানে গল্প সূত্র জানা গেল যে, একটা নিয়ম আছে যে যখন আমাদের এই সুন্দরবনের ছেলেরা মধু ভাঙ্গতে জঙ্গলে যান, তখন বাড়ির মেয়েদের বিশেষ করে মৌলে মানে যারা মধু ভাঙ্গতে যান তাঁদের স্ত্রীদের দিনে রাত্রে শোবার ঘরের দরজা যদি খুলে রাখেন তাহলে মধু বেশী পাওয়া যাবে। আর যদি কেউ দরজা বন্ধ করে কোন কারণে তাহলে মধু প্রাপ্তি তো দূরের কথা, বনবিবির কোপে তাঁর অকাল বৈধব্য ঘটে যেতে পারে। এটাই হল প্রান্তিক সুন্দরবনের সংস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। কিন্তু যুক্তিবাদী সংস্থা প্রমাদ গুনলেন। পরেরদিন সকালে উঠে এক মৌলের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাঁকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করাতে তিনি এই জনজাতির হাজার বছরের লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞান সভ্যসমাজের কাছে উন্মোচন করে দিলেন। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না করবেন আপনার ব্যাপার। তাঁর কথায়, আমরা যখন জীবনের আশা ছেড়ে গভীর জঙ্গলে দিনের পর দিন উপার্জনের তাগিদে পড়ে থাকি, তখন ভয়ে, ক্লান্তিতে বা মানসিক অবসাদে সবথেকে বেশী মনে পড়ে প্রিয়জনের মুখ। সুন্দরবনে একটা সময় অনেক বিরল বসতি লক্ষ্য করা যেত। ফলে এই বিধানের কারণে যদি বাড়ির মেয়েরা ঘরের দরজা খুলে রাখতেন তাহলে কোনরূপ ব্যাভিচারে লিপ্ত হতে গেলে প্রতিবেশী বুঝতে পারবেন ভেবে কেউ এই অপবিত্র কর্মে লিপ্ত হন না। যাইহোক, এই দরজা খুলে রাখলে আমাদের মধু কত বেশী প্রাপ্তি হয় জানা নেই, তবে আমরা নিশ্চিন্তে থাকি যে আমাদের বাড়ির মেয়েরা কোন ব্যাভিচারে লিপ্ত হচ্ছেন না। সেখানেই আমাদের শান্তি। তাই অনেকটা নিশ্চিন্তে আমরা জঙ্গলে খেয়াল রেখে মধু আহরণ করতে পারি। ফলে বেশী বেশী করে মধু সংগ্রহ করতে পারি। এখন এই হারিয়ে যাওয়া জনজাতির অবহেলায় পড়ে থাকা বিজ্ঞানের তাৎপর্য বর্তমান বিজ্ঞানের পূজারীদের কাছে কুসংস্কার বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে তাঁদের সামাজিক নিয়ম কানুন বা ধর্মীয় বিধান দিয়ে তাঁদের সমাজ এত বছর ধরে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সভ্য সমাজ তাঁদেরকে অসভ্য বলে মনে করতেই পারে, কিন্তু তাঁদের সভ্যতায় আধুনিক বিজ্ঞানের সরঞ্জাম বা চিকিৎসা না থাকলেও তাঁদের মত করে তাঁরা বাঁচতেন। অনেক সময় আমাদের সভ্যদুনিয়ার কোন মানুষ সেখানে গিয়ে সমস্যায় পড়লে সেই সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি দেখলে বর্তমান বিজ্ঞান হোঁচট খেতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই বিজ্ঞান মানবো, ধর্মীয় অনুশাসনে আটকে থাকা ভণ্ডামি সরিয়ে দেব। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সবকিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেব। আর এটা করছি বলেই আমরা নিজেরাই নিজেদের উপর নামিয়ে আনছি মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সেখানেও ব্যাখ্যা অন্যমাত্রায় নিয়ে যাবে আপনাকে। একটা কথা মাথায় রাখবেন কোন কিছু নস্যাৎ করতে গেলে আপনাকে সেটা আত্মস্থ করতে হবে প্রথমে। নইলে তার অস্তিত্ব নিয়ে ব্যাখ্যা করা সমালোচনার নামান্তর মাত্র

 

শেষ কথনঃ

শত সহস্র বছর ধরে চলে আসা কোন জনজাতির ঐতিহ্যবাহী সংস্কার বা ধারা সেই জনজাতির সংস্কৃতিতে পরিগণিত হয়। লোকসংস্কৃতি এমন একটা সত্ত্বা যা স্থান কাল ভেদে পৃথক হয়ে থাকে। কোন এক কালে যে সংস্কৃতি মানুষের মননে চিন্তনে জায়গা করে নিয়েছিল সেটা আজকের পাশ্চাত্য প্রভাবে বিলুপ্তপ্রায়, আবার যা কোনকালেই গ্রহণযোগ্য ছিল না তা আধুনিকতার ছোঁয়ায় সময়ের সাথে সাথে গৃহীত হয়েছে। তবে প্রত্যেক জনজাতির একটা নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সেখানেই সেই জাতির মৌলিকতা। সাধারণত জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সাথে সাথে সংস্কৃতির ঘরানার পরিবর্তন ঘটলেও পরিবারের বয়স্কদের মধ্যে সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম সংস্কৃতির ধারকবাহক হিসাবে রুচি আর পছন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। তাই লোকাচার বা লোকসংস্কৃতি দেশ ও কালের নিরিখে ছিল, আছে ও থাকবে। শুধু রুচি আর যুক্তিতে তার ধরণ বদলাবে। আমরা লোকসংস্কৃতির পর্যালোচনা করতে গিয়ে যেন নিজের রুচিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সবকিছু সমূলে উৎপাটিত করে না ফেলি সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ সুন্দরবনের মানুষের এই লোকাচার বা লোকবিশ্বাস ছিল বলেই হয়তো আজকের সুন্দরবনের যেটুকু আমরা দেখতে পাই, সেই কারনেই পাই। প্রকৃতির পূজা করতে করতে কখন যে তাঁরা প্রকৃতির সন্তান হয়ে গেছে তা আমরা সভ্যতার নিয়ন আলোর তলায় বসে অনুধাবন করতে পারিনি। হয়তো সেই অনুভূতি আমাদের নেই।

গ্রন্থসূত্রঃ

ü  গুড়িয়া, মহাদেব (২০১৩), দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা সমগ্র, পাণ্ডুলিপি, কলকাতা

ü  ঘোষ, সঞ্জয় (২০১২), সুন্দরবনের পূর্বপুরুষ পূজা (আদিবাসী সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি), সুচেতনা, কলকাতা

ü  ঘোষাল, ইন্দ্রাণী (২০০৬), সুন্দরবনের মৎস্যজীবিদের জীবন, তাঁদের লোকসংস্কৃতি এবং লোকসাহিত্য, গ্রথন, কলকাতা

ü  দাস, গোকুল চন্দ্র (২০০৯), দক্ষিণ ২৪ পরগণার আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা

ü  দাস, নির্মলেন্দু (২০১৮), সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি, স্বস্তিক প্রকাশন, কলকাতা

ü  নস্কর, দেবব্রত (২০১৮), সুন্দরবন সভ্যতা ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

ü  নস্কর, দেবব্রত (১৯৯৯), চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেবদেবীঃ পালাগান ও লোকসংস্কৃতি জিজ্ঞাসা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

ü  নস্কর, ধূর্জটি (২০০০), দক্ষিণ ২৪ পরগণার গাজন ও গাজন মেলা, আশুরালি গ্রাম উন্নয়ন পরিষৎ, দক্ষিণ ২৪ পরগণা

ü  পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর (২০১), প্রসঙ্গ সুন্দরবন (১ম খণ্ড), ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা

ü  পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর (২০২০), প্রসঙ্গ সুন্দরবন (২য় খণ্ড), ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা

ü  পুরকাইত, সনৎকুমার ও মণ্ডল, উমাশঙ্কর (২০২১), প্রসঙ্গ সুন্দরবন (৩য় খণ্ড), ভূগোল ও পরিবেশ, কলকাতা

ü  পুরকাইত, সনৎকুমার (২০২১), জেলা সংস্কৃতিঃ দক্ষিণ ২৪ পরগণা, অপ্রকাশিত

ü  বিশ্বাস, মন্টু (২০১২), সুন্দরবনের লোককথা, অক্ষর প্রকাশনী, কলকাতা

ü  বসু, গোপেন্দ্র কৃষ্ণ (২০১৮), বাংলার লৌকিক দেবতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

ü  মণ্ডল, অনুকূল (২০১৪), সুন্দরবনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, দি সি বুক এজেন্সী, কলকাতা

ü  ণ্ডল, কৃষ্ণকালী (২০০১), দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার লৌকিক দেবদেবী ও মূর্তিভাবনা, নব চলন্তিকা, কলকাতা

ü  ণ্ডল, কৃষ্ণকালী (২০১০), সুন্দরবনের সংস্কৃতি ও প্রত্নভাবনা, নব চলন্তিকা, কলকাতা

ü  মিস্ত্রী, সুভাষ (২০১৮), লোকায়ত সুন্দরবন (১, ২ ও ৩য় খণ্ড), দিয়া পাবলিকেশন, কলকাতা

ü  রায়চৌধুরী, প্রসিত (২০২০), আদিগঙ্গার তীরে, বর্ণব্যঞ্জন, কলকাতা

ü  রায়চৌধুরী, শক্তি ও পুরকাইত, মনোরঞ্জন (২০১৪), বারুইপুরের ইতিহাস, বারুইপুর পৌরসভা, বারুইপুর, কলকাতা

ü  সরকার, প্রণব (২০১৮), বাংলার লোকসমাজঃ ইতিহাস ও সংস্কৃতি, লোক, কলকাতা

ü  সিং, সুকুমার (১৯৯৬), দক্ষিণ ২৪ পরগণার ইতিহাস, মাস এন্টারটেইনমেন্ট প্রাঃ লিঃ, কলকাতা

ü  সুর, সুরজিত (২০১৪), মাটিতে পা রেখে, পাঠশালা প্রোডাকশন, হাওড়া

ü  হালদার, বিমলেন্দু (২০১১), দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার যাত্রাগানঃ ইতিহাস ও আলোচনা, প্রিয়নাথ প্রকাশনী, কলকাতা

ü  হালদার, বিমলেন্দু (২০১৯), দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কথ্যভাষা ও লোকসংস্কৃতির উপকরণ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), প্রিয়নাথ প্রকাশনী, কলকাতা

ü  হালদার, বিমলেন্দু (২০১৯), দক্ষিণ বঙ্গ জনসংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাস বিচিত্রা, প্রিয়নাথ প্রকাশনী, কলকাতা

জগতের ধর্মগুরু লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র

  লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীশ্রীকৃষ্ণচন্দ্র   গল্পের নায়ক যেখানে কৃষ্ণ সেখানে বলে রাখা ভালো আধ্যাত্মিক নয়ন না থাকলেও যদি কেউ তাঁর বিবেক ...